অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা হিসেবে প্রায় ১৫ মাস ধরে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন বিশিষ্ট আলেম স্কলার ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। উপদেষ্টা পরিষদে তিনিই একমাত্র আলেম প্রতিনিধি। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রতি ইসলামপন্থীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। তিনিও দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ইসলামপন্থীদের পক্ষে নানা কার্যক্রম আঞ্জাম দিচ্ছেন। সম্প্রতি আওয়ার ইসলামের মুখোমুখি হয়ে এসব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ধর্ম উপদেষ্টা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলাম সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব। অনুলিখন করেছেন: লাজ্জাস আল-হাবীব। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ শেষ পর্ব।
আওয়ার ইসলাম: কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ অথরিটি আল হাইয়াতুল উলয়ার নেতৃবৃন্দ কওমি সনদ বাস্তবায়ন বিষয়ে আপনারসহ এশাধিক উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এই স্বীকৃতি বাস্তবায়নের সর্বশেষ অবস্থা এবং পরিস্থিতি কী?
ধর্ম উপদেষ্টা: আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা প্রথমে ছিলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাহেব, আমাদের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। পরে প্রফেসর ডক্টর সি.আর. আবরার সাহেব এসেছেন। আমি ওনাকেও একটা ডিউ লেটার দিয়েছি। এবং বলেছি আপনি মাদরাসা থেকে দাওরা হাদিস সনদপ্রাপ্ত ছাত্রদের নিয়ে একটা গেজেট করেন যে, তারা এই এই কাজগুলো করতে পারবেন। এরমধ্যে প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও কলেজে শিক্ষকতা করতে পারবেন। এম.এ ইসলামিক স্টাডিজ ফিল্ডে। তারা বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীর যে মসজিদগুলো আছে ওখানে খতিব ও ইমাম হতে পারবেন। বিভিন্ন বাহিনীতে আবার রিক্রুট ইনস্ট্রাক্টর নেয় ওখানেও তারা কাজ করতে পারবেন। আরও অনেক ফিল্ড আছে। উচ্চতর আইন ফিল্ড পরিষদে পিএইচডি করতে পারবেন। এ ধরনের প্রজ্ঞাপন যদি আপনি জারি করে দেন, তাহলে গেল সরকার যেটা করে দিয়েছে এর ওপর একটা নতুন মাত্রা যোগ পাবে। আমি বেফাকের মহাসচিব হজরত মাওলানা মুফতি মাহফুজুল হক সাহেবসহ একটা প্রতিনিধি দল নিয়ে মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টার সাথে উনার দপ্তরে দেখা করি। এবং এটার ব্যাখ্যা করি। উনি হিয়ারিং দিয়েছিলেন এবং বললেন, এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে আমরা আরও আলোচনা করব। আমি আমার মন্ত্রণালয়ের ব্যস্ততায় এমনভাবে নিমজ্জিত যে, সময় বের করতে পারছি না। তারপরও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আরেকবার বেফাকের নেতৃবৃন্দদের নিয়ে মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টার সাথে দেখা করব। এবং এ বিষয়ে একটা ইতিবাচক ফলাফলে যেতে আমরা চেষ্টা করব। আপনি ভালোভাবেই জানেন, এই কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি তথা তাদের কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ এটা আমার মন্ত্রণালয়ের আওতায় নয়। এটা পিওর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায়। আর আমি যেহেতু মাদরাসার ছাত্র, আমি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছি, এটা আমার একটা নৈতিক দায়িত্ব। অথবা আমার একটা অন্তরের টান, আমি যেন এটা করি।
আওয়ার ইসলাম: ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বেশকিছু সংস্কারের কথা আমরা শুনে আসছিলাম। কতটুকু সংস্কার করেছেন বা বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন?
ধর্ম উপদেষ্টা: ফাউন্ডেশনে আমরা একজন নতুন মহাপরিচালক নিয়োগ করেছি, যিনি বিচার বিভাগ থেকে এসেছেন। আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি একজন বিচারপতির নেতৃত্বে। তারা তদন্ত করছেন, সেখানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দুইজন গভর্নরও আছেন। সাক্ষ্য প্রমাণ নিচ্ছেন। আংশিক কিছু প্রতিবেদন আমাদের দিয়েছেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন অল্প দিনের মধ্যেই পাব। এইটা পেলে কাজের সুপারিশের ভিত্তিতে বোর্ডের গভর্নরদের অনুমোদনক্রমে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করব। আমরা মাঠ পর্যায়ের যে সমস্ত ভালো ভালো অফিসাররা আছেন তাদের কেন্দ্রে আনছি। দীর্ঘদিন যাবত কেন্দ্রে যারা আছেন তাদের মেধা আছে, তাদের যোগ্যতা আছে। আমরা চাচ্ছি যে, এই মেধা এবং যোগ্যতাগুলোকে যদি আমরা তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে পারি তাহলে তৃণমূল আলোকিত হয়ে যাবে। এজন্য আমরা একটা ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করছি। এছাড়া আমরা নতুন জনবল নিয়োগ দিতে চাচ্ছি। তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার লোক আমরা নেব। ইতোমধ্যে অনেক আবেদন আমাদের কাছে জমা পড়েছে। আমরা এই মাসেই পরীক্ষা নিয়ে তাদের নিয়োগ দিতে চাচ্ছি। এবং যারা দীর্ঘদিন যাবৎ পদোন্নতি বঞ্চিত তাদের জন্য একটা কমিটি গঠন করে দিয়েছি, কমিটির মাধ্যমে আমরা তাদেরকেও প্রমোশন দেবো। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে এই অভিযোগগুলো বিচার বিভাগের তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার একটা সংস্কার আমরা হাতে নিয়েছি। এছাড়াও ফতোয়ায় দারুল উলুম দেওবন্দ বিভিন্ন স্কলারের মাধ্যমে বাংলা করাচ্ছি। বিশ্বকোষের কাজ শুরু হয়েছে। সাহাবা বিশ্বকোষ, আউলিয়া বিশ্বকোষ। আমরা এগুলো ধারাবাহিকভাবে বের করছি। স্কলারদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে, সংস্কারে মোটামুটি আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি।
আওয়ার ইসলাম: জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আমাদের মহলে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে টয়লেট অব্যবস্থাপনা এবং সাউন্ড সিস্টেম জুমার খুতবা ও জুমার বয়ানের জন্য। এই দুটি বিষয়ে আপনি পদক্ষেপ নিয়েছেনও শুনেছি। সর্বশেষ এটি কেন এবং কী সমস্যার কারণে হচ্ছে না- এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।
ধর্ম উপদেষ্টা: খুব যৌক্তিক প্রশ্ন করেছেন। আমি আপনার মাধ্যমে বায়তুল মোকাররমের যারা নামাজ পড়েন অথবা আশেপাশে থাকেন তাদের বায়তুল মোকাররমে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করব। ইতিমধ্যে সাউন্ড সিস্টেম আমরা টোটাল পরিবর্তন করে দিয়েছি, ইমাম সাহেবের সামনে যিনি বসেন এবং শেষে যিনি বসেন উভয় একই সাউন্ডে আওয়াজ শুনবেন। আজকেই আমরা পরিষ্কার কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছি ইমাম সাহেবের জায়নামাজ থেকে নিয়ে মসজিদের নিচ তলার শেষ পর্যন্ত। একেবারেই চকচকে-তকতকে উন্নতমানের কার্পেট। পাখা মুছে দিয়েছি এবং অচল পাখা সচল করে দিয়েছি। নিচে এয়ার কন্ডিশনের এসিও সার্ভিসিং করিয়ে দিয়েছি। জুতার বক্স পরিবর্তন করা ও র্যাকগুলো নতুন করে দিয়েছি। সিঁড়িগুলোতে জমে থাকা ময়লাও আমরা মেডিসিন দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছি। ওজুখানা এবং বাথরুম মিলে প্রায় ৫৪টার মতো, এরমধ্যে প্রায় অর্ধেকর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলোও ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা হয়েছে এক মাসের ভেতরে ঠিক হয়ে যাবে। একেবারেই পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে। এবং যেখানে যেখানে মরিচা ধরেছে সেটাও আমরা ঠিক করে দিচ্ছি। এটা হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন প্রয়াস। এর পরবর্তী পর্যায়ে আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি নিয়ে ২০০ কোটি টাকা বায়তুল মোকাররমের জন্য বরাদ্দ করেছি। এর মাধ্যমে বায়তুল মোকারমেরর মূল কাঠামো ঠিক রেখে বিউটিফিকেশন ও দৃষ্টিনন্দনে পুনঃনির্মাণ হবে। এটা বড় প্রজেক্ট। আর ছোট প্রজেক্ট যেগুলো আপনি বললেন, এগুলো পূর্ণোদ্যমে চালু হয়েছে। রাতে যেন কোনো ভবঘুরে ঘুমাতে না পারে সেজন্য প্রহরীদের ডিউটির স্থান আমরা ভাগ করে দিয়েছি। আমার মন্ত্রণালয় থেকে দুইজন অফিসার আজ থেকে সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করা শুরু করেছে।
আওয়ার ইসলাম: আমরা সর্বশেষ জানতে চাইবো বাংলাদেশের ধর্মীয় ভবিষ্যৎ অর্থাৎ যে যার জায়গা থেকে ধর্ম পালনের যে ব্যবস্থাটা কিছুক্ষণ আগে আপনি আলোচনা করেছেন, এটার ভবিষ্যৎ কী? সংঘাতপূর্ণ নাকি সম্প্রীতিপূর্ণ?
ধর্ম উপদেষ্টা: আমি সবসময় বলি আপনাকেও বলেছি, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায় যারা বাস করে তাদের মধ্যে একটা সম্প্রীতির আগ্রহ তৈরি হয়েছে, যেটাকে আমরা কমিউনাল হারমনি হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারি। অদূর ভবিষ্যতে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্য কোনো ধর্মের বা নৃতাত্ত্বি¡ক জাতি-গোষ্ঠীই বলেন, আমরা সবাই মিলে যদি এদেশের উন্নয়নে কাজ করি, আমরা যদি এগিয়ে আসি, তাহলে আমাদের মাথা অনেক উঁচু হবে। আর যদি আমরা সংঘাতে লিপ্ত হই তাহলে আমাদের রাজনীতিও শেষ, আমাদের পর্যটন শিল্পও শেষ এবং বৈদেশিক যে বিনিয়োগ আসার সেটাও আসতে চাইবে না। কারণ কোনো দ্বন্দ্ব ও সংঘাতপূর্ণ দেশে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করেন না। তো আমাদের যে সম্প্রীতি বিভিন্ন ধর্ম, দল, মতের মধ্যে একটা সুন্দর ও সহনীয় পর্যায়ে আছে এবং সময়ে সময়ে এটা পারস্পারিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এনএইচ/