বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫ ।। ১৯ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ৮ মহর্‌রম ১৪৪৭

শিরোনাম :

কওমি শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে- তাদেরও কিছু বলার ও করার আছে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতী মুঈনুল ইসলাম

কওমি মাদরাসার ছাত্রদের প্রকৃত দেশ সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এটি এখন খুবই জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জন্মসূত্রে এদেশ তাদের, তারা কারো দাস কিংবা মজদুর নন, এ ধরনের মনোভাব তাদের মধ্যে তৈরি করা খুব দরকার। 

সাধারণত মাদরাসাসমূহে নিঃশর্ত আনুগত্যের প্র্যাকটিস চলে। এ ধরনের মানসিকতা অনেক সময় শরিয়তের গণ্ডি অতিক্রম করে যায়। আর এই অনুশীলনের প্রভাব পড়ে বাস্তব জীবনে। এজন্য শরিয়তসম্মত, বাস্তবসম্মত ও ন্যায়সঙ্গত আনুগত্যের অনুশীলন তাদের মধ্যে যথাযথভাবে চালু করা দরকার। অবশ্য এ কথাও তাদেরকে শেখানো হয় যে, 'কোনো সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না, স্রষ্টার নাফরমানি করে।'

বাস্তব ক্ষেত্রে সাধারণত উল্লিখিত উক্তির বাস্তবায়ন পাওয়া যায় শতকরা হারে অনেক কম। অতএব, একজন কওমি শিক্ষার্থীকে বোঝাতে হবে যে, ন্যায় কথা যথাযথ আদবের সাথে বলা তার অধিকার, প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা তার অধিকার, দেশের সম্পদে তারও ভাগ আছে, দেশের সকল ব্যাপারে ভালো-মন্দ বলার অধিকার তারও আছে। হ্যাঁ, এসব ভালোভাবেই তাকে শিখাতে হবে। 

জি হ্যাঁ, এসব প্রশ্ন করতে ও এসব শিখানো তাঁর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে জরুরি। অন্তত তাকে এটা বোঝানো যে, এই দেশে আপনারও কিছু বলার আছে, করার আছে অনেক কিছু।

বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, বাংলাদেশের বাণিজ্যিক পলিসি, বাংলাদেশের ফরেন বাণিজ্যিক পলিসি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে জালালাইন, মিশকাত, দাওরা ও তাখাসসুস এর ক্লাসগুলোতে নির্ধারিত বিষয়ে তাদের ধারণা থাকা দরকার। এখন উল্লিখিত বিষয়সমূহের ওপর নিয়মিত দরস এসব ক্লাসে অপরিহার্য করে দেওয়া দরকার।

বাংলাদেশে মোট মন্ত্রণালয় কয়টি, সে সম্পর্কে তাদের জানার হক আছে। অফিস আদালত সম্পর্কে জানা, কোন অফিসের কী কাজ, কোন ডিপার্টমেন্ট কী সেবা প্রদান করে, এসব তাদের জানা দরকার।

সরকারি অফিসসমূহের কর্মকর্তা ও কর্মচারী মানেই আমাদের শাসক, এই মনোভাব না জানা থেকেই তৈরি হয়ে আছে। নাগরিক অধিকারসমূহ তাদেরও জানা দরকার। নয়তো এতো হীনম্মন্যতা তৈরি হয় যে, ‘চৌকিদারকে’ স্যার বলবে না কী বলবে, তাতেও তাদের দ্বিধা হবে। এখন আমাদের মাদরাসার ছেলেদের কেউ কেউ পুলিশ কনস্টেবল দেখলেও কখনো হাক্কা বাক্কা খেয়ে যায়। 

দয়া করে কিছু মনে করবেন না, আমাদের পরিবার  বড়। আমাদের ভাইদের মধ্যে অতিরিক্ত সচিবও আছেন। এজন্য আমি একজন অতিরিক্ত সচিবকে শ্রদ্ধার সাথে আমার বড়ভাই মনে করি। আমাদের পরিবারে কয়েকজন ডাক্তার আছেন। আমাদের এক ভাই একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল। এজন্য একজন চিকিৎসক মহোদয়কে আমি শ্রদ্ধার সাথে বড় ভাই কিংবা অত্যন্ত স্নেহের সাথে ছোট ভাই মনে করি। আমার এক ছোট ভাই অতিরিক্ত আইজিপি। এজন্য আমি এই পদের এবং এর নিচের পদের পুলিশ কর্মকর্তাদেরকে অত্যন্ত স্নেহের সাথে ছোট ভাই মনে করি। সাথে সাথে তাঁদের অফিসিয়াল পদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাবোধ, ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের  প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন এর বিষয়টিও আমি একান্ত দায়বদ্ধতা থেকেই অনুধাবন করি।

কওমি শিক্ষার্থীদের কমনসেন্সের প্র্যাকটিস করানো দরকার। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্র্যাকটিস না থাকলে ব্যক্তি, পরিবার ও সামগ্রিক জীবনে পেছনে থাকতে হয়। আত্মমর্যাদা বোধ শেখানো না হলে নেতৃত্বের বিকাশ হওয়া তো দূরের কথা, নিজের মতামতও প্রকাশ করার সাহস থাকে না। 

এই বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠান খেয়াল করলে এবং তাদের শিক্ষক মহোদয়গণকে প্র্যাকটিস করালে অনেকাংশে উপকার পাওয়া যাবে।

পাবলিক রিলেশন বা পি আর সম্পর্কে তাদেরকে ও আমাদের আসাতিযায়ে কেরামকে ন্যূনতম ধারণা প্রদান করা দরকার। পাবলিক রিলেশন বা পি আর কিন্তু ইসলামের প্রাণ। একজন নবী বা নায়েবে নবীর অন্যতম প্রধান কাজ হলো, পাবলিক রিলেশন। পাবলিক রিলেশন না থাকলে একজন মানুষ অস্তিত্বহীনতার আশঙ্কায় পড়ে যায়।

আমাদের আকাবিরদের হাত উম্মতের প্রতিটি সদস্যের শিরার উপরে ছিল। তাঁরা উম্মতের প্রতিটি সদস্যের পালস বুঝতে পারতেন। আর আজ আমাদের হাত উম্মতের শিরা থেকে এতো দূরে চলে গেছে যে, উন্মত আমাদেরকে 'অতিরিক্ত জনগণ' ভাবতে বসেছে।

জীবন জিন্দেগির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পাঠগৃহে না শিখালে তারা কোথায়  শিখবেন? একটি প্রসিদ্ধ প্রবাদ আমরা সব সময় মনে রাখতে পারি। আর তা হলো, একজন শিক্ষার্থীর ভাগ্য পুনর্গঠিত হয় তার পাঠগৃহে। অতএব, আমাদের এসব পবিত্র পাঠগৃহে দীন-দুনিয়া সমান্তরাল ভাবে উভয়টিই শেখাতে হবে, তাহলেই আসবে উভয় জগতে সফলতা।

লেখক: প্রিন্সিপাল ও রেক্টর, জামিয়া ইসলামিয়া ঢাকা; বহু গ্রন্থপ্রণেতা

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ