মুফতি জুবায়ের বিন আব্দুল কুদ্দুস
এক.
কুরআনুল কারীম মহান আল্লাহ তায়ালার কালাম। আল্লাহ তায়ালা নিজের পক্ষ থেকে তা আমাদেরকে দান করেছেন। তাই তাকে আসমানী কিতাব বলা হয়। এতে রয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য হেদায়েত এবং সঠিক পথের নির্দেশনা। কোরআনুল কারীমের অনুসরণ অনুকরণ মানুষকে দুনিয়া এবং আখেরাতে সফলতা দান করে। কুরআনের পরিচয় দিয়ে আল্লাহ তা'আলা এরশাদ করেন- "আর নিশ্চয়ই এই কোরআন সৃষ্টি কুলের রবের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। জিবরাঈল ওহী নিয়ে অবতরণ করেছেন- আপনার অন্তরে, যাতে আপনি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। তা অবতীর্ণ করা হয়েছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়। (সূরা আশ শুআরা, আয়াত নং ১৯২-১৯৫)
দুই.
আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের চির সুখের জন্য জান্নাত এবং দুঃখের স্থান হিসেবে জাহান্নাম বানিয়েছেন। যে সকল বান্দা তাঁর আনুগত্য করবে, তাঁর ইবাদত বন্দেগী করবে তাদেরকে তিনি পরকালে জান্নাত দিবেন। আর যারা তাঁর অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে, পাপাচারে ডুবে থাকবে তাদেরকে তিনি জাহান্নামে দিবেন। একথা বান্দাদেরকে বুঝাবার জন্য যুগে যুগে আসমানী কিতাবসহ তিনি নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেন। তাঁকে যে কিতাব দান করেছেন তা-ই কুরআনুল কারীম।
তিন.
আল্লাহর বান্দাদেরকে পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেওয়া এবং তার প্রচার প্রসার করার কাজে নবীজি নিজের জীবন ব্যয় করেছেন। তাঁর নবুয়তের জীবনের ২৩ বছরের হাদীস সমূহ-ই হচ্ছে পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা। এই কুরআনুল কারীমকে প্রতিষ্ঠা করতেই নবীজি রক্ত ঝরিয়েছেন। দাঁত মোবারক শহীদ করেছেন। নবীজি জীবনে যত কষ্ট করেছেন তা তো কুরআনের জন্যই করেছেন।
চার.
পবিত্র কুরআন মহান আল্লাহ তায়ালার কালাম বা বাণী। আল্লাহ তাআলা যত বড় আল্লাহর কালাম বা বাণীও তত বড়। আল্লাহ তাআলার যে সম্মান, আল্লাহর কালামেরও একই সম্মান। যে কুরআনকে সম্মান করে সে যেন আল্লাহকে সম্মান করে। যে কোরআনকে অপমান করে সে যেন আল্লাহকে অপমান করে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন- যে আল্লাহর নিদর্শনাবলী কে সম্মান করবে সে তার অন্তরস্থ ভীতি থেকেই তা করবে। (সূরা আল হজ্ব, আয়াত নং ৩২)
এ কারণেই কুরআন মুমিনের ভালোবাসার সবচেয়ে বড় পাত্র। কুরআনের সম্মান মুমিনের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি। শুধু তাই নয়; সমগ্র জগৎ থেকে কুরআনের মর্যাদা অনেক বেশি। মুমিন নিজের জীবনের তুলনায় কোরআনকে বেশি ভালোবাসে। কুরআনের অবমাননা তাকে ভীষণ ব্যথিত করে। সে সব সহ্য করতে পারে; কিন্তু কুরআনের অবমাননার সংবাদ সহ্য করতে পারে না। ফলে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। বুঝে উঠতে পারে না কিছু। নিজের জীবনটাকে তখন ব্যর্থ মনে হয়।
পাঁচ.
যারা ইসলাম, কুরআন ও ইসলামের নবীকে নিয়ে অবমাননার কাজকর্ম করে তারাই মূলত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে। সমাজে বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তাদেরকে অবশ্যই কঠোর শাস্তির আওতায় আনা আবশ্যক। ইসলাম ধর্মে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাস্যদের নিয়ে উপহাস করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-
" আর আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদেরকে ডাকে তোমরা তাদেরকে গালি দিও না। কেননা তারা সীমলংঘন করে অজ্ঞতা বশত আল্লাহকে গালি দেবে। (সূরা আনআম, আয়াত নং ১০৮)
এ আয়াত দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায় কাফেরদের মিথ্যা দেব-দেবীকেও গালি দেওয়া নিষিদ্ধ। যেন তারা অজ্ঞতা বশত আমাদের আল্লাহ তায়ালাকে গালি দিতে না পারে। আল্লাহর নামের ইজ্জত রক্ষার্থে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই নির্দেশ দান করেছেন। তাহলে আল্লাহর কুরআন ও তাঁর নামের ইজ্জত রক্ষা করা আমাদের জন্য অতি আবশ্যক।
ছয়.
বর্তমানে আমাদের সামনে আল্লাহর কুরআনের ইজ্জত নষ্ট করা হচ্ছে। আল্লাহর কালাম কে অপমান করা হচ্ছে। যা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
তাই যারা বিনা উস্কানিতে কুরআনুল কারীমের অবমাননা করে, ইসলাম ও নবীজিকে নিয়ে ব্যঙ্গাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে খুব দ্রুত কঠিন শাস্তির আইন করা প্রয়োজন। অন্যথায় দেশে যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তখন এর দায়ভার রাষ্ট্রপ্রধানদেরকেই নিতে হবে।
সাত.
আসমানী কিতাব এমন এক ভালবাসার নাম যার জন্য জীবন দিয়েছে যুগে যুগে অসংখ্য অগণিত মানুষ। নিজেদের জীবন, যৌবন, অর্থ ও সম্পদ সবই উজাড় করে দিয়েছে এ আসমানী কিতাবের তরে। যেমন আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন- আর বহু নবী ছিলেন, তাদের সাথে বিরাট সংখ্যক আল্লাহ ওয়ালা লোক যুদ্ধ করেছেন। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তারা হীনবল হয়নি, দুর্বল হয়নি এবং নত হয়নি। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে ভালবাসেন। (সূরা আল ইমরান, আয়াত নং১৪৬)
বহু মানুষের মধ্যে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ . এর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। কুরআনের জন্য তাঁর সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষার কারণে তিনি আল্লাহ তাআলাকে একশতবার স্বপ্নে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। এমন সৌভাগ্য লাভ করার জন্য কোটি কোটি যুবক কেয়ামত পর্যন্ত প্রস্তুত আছে এবং থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
আট.
যারা আল্লাহর কালামকে অপমান করে, যারা আল্লাহর কালামের প্রতি বিদ্বেষ রাখে তাদের সমীপে দুটি কথা।
প্রিয় ভাই! আল্লাহর কালাম তোমার কি ক্ষতি করেছে? তুমি কি পড়ে দেখেছো এই কালামের মধ্যে আল্লাহ তাআলা তোমাকে কত মহব্বত ও ভালোবাসার সাথে ডেকেছেন! তোমার সুখ-শান্তি ও সফলতার পথে কত চমৎকারভাবে আহবান করেছেন! তুমি কি জানো না সে সকল মানুষের কথা, যাদের জীবনে পরিবর্তন এসেছে শুধু কুরআনের তেলাওয়াত শ্রবনের দ্বারা। শুধু তিলাওয়াত শ্রবণ করে ইসলামের ছায়াতলে এসেছে হযরত উমরের মত কত অসংখ্য অগনিত মানুষ, এর কি কোন হিসাব আছে? তুমিও তো একটু ওমরের মত কোরআন শ্রাবণ করতে পারো?
নয়.
প্রিয় ভাই! ইসলামের সূচনা লগ্নে যারা নবীজির ঘোরতর শত্রু ছিল তারাও কুরআনকে এভাবে অপমানিত করেনি। তারাও কোরআন তিলাওয়াত শ্রবণের প্রতি আকৃষ্ট ছিল। ইতিহাসের বই খুলে দেখো- হযরত আবু সুফিয়ান যিনি তখনও মুসলমান হননি, আবু জাহল ও আখনাস ইবনে শুরাইক রাতের আঁধারে পৃথক পৃথক ভাবে এসে নবীজির ঘরের কর্নারে দাঁড়িয়ে ভোর পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজে নবীজির পবিত্র মুখে কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করতো। সকালের আগেই মানুষের অগোচরে নিজ বাড়িতে চলে যেত। এভাবে একদিন তারা পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে গেল। প্রতিজ্ঞা করলো আর কোনদিন আসবেনা। তারপরও তারা এসেছে। কুরআনের তিলাওয়াত তাদেরকেও মুগ্ধ করেছে। যদিও তাদের দুজন ঈমান আনেনি।
প্রিয় ভাই! তুমি একটু কোরআন পড়ে দেখো। কুরআনের মায়া ও ভালবাসার চাদর অনেক বিস্তৃত। গোটা পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে স্থান দিতে পারে সে তার ছায়া তলে। তুমি কি একটু বুঝতে চেষ্টা করবেনা? তুমি কি নিজের জন্য একটু ছায়া খুঁজবে না?
দশ.
পরিশেষে প্রভুর দরবারে ফরিয়াদ! হে দয়াময়! কুরআনের দ্বারা তুমি যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দাও, যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্টতার উপর ছেড়ে দাও। কাউকে তুমি সম্মানের উচ্চাসনে আসীন করো আবার কাউকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করো। সবই তোমার ইচ্ছা হে প্রভু। তোমার কাছেই ফরিয়াদ! আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করো। আমাদের জীবন, যৌবন, অর্থ, সম্পদ ও সময় সবকিছু কুরআনের জন্য কবুল করো।
লেখক:সিনিয়র শিক্ষক, লালবাগ মাদ্রাসা
খতিব, আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ। পরিচালক, দাওয়াতুস সুন্নাহ বাংলাদেশ