বিশেষ প্রতিনিধি
মাত্র ছয় মাস আগের কথা। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের পুরানা পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ছুটে আসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে কাটান বেশ কিছু সময়। বিএনপি মহাসচিবের মাথায় পরিয়ে দেওয়া হয় পাঁচকল্লি টুপি। সবার সঙ্গে জোহরের নামাজে অংশও নেন মির্জা ফখরুল। ইসলামী আন্দোলনের আমির ও পীর সাহেব চরমোনাই মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দুপুরের খাবার খান। স্বৈরাচারমুক্ত নতুন বাংলাদেশে দুই দল একসঙ্গে কাজ করবে এবং সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ কোনো দলের নেতাকর্মীরাই করবেন না- এমনটা সমঝোতাও হয় তাদের মধ্যে।
কিন্তু ছয় মাস যেতে না যেতেই চিত্রটা সম্পূর্ণই ভিন্ন। রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ১৪ জুলাই দলীয় সমাবেশ থেকে প্রকাশ্যে পীর সাহেব চরমোনাই ও ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয়। তাদের দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমান সম্পর্কে কটূক্তি করা হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে এসব স্লোগান দেন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এমনকি বিএনপির নগরের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাম ধরে পীর সাহেব চরমোনাইয়ের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীদের উস্কানি দেন। শুধু নয়াপল্টনই নয়, এদিন সারাদেশেই বিএনপির কর্মসূচি থেকে ইসলামী আন্দোলন, জামায়াত-শিবির ও নতুন দল এনসিপির বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপি বনাম অন্য দলগুলোর নেতাকর্মীদের ‘যুদ্ধ-বাহাস’ চলছে। তবে বেশি আলোচনায় এসেছে বিএনপি ও ইসলামী আন্দোলনের বিরোধটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের এই বিরোধ অনেক পুরনো। নব্বইয়ের দশকে তৎকালীন মরহুম পীর সাহেব চরমোনাই মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীমের নেতৃত্বাধীন শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু থেকে ইসলামী ঐক্যজোটে ছিল। তবে ১৯৯৯ সালে ইসলামি দলগুলোর সমন্বিত জোট ইসলামী ঐক্যজোট সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে অংশ নেবে। তখন চরমোনাইয়ের মরহুম পীর নারী নেতৃত্বের অধীনে কোনো জোটে যাবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। ফলে অন্যান্য ইসলামি দল বিএনপি জোটে গেলেও পীর সাহেব চরমোনাই সেই জোটে যাননি। দলটির এই সিদ্ধান্তকে বিএনপি ভালোভাবে নেয়নি। ফলে শুরু থেকেই বিএনপি পীর সাহেব চরমোনাই ও তার দলের নানাভাবে বিরোধিতা করে আসছে।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অন্যান্য ইসলামি দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের হয়ে নির্বাচন করলেও চরমোনাইয়ের মরহুম পীর সাহেব জোট করেন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে। ওই বছরের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি জোট দুই তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জোট তেমন একটা ভালো করতে পারেনি। ওই নির্বাচনে বরিশাল-৫ (সদর) আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতা এবং সাবেক এমপি ও মেয়র মজিবুর রহমান সরওয়ার। ওই আসনে তখন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী ছিলেন পীর সাহেব চরমোনাইয়েরই এক সন্তান। নির্বাচনের দিন বিএনপির সঙ্গে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সংঘর্ষে বিএনপির প্রার্থী মজিবুর রহমান সরওয়ার আহত হন। বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার পর মামলা-হামলা ও জেল-জুলুমের শিকার হন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। কারাগারে যেতে হয় তাদের। পরে অবশ্য চরমোনাইয়ের মরহুম পীর সাহেব মজিবুর রহমান সরওয়ারসহ স্থানীয় বিএনপির সঙ্গে বিষয়টি মিটমাট করে নেন।
তবে সেই যে বিরোধ সেটা দুই দলের কেউই ভুলতে পারেনি। আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলেও ইসলামী আন্দোলনের নেতারা নানাভাবে বিএনপির সমালোচনা করেছেন। কারণে-অকারণে তাদের খোঁচা দিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপিও দলটির গায়ে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠতার তকমা দেওয়ার নানা চেষ্টা করে এসেছে। অন্যান্য মহল থেকেও বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ-প্রীতির অভিযোগ ওঠেছে। তবে এর দালিলিক প্রমাণ কেউই দিতে পারেননি। তারা বরাবরই এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিএনপি প্রথমে ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য ইসলামি দলকে নিজের কাছে ভেড়ানোর চেষ্টা করেছে। এই আহ্বানে কেউ কেউ সাড়া দিলেও পীর সাহেব চরমোনাইয়ের নেতৃত্বাধীন দলটি সেটা দেয়নি। বরং উল্টো অতীতের তিক্ততা ভুলে ইসলামী আন্দোলন বিএনপির বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। দুই দলের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হওয়ার বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার। এই অবস্থায় বিএনপি নতুন করে ইসলামী আন্দোলনকে তাদের শক্রজ্ঞান করা শুরু করেছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ‘চাঁদাবাজের হোতা’ হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস ইসলামী আন্দোলন থেকে করা হয়েছে। এজন্যই তারা দলটির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে।
এমএইচ/