শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫ ।। ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ১৭ মহর্‌রম ১৪৪৭

শিরোনাম :

শায়খ আব্দুস সালাম: ইলমের এক উজ্জ্বল মিনার

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইনজামামুল হক

বাংলাদেশের ইসলামি জ্ঞানচর্চা, শিক্ষকতা ও হাদিস চর্চার জগতে মুফতি আব্দুস সালাম এক প্রাজ্ঞ, বিদগ্ধ ও নীরব কর্মবীর। আলেম সমাজে তিনি শুধু একজন মুহাদ্দিস বা শিক্ষক নন—তিনি ইলমের এক উজ্জ্বল মিনার হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে দীন ও ইলমের খেদমতে তাঁর অবদান দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আওয়ার ইসলামের দর্শকদের জন্য তুলে ধরা হলো তাঁর জীবনের শিক্ষামূলক, পেশাগত এবং সামাজিক অবদানের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র।

শৈশব ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট

মুফতি আব্দুস সালাম ১৯৭০ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার উত্তর আমিনবাজার ইউনিয়নের উত্তর কাউন্দিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আলহাজ্ব হাফেজ মাওলানা আবু তাহের এবং দাদা জনাব আব্দুর রহমান। পারিবারিক ধর্মীয় পরিবেশেই তাঁর শৈশব কাটে। তাঁর বাল্যশিক্ষার হাতেখড়ি হয় মায়ের কাছে, যিনি নিজেও ছিলেন একজন শিক্ষিতা ও মহীয়সী নারী।

শিক্ষাজীবনের দীপ্ত যাত্রা

প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার পর তিনি ভর্তি হন ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জামিয়া হোসাইনিয়া আরজাবাদ মাদরাসায়। সেখানে মক্তব বিভাগ থেকে শরহে জামি পর্যন্ত অসাধারণ ফলাফলের মাধ্যমে পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯৮৫ সালে তিনি জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ফজিলত, দাওরায়ে হাদিস (স্নাতকোত্তর) সম্পন্ন করেন।

তিনিই সেই সৌভাগ্যবান শিক্ষার্থী, যিনি এই তিনটি বিভাগেই বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। ইলমপিপাসু হয়ে তিনি ১৯৯২ সালে ভারতের ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দে গমন করেন। সেখানে তিনি তাকমিল জামাতে প্রথম বিভাগে (মুমতাজ) দ্বিতীয় এবং ১৯৯৩ সালে ইফতা বিভাগেও প্রথম বিভাগে (মুমতাজ) তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। এতে তাঁর ফিকহ ও ইলমের গভীরতা স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়।

শুধু তাই নয়—তিনি আধুনিক শিক্ষার প্রতিও ছিলেন মনোনিবেশী। বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কামিল (ফিল হাদিস), কামিল (ফিল ফিকাহ) ও কামিল (ফিত তাফসির) পরীক্ষায় যথাক্রমে ৭ম, ৩য় ও ২য় স্থান অর্জন করেন। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর থেকে এম.এ পরীক্ষায়ও প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অর্জন করে নিজের বহুমাত্রিক একাডেমিক সক্ষমতা প্রমাণ করেন। এছাড়াও ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন ও শিক্ষাদান

দাওরায়ে হাদিস শেষ করার পর ১৯৯৪ সালে তিনি যশোর জামিয়া ইসলামিয়ায় সিনিয়র মুহাদ্দিস হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৯৫ সালে ঢাকার তাঁতীবাজার জামিয়া ইসলামিয়াতে সিনিয়র মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন। ২০০৬ সনে জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে সিনিয়র মুহাদ্দিস ও প্রধান মুফতি হিসেবে যোগদান করেন, আজ অব্দি তিনি এই প্রতিষ্ঠানে ইসলামি জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন। তাঁর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন হাজার হাজার তালিবে ইলম, মুফতি ও জ্ঞান পিপাসু মানুষজন, যাঁরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে ছড়িয়ে আছেন।

তিনি উপমহাদেশের মহাপুরুষ শাইখুল আরব ওয়াল আজম সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানীর শিষ্য মুহাদ্দিসে আজিম, শায়খুল হাদিস কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহ.-এর একান্ত স্নেহভাজন শাগরেদ এবং শায়খুল হাদিস আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী রহ.-এর প্রিয় ছাত্র ও শাগরেদ।

অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক খেদমত

শিক্ষাদানের পাশাপাশি তিনি আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। নয়টাটোলা এ.ইউ.এন. কামিল মাদরাসায় তিনি হেড মুহাদ্দিস হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদের ইমাম ও খতিব, যেখানে তাঁর জুমার খুতবা ও বয়ান সমাজের মানুষের মাঝে দ্বীনি জ্ঞান ছড়াচ্ছে।

এছাড়াও দেশের প্রথম সারির চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত বিভিন্ন ইসলামি অনুষ্ঠানে জীবনঘনিষ্ঠ প্রশ্নের শরয়ি সমাধান দিয়ে থাকেন এবং ইসলামি পডকাস্টে আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন।

লেখালেখি ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

মুফতি আব্দুস সালাম একজন প্রাজ্ঞ লেখকও। তিনি প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মৌলিক গ্রন্থ ও অনুবাদের মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষাকে সহজভাবে মানুষের মাঝে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

* স্বামী-স্ত্রীর অধিকার

* দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় দোয়া

* খুতবাতুল আহকাম (অনুবাদ)

এছাড়াও হাদিস গ্রন্থ মিশকাত শরিফের অনুবাদকও তিনি। ২০০৩ সালে তিনি আন্তর্জাতিক তাফসীর প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে ইরানের রাজধানী তেহরান যান এবং সেখানে গৌরবের সাথে তৃতীয় স্থান অর্জন করে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেন। এ অর্জন তাঁর আন্তর্জাতিক মানের ইলম ও গভীরতা তুলে ধরে।

শায়খ মুহাদ্দিস মুফতি আব্দুস সালাম কেবল একজন আলেম নন, তিনি ইলম, আমল, খেদমত ও আদর্শিক নেতৃত্বের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি অর্জন নতুন প্রজন্মের আলেমদের জন্য দিকনির্দেশনা স্বরূপ। যাঁর কলম, যাঁর কথা, যাঁর ক্লাস—সমাজে দীনের আলো ছড়াচ্ছে নীরবে নিভৃতে গভীরে।


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ