বিশেষ সাক্ষাৎকার
অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা হিসেবে প্রায় ১৫ মাস ধরে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। উপদেষ্টা পরিষদে তিনিই একমাত্র আলেম প্রতিনিধি। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি ইসলামপন্থীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। এজন্য তার কোনো কাজ প্রত্যাশা অনুযায়ী না হলে এর সমালোচনাও হয় বেশি। ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর কিছু কাজ নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। সম্প্রতি আওয়ার ইসলামের মুখোমুখি হয়ে এসব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ধর্ম উপদেষ্টা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলাম সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব। অনুলিখন করেছেন: লাজ্জাস আল-হাবীব। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রথম পর্ব।
আওয়ার ইসলাম: পূজা এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুষ্ঠানগুলোতে আপনার যাওয়ার কারণে আপনার নিজস্ব বন্ধু মহলেই আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ধর্ম উপদেষ্টা: আপনি জানেন যে, আমি ধর্ম উপদেষ্টা। একজন মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে আমি উপদেষ্টা। আমি শুধু কোনো মুসলমানদের উপদেষ্টা নই, দেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও নৃগোষ্ঠীসহ যত ধর্মাবলম্বী আছে; যার যার ধর্ম সে পালন করে; আমি সবারই উপদেষ্টা।
দ্বিতীয়ত এ দেশটা সেক্যুলার স্টেট। এটা একটা কাঠামোর ভেতর দিয়ে চলে। এখানে কোনো ইমারাতে শরিয়াহ চালু নেই। অথবা এটা কোনো ইসলামিক হুকুমত নয়। এমনকি উপদেষ্টা পরিষদের ভেতরে আমরা যারা আছি, তাদেরও ভিন্ন ভিন্ন দর্শন আছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একে অপরকে আমরা সহযোগিতা করে থাকি। অতএব আমি মন্দিরে যাই, প্যাগোডা বা চার্চে যাই, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের জন্যই যাই। কিন্তু আমি বায়তুল মোকাররমে যাই ইবাদত করার জন্য। আর আমি মন্দিরে গিয়ে, প্যাগোডা বা চার্চে গিয়ে কোনোদিন তাদের অর্চনা বা রেওয়াজগুলো অনুসরণ করিনি। মন্দিরে গিয়ে পূজায় গিয়ে আমি তো গীতা পাঠ করিনি। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালাইনি। অথবা দুর্গার প্রতি আমি কোনো প্রণাম জানাইনি। বৌদ্ধদের প্রবারণা পূর্ণিমায় গিয়ে ফানুস ধরে আকাশে উড়ানোটাও আমি করিনি। কেবল নীরব দর্শক।
এই দেশে, আপনি জানেন বিপ্লব পরবর্তী সময়ে আমরা যখন দায়িত্ব নিয়েছি, তখন এই সরকারকে বিব্রত করার জন্য, অস্থির করার জন্য নানামুখী চক্রান্ত শুরু হয়েছিল। সংখ্যালঘুরা ভালো নাই, তারা ধর্ম-টর্ম পালন করতে পারে না, তাদের জান মাল নিরাপদ না, এরকম একটা নেগেটিভ প্রচারণা গোটা দুনিয়ায় ছড়ানো হচ্ছে এবং তারা প্রমাণ করতে চায় যে, এটা মৌলবাদী সরকার। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেব ভেতরে ভেতরে তালেবান। এটা ডক্টর ইউনূস সাহেব আমাদেরকে বহুবার বলেছেন। আমাকে বিশেষভাবে তালেবান বলা হচ্ছে। মানে আমাদেরকে খারাপভাবে চিত্রায়িত করা। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকেরা তাদের ধর্মচর্চা, কর্ম, আচরণ পালন করতে পারছে না। এরকম একটা চিত্র তুলে ধরতে চায়। এই সমস্ত উৎসব উদযাপনে বিঘœতা সৃষ্টি করে একশ্রেণির লোক পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চায়। এহেন মুহূর্তে ধর্ম উপদেষ্টা হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদেরকে অভয় দেওয়া, শৃঙ্খলা রক্ষা করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমার ওপর গুরুদায়িত্ব অর্পিত। আমি দায়িত্ব পালনে যদি বিন্দুমাত্র অবহেলা করি, এই চেয়ারে এক মুহূর্তের জন্যও আমি থাকতে পারবো না। থাকাটা সমীচীন হবে না। বা আমার নিয়োগকর্তারা আমাকে রাখবে না।
আপনার অবগতির জন্য জানাই, আমেরিকা থেকে একটা প্রতিনিধি দল এসেছে। মার্কিন উপরাষ্ট্র দূত উপস্থিত ছিলেন। তারা আমার কাছে জানতে চাইলেন, এদেশে যারা মুসলমান আছে তারা ধর্মীয় উৎসব, ধর্মচর্চা করতে পারে কি না। কতটুকু স্বাধীনতা আছে। সরকার তাদের কোনো সহযোগিতা করে কি না। আমরা যথাযথভাবে উত্তর দিয়েছি। এবং আপনি জানেন, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে যদি হানাহানি হয়; সৌহার্দ্যরে পরিবেশ যদি বিনষ্ট হয়; কোনোদিন একটা রাষ্ট্র উন্নতির পথে যেতে পারে না। সমাজ এগোতে পারে না। কারণ বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মাবলম্বীদের ভেতরে যদি সংঘাত সহিংসতা তৈরি হয় তাহলে ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ স্থিতিশীল থাকে না, ফলের বিনিয়োগ হবে না, ইনভেস্টার আসবে না, দেশের বিকাশ ঘটবে না। এজন্য সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য রক্ষা করা অতি জরুরি এবং এটা আমার দায়িত্ব বলেই আমি ওখানে গিয়ে হাজির হই।
আওয়ার ইসলাম: গত বছর আপনার নেতৃত্বে হজ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সুনাম কুড়িয়েছে। এবারের হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত শুনতে চাই।
ধর্ম উপদেষ্টা: ১ লক্ষ ২৭ হাজার হচ্ছে আমাদের হজের কোটা। এই কোটাটা নির্ধারণ করে সৌদি আরব। ওআইসির পক্ষ থেকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে উনারা হাজিদের এভাবে ভাগ করে দেন। তারা যে কোটা দেন এই পরিমাণ হাজি আমাদের দেশ থেকে যায় না। গত বছর গেছে ৮৭ হাজার। এ বছর সংখ্যাটা আরও কম। হাজিদের হজে যেতে কোনো বাধা হবে না। এজেন্সি যারা আছেন তারাও চেষ্টা করছেন। মন্ত্রণালয়ের সাথে এজেন্সির সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। আর আমাদের গ্রামের মানুষ সব সময় টাকা পকেটে রাখে না। কারো হয়তো ধান আছে, গম, আলু, ডাল আছে এগুলো বিক্রি করে তারা টাকা যোগাড় করে। এতে একটু দেরি হয়। আমরা ইন্দোনেশিয়ার মতো যদি পাঁচ বছর আগে টাকা দিয়ে দিতে পারতাম তাহলে আমাদের এ প্রবলেম থাকত না।
আওয়ার ইসলাম: উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সেফ এক্সিট চাচ্ছেন। এ বিষয়টা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য জানতে চাচ্ছি।
ধর্ম উপদেষ্টা: সেফ এক্সিট মানে হচ্ছে ক্ষমতার পালাবদলের পরে নিরাপদে দেশ ত্যাগ করা। এদেশ প্রিয় মাতৃভূমিতে ঢাকায় আমার নিজস্ব কোনো ঘর নাই। ১৯৭৩ সাল থেকে আমি চট্টগ্রাম শহরে আছি। মাদরাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি এবং শিক্ষকতা করেছি বহু বছর। আমার নিজের কোনো ফ্ল্যাট নাই, নিজের কোনো বাড়ি নাই চট্টগ্রাম শহরে। আছে আমার গ্রামে। ফলে সেফ এক্সিট যদি আমি নিই তাহলে বিদেশে কোথায় থাকবো। আর আমি তো টাকা লুট করি নাই, আমিতো প্রজেক্টের টাকা মেরে দেইনি। আমার সহজ সরল জীবন। যারা বিদেশে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি করেছে তাদের নৈতিক অর্থ অনৈতিক অর্থ দুইটাই আছে। আমার তো অনৈতিক কোনো অর্থ নাই। ফলে বিদেশে থাকারও কোনো সুযোগ নাই। এদেশ আমার, এদেশ আমার জন্মভূমি, এ দেশেই আমি থাকবো এবং এদেশের মাটিতেই আমি সমাহিত হব। অতএব সেফ এক্সিট আমার ক্ষেত্রে বিলকুল প্রযোজ্য নয়।
আওয়ার ইসলাম: সম্প্রতি আপনি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গানের শিক্ষকের বদলে কওমি মাদরাসায় দাওরা হাদিসপড়ুয়া ছাত্রদের ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে এবং আপনি কতটুকু আশাবাদী?
ধর্ম উপদেষ্টা: আমি দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় ৭-৮ মাস সময় মাননীয় উপদেষ্টা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে একটা ডিউ লেটার দিই। সেখানে আমি উল্লেখ করি, আমরা প্রাথমিকে ধর্মীয় শিক্ষকের অভাব লক্ষ্য করছি। আপনি যদি দাওরা হাদিসের সনদধারীদের প্রাথমিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন তাহলে তারা ধর্ম ভালো পড়াতে পারবে। তাকমিলে হাদিস যেটা এম.এ ইসলামি স্টাডিজের সমমান। ভালোভাবেই ফাইভ পর্যন্ত বাংলা, সমাজ এগুলোও পড়াতে পারবে। অতএব তাদেরকে সেই পজিশনে নিয়োগ করলে প্রাইমারি শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। আমি মাননীয় উপদেষ্টার সাথে কথা বলেছি, তিনি বলছেন আমরা এটা পেয়েছি, আমরা বিবেচনা করব। ধর্মীয় শিক্ষক নামে আমাদের কোনো পোস্ট নাই। আমরা সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করে কাউকে বাংলা, কাউকে ইংরেজি, সমাজ, ধর্ম এগুলো পড়াতে দিই। বৌদ্ধরা বৌদ্ধ ধর্ম পড়ুক, হিন্দুরা হিন্দু, তাদেরকে তাদের ধর্মীয় শিক্ষকরা শিক্ষা দেবেন। মুসলমানদেরকে একজন আলেম শিক্ষা দেবেন। তাহলে আমাদের এখানে ধর্ম চর্চাটা ঠিক থাকল। তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, বিবেচনা করবেন।
এলএইস/