|| মুহাম্মদ উমারা হাবীব ||
কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের সিরাত সাহিত্যের দিকপাল, বাংলা ভাষার অন্যতম পথিকৃৎ সাহিত্যিক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. সম্পর্কে। একজন জিজ্ঞেস করলেন, মুসলিম জাহান টিকল না কেন? বললাম এই প্রশ্ন তো আমারও। হয়তো টিকিয়ে রাখার মতো মানুষ নেই। উত্তর পুরুষেরা ধরে রাখতে পারেনি। এর চেয়ে বেশি কিছু বিশ্লেষণ করার ছিল না। বাংলাদেশে বরাবর যে ঘটনাটি ঘটে, প্রতিভাধর ব্যক্তির যোগ্য উত্তরসূরি থাকে না। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়ার এটিও একটি জায়গা।
আমাদের আলোচনায় আরও একটি নুকতা উঠে এলো। আজকাল কেউ কেউ বলে থাকেন যে, বাংলাদেশে ধর্মীয় অঙ্গনে বাংলা সাহিত্যের চর্চা ছিল না। নব্বইয়ের দশকে হজরত আলী মিয়া নদবী রহ. বাংলাদেশে এলেন। আর বাংলা সাহিত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বক্তব্য দিলেন। এরপরই এদেশে ধর্মীয় শিক্ষিতদের মাঝে বাংলা সাহিত্যের জয়জয়কার পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। এই কথাটি অনেকাংশেই সত্য নয়। প্রশ্ন তৈরি হয়- তাহলে পাকিস্তান আমলে মাওলানা আতহার আলী রহ. দশম শ্রেণি পর্যন্ত জেনারেল সাবজেক্ট বাধ্যতামূলক করার ইতিহাস কোথায় লুকাব? মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এর রচনাবলি কোথায় ছুপায়ে রাখব? মাওলানা নুর মোহাম্মদ আজমীর কলমের কালি কোথায় মিলিয়ে যাবে? আর তাদেরই গুণী ও কৃতি উত্তরসূরি মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের একাই এক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার গল্প কি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে?
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছাত্রজীবন থেকেই যে সাধনায় নিমগ্ন হয়ে ছিলেন মায়ের আদেশে, জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে সেই সাধনার ডালপালা ছড়িয়ে নানা রঙে রঙিন হয়ে বর্ণিল আকাশের মালিক হয়েছিলেন। ভাবি - মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ-এর এই বর্ণিল আকাশের অগণিত মুগ্ধকর নক্ষত্রগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেল!
মাসিক মদীনার সেই পাঠক প্রিয়তা আজও টিকে আছে? জানি দীর্ঘ সত্তর বছর কোনো মাসিক ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের এই সম্ভবত প্রথম ও বিরল ইতিহাস বাংলাদেশে।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর জীবনের মূল্যায়ন তার জীবদ্দশায় কতটুকু করেছি আমরা? আর তিনি চলে যাওয়ার এই এক দশকে কী করেছি! বেঁচে থাকতে যিনি একাই এক কাফেলা হয়ে উঠতেন চলতে ফিরতে। শত শত মানুষকে কাজে লাগিয়ে জীবনের ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন। যেখানে বসতেন মজলিস গুলজার হয়ে যেত। তাঁরই ইন্তেকালের পর এই এক দশকে তাকে নিয়ে বিশেষ কোনো আয়োজনের কোথাও কেউ নেই। যেন চারদিকে সুনসান নীরবতা। এই নীরবতা কেন? খান সাহেব প্রচলিত ধারার কোনো পীর শায়েখ বা হাজার হাজার ছাত্র বিশিষ্ট বাহ্যত গুণধর শিক্ষক ছিলেন না, তাই?
খান সাহেবের পুরো জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এদেশের প্রতিটি ইসলামি অঙ্গনে তার উপস্থিতি ছিল স্বপ্রণোদিত ও স্বতঃস্ফূর্ত হিতৈষী হিসেবে। কোনো মুখ রক্ষার কাজ জীবনে করেননি। একজন মানুষের নিষ্ঠাবান হওয়ার এর থেকে উজ্জ্বল প্রমাণ আর কী হতে পারে!
রাজনীতি করেছেন, কর্মীরা তাঁর ছাত্র ছিল না। সময়ে অসময়ে বাতিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন , নিজেই নিজের অভিভাবক ছিলেন। রুহানিয়াতের উচ্চ মার্গে অধিষ্ঠিত ছিলেন, পীর মুরিদি করেননি। কলম হাতে এক শূন্য মরুভূমিকে ফুলে ফলে সুশোভিত মরুদ্যানে রূপায়িত করেছেন, পাঠকরা তার মুরিদ বা ছাত্র ছিল না। এই হলো খান সাহেব রহ.।
বিপুলা যার সৃজন, সেই খান সাহেব এমন অনবদ্য কিছু কালির দাগ রেখে গেছেন পাঠক হৃদয়ের জন্য, যা অমৃতের মতো পান করেও তৃষ্ণা মেটে না।
বিংশ শতকের যুদ্ধমুখর পরিবেশে জন্ম নেওয়া খান সাহেব পুরো শতাব্দীর ইসলামি স্বাধীনতাকামী সংগ্রামী রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহন করেন। সাংস্কৃতিক তামাদ্দুনিক লড়াইয়েও খান সাহেব অগ্রপথিক, এমনকি পুরোধায় পরিণত হয়েছিলেন। মুসলিম বাংলার সাহিত্য ধারার তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ বাহক ও রচয়িতা। পুরো শতাব্দীজুড়ে মুসলিম বাংলার ধর্মীয় অঙ্গনের প্রভাবশালী জ্ঞানে গুণে সমৃদ্ধ ও স্বীকৃত মনীষীদের সান্নিধ্যের সফল সৌরভে ছিলেন মোহিত। ফলে একটা সময়ে খান সাহেব হয়ে উঠেছিলেন সকল ধারার ইসলাম ঘণিষ্ঠ মানুষের সাংস্কৃতিক তামাদ্দুনিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।
খান সাহেবের কোন বইটি আমার পাঠ্যে প্রথম এসেছে তা আজ আর খেয়াল নেই। তবে খান সাহেবের যে বইটি আমি একাধিক কপি সংগ্রহ করেছি- স্বপ্নযোগে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম - হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ভালোবাসা উজাড় করে খান সাহেব এই বই রচনা করেছেন। কেন? প্রতিটি স্বচ্ছ হৃদয়ের অধিকারী মুসলমানের প্রিয়তম হাবীব মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার স্বপ্নযোগে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, পরকালে তার সুপারিশ লাভ করার অদম্য লোভ সংবরণ না করতে পেরে। যে বিশ্বাস ও ভক্তি নিয়ে এই বই তিনি রচনা করেছেন, তাতে তাঁর আধ্যাত্মিক উচ্চতাও টের পাওয়া যায় বৈকি।
কতটা বেলায়েতপ্রাণ ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘দরবারে আওলিয়া’, ‘হৃদয়তীর্থ মদীনার পথে’ এবং ‘ ইসলামী তাসাউফের স্বরুপ ’ ইত্যাদি মৌলিক ও অনূদিত গ্রন্থে ।
সিরাতের যে বিপুল পাঠ সামগ্রী, তা যদি হিসাব করা হয় তাহলে দেখা যাবে খান সাহেব একাই দশজন দশহাতে কাজ করা মানুষের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন এক্ষেত্রে। তাঁর পাঠকপ্রিয় ও সুখপাঠ্য বিখ্যাত আত্মজীবনী ‘জীবনের খেলাঘরে’ তিনি লিখেছেন, ‘ দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিরাত সম্পর্কিত যেকোনো মূল্যবান উপাদান পাওয়া যায় তা কুড়িয়ে এনে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের খেদমতে হাজির করায় মাসিক মদিনার সর্বাপেক্ষা বড় সাধনা।’ তিনি তাঁর কথার সার্থকতা পূর্ণরূপে রক্ষা করেছেন। ফলে তাঁর সীরাত বিষয়ক মৌলিক ও অনূদিত গ্রন্থের তালিকায় ‘ওয়াসওয়ায়ে রাসুলে আকরাম সা.’ ‘প্রিয় নবীজির (সা.) অন্তরঙ্গ জীবন’ ‘প্রিয় নবীজির প্রিয় প্রসঙ্গ’ ‘শাওয়াহেদুন নবুওত’ ‘ স্বপ্নযোগে রসুলুল্লাহ’ ‘হৃদয়তীর্থ মদিনার পথে’ ‘সীরাতুন নবী’ ‘ রওজা শরীফের ইতিকথা’ ‘ হাদীসে রাসূল’ ‘সীরাতে রসুলে আকরাম’ ‘খাসায়েসুল কুবরা’ ‘জীবন সায়াহ্নে মানবতার রূপ’র মতো জগত বিখ্যাত সীরাতের গ্রন্থগুলো যুক্ত হয়ে বাংলা ভাষার সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
আজকাল যখন ইসলামি বই মার্কেটে বিপুল পরিমাণে নতুন চাঁদ তারার আগমন লক্ষ্য করি। মনে পড়ে, খান সাহেবের কথা। ইসলামি ধারার কলম সৈনিকদের বড় একটি গোষ্ঠীই খান সাহেবের সরাসরি সান্নিধ্য প্রাপ্ত শাগরেদ। মাওলানা উবায়দুর রহমান খান, মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ থেকে শুরু করে বর্তমানের তরুণ লিখিয়েদের এক জামাতও তাঁর সোহবতপ্রাপ্ত। যা এই তরুণদের জীবনের অমূল্য গৌরব।
ইসলামি বই মার্কেটে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় এমনকি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বইপত্র রচিত হচ্ছে বিপুল। দরকারি বইয়ের তালিকা খুঁজতে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি, খান সাহেব একাই যে বিশাল রচনা ভাণ্ডার রেখে গেছেন বিষয় বৈচিত্র্যে এবং কাজের কাজ হিসেবে তাকে কেউ অতিক্রম করতে পারছে না।
তাফসিরে মাআরেফুল কুরআনের মতো উপমহাদেশীয় জগৎ বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থকে বাংলা ভাষাভাষী সব দেশের পাঠকের কাছে জনপ্রিয় ও সমাদৃত করেছেন। এটি তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব। যেমন তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব ছিল সিরাত সাহিত্যকে বাংলা ভাষায় বিপুলভাবে সমৃদ্ধ করা। কুরআনকে মানুষের কাছে হৃদয়ঙ্গম করতে তিনি লিখেছেন ‘কুরআন পরিচিতি’ ‘কুরআন ও আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গ’। হাদিস ও হাদিস সংক্রান্ত বিষয়াবলিতেও তাঁর কলম ছিল অকৃপণ। অনুবাদ করেছিলেন ‘তাজরীদুল বুখারী’ ‘হাদীসে রাসুল’।
ইসলামের বিধি বিধানের সঠিক শিক্ষা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে সহজ করতে তিনি লিখেছেন, তালীমুস সালাত, তালীমুল হজ, আহকামে রমযান , হজ কোরবানি জেহাদ প্রসঙ্গ, মুমিনের জীবন যাপন পদ্ধতি, আকায়েদে ইসলাম ইত্যাদি। পৃথিবীখ্যাত মুসলিম মনীষীদের জীবনী ও রচনাবলীও তিনি এদেশের মানুষের কাছে পরিচয় করিয়েছেন। অনুবাদ করেছেন, বিপ্লবী সাহাবী হযরত আবু যার গিফারী , ইমাম জয়নুল আবেদীন, আল ফারূক, ইমাম গাজালীর সীরাতুল মুস্তাকীম, এহইয়াউ উলুমিদ্দীন, মাকতুবাতে গাজালী, শহীদ হাসানুল বান্নার রচনাবলি, চেরাগে মুহাম্মদ ইত্যাদি।
উপমহাদেশে আমাদের বিপ্লবী ও সংগ্রামী ঐতিহ্যকেও তিনি তুলে ধরেছেন। লিখেছেন, ঈমানের দীপ্ত মশাল বালাকোট, আযাদী আন্দোলন ১৮৫৭।
মুসলিম উম্মাহর আদর্শস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের অমিয় বাণী সম্ভারের এক অসাধারণ সিরিজ তিনি লিখেছেন। ‘কুড়ানো মানিক’ নামে সেই বই আট খণ্ডে প্রকাশিত। তাছাড়াও এই বিষয়ে তাঁর আরো রচনা রয়েছে। এই সমস্ত রচনাবলি ছাড়াও বিবিধ বিষয়ে তার রচনা বিপুল, যার সবই দরকারি কাজ। খান সাহেব বিলাসী রচনায় হাত দেননি বললেই চলে। মাসিক মদীনায় দীর্ঘ ষাট বছর তিনি উদার হস্তে লিখেছেন। তাঁর সম্পাদকীয় কলামের বিশেষ খ্যাতি ছিল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মদীনা পাবলিকেশান্স থেকে মুসলমানদের জীবন ঘনিষ্ঠ বইপত্র ছেপেছেন ছয় শতাধিক। একক কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য এই সংখ্যা অবশ্যই ঈর্ষণীয়।
তাঁর আত্মজীবনীর কথা না বললেই নয় । দ্বিতীয় খণ্ডের প্রকাশ কোন হুতুম পেঁচার কারণে আটকে আছে জানি না।
পরিশেষে খান সাহেব ছিলেন ইসলামি ধারার পণ্ডিত আলেম, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও ইসলামি ভাবধারার সাহিত্যিকদের সম্মিলিত কাফেলার যোগ্য উত্তরসূরি। এমন বিরল কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব দ্বিতীয় আরেকজন পাবো কোথায়?
খান সাহেব রহ. এখন আমাদের ভুবন থেকে অনেক দূরে। দুনিয়ার সম্মান খ্যাতি তাঁর আর কাজে আসবে না। তবে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রয়োজনে যে বিরাট লিখনযজ্ঞ আঞ্জাম দিয়ে গেছেন , সেসব যদি পুনরায় আধুনিক ছাপার অক্ষরে ছেপে আসে। সদকায়ে জারিয়া হিসেবে খান সাহেবের রূহ শান্তি পাবে। নষ্ট রাষ্ট্রের ভ্রষ্ট কর্তাদের সমীপে খান সাহেবের প্রাপ্ত সম্মানের আলাপ তুলে লাভ কি!
বাংলা ভাষার এই স্বতন্ত্র ও চিরায়ত শাখাটি সমৃদ্ধ করার ফলে খান সাহেব একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত নন?
লেখক: মাদরাসা শিক্ষক, তরুণ লেখক ও গবেষক
এনএইচ/