|| শাব্বির আহমাদ খান ||
ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য নিয়ে আলোচনা নতুন কিছু নয়। এই ঐক্যের ডাক বহুবার শোনা গেছে। কিন্তু প্রতিবারই শেষ পর্যন্ত হতাশ হতে হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত ঐক্য গড়ে ওঠেনি। তবে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের কাছাকাছি এসেছে। ভোটের মাঠে ‘এক বাক্সে ভোট’ দেওয়ার চিন্তা চলছে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, দলগুলো ততই নিজেদের সাংগঠনিক কাঠামো গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে—এবারও কি সেই পুরোনো অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হবে? নাকি ইসলামি ঐক্য সত্যিই বাস্তবে রূপ নেবে? আনুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের ব্যাপারে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। এটা ঐক্যের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে কি না সেটা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। তবে যারা পিআর পদ্ধতির পক্ষে তারা বলছেন, এটা বাধা নয় বরং নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে।
আওয়ার ইসলাম এই প্রশ্ন নিয়ে কথা বলেছে কয়েকটি ইসলামি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ঐক্য ভেঙে যাবে—এমন কথা ঠিক নয়। বরং পিআর পদ্ধতি হলে ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের সম্ভাবনা আরও বাড়ে। কারণ, আমাদের দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের হলেও ইসলাম নিয়ে কাজ করতে চায়। তাই আলাদা দল থাকলেও ঐক্য সম্ভব। যারা পিআর পদ্ধতির বাহানা করে ঐক্য থেকে সরে যেতে চায়, প্রশ্ন হলো—পিআর না হলে তারা কি ঐক্যে থাকবে?’
গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আমাদের অতীতেও ঐক্যের নজির আছে। ১৯৭৮ সালে ইসলামি দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ১৯৯১/ ৯৬ সালের নির্বাচনে ইসলামি ঐক্যজোট গঠিত হয়েছিল। যেমন ঐক্যের ইতিহাস আছে, তেমনি কিছু বিচ্ছিন্নতার ঘটনাও আছে। তবে এখন মানুষ চায় ঐক্য। সেই প্রত্যাশা পূরণে আমরা আবারও ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছি।’
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি বলেন, ‘ঐক্য নিয়ে আমরা এখনো আশাবাদী, আশা হারাইনি। আমরা একটি বাক্সভিত্তিক চিন্তা ও দর্শন নিয়ে নির্বাচনী ঐক্যের পথে অগ্রসর হয়েছিলাম। কিন্তু পিআর পদ্ধতি সামনে আসায় সেই এক বাক্সভিত্তিক ঐক্য আর থাকে না। কারণ, পিআর পদ্ধতি এবং এক বাক্সে নির্বাচন—এই দুটি ধারণা একে অপরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখানে বিভ্রান্তির কিছু নেই। যেখানে দুটি জিনিস পরস্পরবিরোধী, সেখানে সমন্বয় করা জরুরি। এটা হতে পারে না যে, দাবি মেনে নিলে সবাই পিআর পদ্ধতিতে গিয়ে নিজ নিজ মার্কা নিয়ে নির্বাচন করব, আর না মানলে এক বাক্সে ঐক্যবদ্ধ থাকব। এটা কোনো গ্রহণযোগ্য ঐক্যের ফর্মুলা হতে পারে না।’
মাওলান আফেন্দী বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, সমমনা ইসলামি দলগুলো যেন একসঙ্গে বসে আলোচনা করে। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ানো দরকার। পিআর পদ্ধতি ও এক বাক্স নির্বাচন—এই দুটি ভিন্ন বিষয় এবং পরস্পর সাংঘর্ষিক। আমাদের উচিত ছিল এক হয়ে বসে এই বৈপরীত্যের সমাধান করা। কিন্তু আমরা তা পারিনি, এটিই আমাদের ব্যর্থতা।’
তিনি বলেন, ‘সবশেষে একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই—'পিআর পদ্ধতির কারণেই ঐক্য নষ্ট হচ্ছে'—এমন কোনো শিরোনাম আমি বা আমার দল সমর্থন করি না। আমরা দেওবন্দি চিন্তাধারার ইসলামি দলগুলো একসঙ্গে বসতে চাই, আলোচনা করতে চাই। আমরা এখনো ঐক্যের বিষয়ে আশাবাদী।’
খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী বলেন, ‘আলোচনা বিষয়টা এমনই—কখনো জোরেসোরে চলবে, কখনো আবার ভাটা পড়বে। এটাই আলোচনার স্বাভাবিক চরিত্র। জনগণ যেভাবে আমাদের চায়, আমরা রাজনৈতিক দলগুলো সেভাবে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারিনি। তবে আমরা আশাহত হইনি। এখনো আশাবাদী যে ভালো কিছু হবে।’
পিআর (প্রতিনিধিত্বমূলক অনুপাতভিত্তিক) পদ্ধতি নিয়ে খেলাফত মজলিসের অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে খেলাফত মজলিস থাকবে, না-হয় থাকবে না—এমন কোনো বক্তব্য আমরা দিইনি। পিআর পদ্ধতিতে হলেও আমরা আছি, আগের পদ্ধতিতেও আমাদের সমস্যা নেই। জনগণ যে পথে খুশি হবে, আমরাও সেই পথেই হাঁটব।’
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন এ বিষয়ে বলেন, ‘বিষয়টা এখনো আলোচনা পর্যায়ে আছে। উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি নিয়ে সকল দল একমত হলেও, নিম্নকক্ষে এখনো কিছু দল আপত্তি জানাচ্ছে। যদি পিআর পদ্ধতি হয়, তবে জোট ও কৌশল নতুন করে ভাবতে হবে। আর যদি আগের নিয়মেই নির্বাচন হয়, তাহলে আগের আলোচনামতোই ইসলামি দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকবে।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘কিছু দল পিআর পদ্ধতি চায়, কিছু দল চায় না। তবে শেষ পর্যন্ত সবাই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। যতদিন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত না হচ্ছে, ততদিন আসলে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
এসএকে/