কাওসার আইয়ুব: বাবা নির্ভরতার আশ্রয়স্থল। ভালোবাসার দীর্ঘ ছায়া। অনুশাসনের একটি শৃংখল। বাবার ছায়া সন্তানের জন্য বড় রহমত। সন্তানের মুখে আহার যোগাতে সর্বস্ব ত্যাগ করে যায় বাবা। জন্ম দেয়ার আগ থেকেই আমাদের নিয়ে সপ্ন দেখে যে বাবা তার মর্যাদা দিতে বলেছে ইসলাম। ভক্তি-শ্রদ্ধা আর ভালবাসার জায়গা থেকে বাবাকে আগলে রাখতে বলে কুরআন-হাদিসের বাণী।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাবার মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হন; বাবার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হোন। সে কারণেই ইসলাম বাবা-মার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করাকে বড় গোনাহের কাজ বলে বিচার করেছে।
সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘আমি নবী করিম সা. কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ কোনটি? তিনি বললেন সময়মতো নামাজ পড়া। আমি বললাম তারপর কোনটি? তিনি বললেন পিতা-মাতার সঙ্গে উত্তম আচরণ করা। আমি জিজ্ঞেস করলাম তারপর কোনটি? তিনি বললেন আল্লাহর পথে জিহাদ করা। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। এ হাদীসে বাবার মর্যাদা রক্ষা করতে বাবা-মার সাথে আচরণ সুন্দর করতে শিক্ষা দিয়েছেন।
পবিত্র কুরআনুল কারিম অনেক বার বাবা-মার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্যের নির্দেশ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত কর না এবং বাবা-মার সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন; তবে তাঁদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সঙ্গে বল শিষ্টাচারপূর্ণ কথা। (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৩)
এ আয়াতে মা-বাবাকে ‘উহ’ শব্দ পরিমাণ কষ্ট দিতেও নিষেধ করেছে , এর দ্বারা আচরণের পাশাপাশি আরেকটি বড় বিষয় বুঝে আসে তা হচ্ছে মা-বাবার সম্মান মর্যাদা রক্ষা করা আল্লাহ তাআলা সন্তানের ইচ্ছাধীন রাখেননি বরং বাধ্য করে দিয়েছেন যে, অবশ্যই মা-বাবার সম্মান-মর্যাদা রক্ষা করতে হবে।
হাদিসের ভাষায় নবিজী বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসূল সা. এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার উত্তম সাহচর্য লাভের সবচেয়ে বেশি হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। তারপর কে? তারপর তোমার মা। তারপর কে? তারপর তোমার মা। তারপর কে? তারপর তোমার বাবা। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৯৭১)
ইসলাম জন্ম পরিচয়ের সূত্র প্রকাশের সময় আপন পিতা ছাড়া অন্যের দিকে নিজের পরিচয়কে সম্পর্কযুক্ত করতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছে। বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে বাবাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ত দিয়েছে ইসলাম। এমনকি ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, ভক্তি-শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শন বা অন্য কোনো কারণেও , জন্মদাতা পিতা ছাড়া অন্যকে পিতা বলে ডাকতে ও পরিচয় দিতে নিষেধ করেছে। ইসলামের এ দৃঢ় অবস্থান থেকেই বুঝে আসে, বাবাকে ইসলামে কতটা গুরুত্তের দৃষ্টিতে দেখে। এভাবে ইসলাম পিতৃত্বের পরিচয়কে সুসংহত করে পিতার মর্যাদাকে উচ্চাসনে বসিয়েছে।
বাবার মৃত্যুর পর সন্তানের কী করনীয়
বাবার মৃত্যুর পর সন্তানের কী করনীয় সে কথাও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসের মধ্যে বলে দিয়েছেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল যোগ হতে থাকে- ১. সদকায়ে জারিয়া, ২. কল্যাণময় শিক্ষা ও ৩. এমন সৎ সন্তান যে মৃত পিতা-মাতার জন্য দোয়া করে। (সহিহ মুসলিম)
অন্য হাদিসে আছে, মৃত মা-বাবার জন্য সৎ সন্তানের দোয়া অনেক উপকারী। বাবার অনুপস্থিতিতে বাবার বন্ধুদের সঙ্গে কেমন আচরণ হবে সেটাও শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম পিতাকে ভালোবাসতে ও সম্মান জানাতে ভীষণ গুরুত্ব দিয়েছে। বাবার অনুপস্থিতে বাবার বন্ধুদের ভালোবাসতে ও সম্মান জানাতে বলেছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে এক সাহাবীর পিতা মারা যাওয়ার পর রাসুল সা. এর কাছে এসে জানতে চেয়েছিলেন; পিতার ওপর তার কোনো দায়িত্ব আছে কি-না? তখন আল্লাহর রাসূল তাকে পিতার বন্ধুদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারের আদেশ করেন।
পিতার বন্ধু পিতার জীবনে সুখ-দুঃখের সঙ্গী। তাদের সম্মান জানানো মানে পিতাকে সম্মান জানানো। তাদের ভালোবাসার মধ্যেই পিতার ভালোবাসা। আবু উসাইদ রা. বলেন, একবার আমরা রাসুল সা.-এর কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় বনি সালামা গোত্রের এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার দায়িত্ব আমার ওপর রয়েছে কি? তা কীভাবে করতে হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাদের জন্য দোয়া করা। তাদের গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাদের অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ করা, তাদের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। তাদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৪৪)
বাবার বন্ধুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল সা. বলেন, ‘সৎ কাজগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় সৎকাজ হলো- কোনো ব্যক্তি তার পিতার বন্ধুদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা।’ (মুসলিম শরিফ)।
পিতার বন্ধুদের ভালোবাসার শিক্ষা ইসলাম শিকড় থেকেই দিয়েছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ সাহাবায়ে কিরাম পিতার বন্ধুকে সম্মান জানিয়েছেন। চাই সে মুসলমান হোক কিংবা অমুসলিম। আব্দুল্লাহ ইবনে দিনার আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণনা করেন- জনৈক বেদুইন তার সঙ্গে মক্কার পথে মিলিত হন। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. তাকে সালাম করেন এবং যে গাধার পিঠে তিনি আরোহিত ছিলেন সেটাতে তাকেও তুলে নিলেন। তিনি নিজের মাথার পাগড়িটা তাকে দিয়ে দিলেন। ইবনে দিনার বলেন- আমরা তাকে বললাম, আল্লাহ আপনাকে কল্যাণ দান করুক। বেদুইনরা তো অল্প কিছু পেলেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. তখন বলেন, ‘এই ব্যক্তির পিতা আমার পিতার বন্ধু ছিলেন। আমি রাসুল সা. কে বলতে শুনেছি- সৎকাজগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় সৎকাজ হলো পিতার বন্ধুদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।’ (রিয়াদুস সালিহিন, হাদিস : ৩৪২)
সুতরাং আমাদের বাবাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়অ তাদের সাথে কঠোরতা না করা। বৃদ্ধাশ্রমের মতো নিরব কুঠিরে তাদের ফেলে না আসা। আজকের এ প্রবন্ধ থেকে সন্তানের জন্য বাবা-মার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন হোক আমাদের অঙ্গীকার।
এমডব্লিউ/
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        