মাওলানা আবু সাবের আব্দুল্লাহ
প্রাতিষ্ঠানিক ছুটির অর্থ হলো দরস, তাকরার ও পরীক্ষাকেন্দ্রিক দীর্ঘ পরিশ্রমের কারণে শরীর ও মস্তিষ্কের উপর যে ধকল গিয়েছে, দেহ-মনের যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটিয়ে ফুরফুরে তাজাদম হওয়া এবং নতুন উদ্দম ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করা। যেমন প্রাত্যহিক কাজে ক্লান্তি কিংবা অবসাদ ধরে গেলে আমরা খোলামেলা পরিবেশে সামন্য হেটে আসি, একুটুখানি ঘুমিয়ে নিই, হালকা কোনো কাজের মাধ্যমে বৈচিত্র আনি। পরীক্ষা পরবর্তী ছুটিটাও তেমন। তাই ছুটি মানে এটা নয় যে, এখন আর কোনো পড়ালেখা নেই, এখন আমি উদাসীন কিংবা উসশৃঙ্খল হয়ে পড়বো। ছুটি মানে মাদরাসার পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশে গিয়ে নতুন কিছু শেখা। নতুন শৃঙ্খলায় নতুন পাঠে নিয়োজিত হওয়া।
মাদরাসায় উস্তাদদের কাছে কিতাব পড়েছি। বাড়িতে গিয়ে মা-বাবার কাছে জীবন ও সমাজের নানা পাঠ গ্রহণ করবো। পাড়াপ্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নিবো। এলাকার মানুষের দ্বীনী ও দুনিয়াবি জরুরত বোঝার চেষ্টা করবো। পাঠ্যক্রমের বাইরে কিছু বই-কিতাব পড়বো। ঘুম বিশ্রাম নাওয়া খাওয়া ঠিক মতো করবো। এভাবে ছুটিতেও শিক্ষার ধারা অব্যাহত রাখবে।
মোটকথা, তালেবুল ইলমের জীবনে আক্ষরিক অর্থে ছুটি বলতে কিছু নেই। সে তো মাদরাসা-বাড়ি উভয় সময়ই শেখার ব্রতে মগ্ন থাকবে। তবে মাদরাসা ও বাড়ির পড়ালেখার ধরন একটু ভিন্ন হয়। বাড়ির পরিবেশে আমাদের মনে রাখতে হবে--
১. মাদরাসার বাহিরে গুনাহের সুযোগ অবারিত থাকে। কিন্তু মাদরাসার পরিবেশে গুনাহের আসবাব কম থাকে, সুযোগ কম থাকে। এই জন্য ছুটির দিনগুলোর প্রথম ও প্রধান কাজ হল, গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। কারণ গুনাহ এমন এক অন্ধকার, যা অন্তরের নূর নিভিয়ে দেয়। হিম্মত কমিয়ে দেয়। দিল দেমাগের প্রসন্নতা বিনষ্ট করে। মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। মাদরাসায় থেকে যে নূর তুমি অর্জন করেছ, বাড়িতে গুনাহের কারণে সেই নূর লোপ পায়। ইলমের বরকত হারিয়ে যায়। তাই গুনাহ থেকে বাঁচতে হবে।
আল্লাহ তায়ালার তাওফিক ছাড়া কোনো বান্দার পক্ষে গুনাহ থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বান্দার করণীয় কাজ চারটি। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা ও সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। করণীয় চারটি হলো--
ক. إرادة দৃঢ়সংকল্প করা
খ. همة সাহস করা
গ. السعي চেষ্টা করা
ঘ. الدعاء দুআ করা
--এই চারটি বান্দার কর্তব্য। এগুলো করার পর আল্লাহ তা‘য়ালা বান্দাকে গুনাহ থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করেন। এর পাশাপাশি নিচের দুআটি নিয়মিত পড়লে আল্লাহ বান্দাকে গুনাহ থেকে রক্ষা করেন--
اللهم حبب إلينا الإيمان و زينه في قلوبنا و كره إلينا الكفر و الفسوق و العصيان
“হে আল্লাহ! আমাদের নিকটে ঈমানকে প্রিয় করে দিন এবং তা আমাদের অন্তরে সুশোভিত করুন; আর আমাদের নিকটে কুফর, ফিসক ও অবাধ্যতাকে ঘৃণিত করে দিন।
আর যখনই গুনাহের ইচ্ছা মনে জাগ্রত হয়, তখন এই দুআ পাঠ করবে--
ربي أني مغلوب فانتصر
“হে আমার রব! আমি পরাভূত হয়ে পড়েছি, আপনি আমাকে সাহায্য করুন।”
--এই গুনাহসমূহের মধ্যে একটি গুনাহ কুনযর। এটা অন্তরের নূর বিদায় করে দেয়। ইলমের বরকত ধ্বংস করে ফেলে। আমলের আগ্রহ শেষ করে দেয়। তাই ছুটিতে অন্য কিছু না পারলেও কুনযর থেকে অবশ্যই নিজেকে বাঁচাও। যদি কোনো কিতাব পড়তে না পারো, না পড়ো। যদি অন্য কিছু করতে না পারো, না করো । কিন্তু এই গুনাহটা করো না।
২. দুই নম্বর কাজ হল, জামাতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া। অনেক তালিবুল ইলম এই জায়গায় পিছিয়ে পড়ে। দেখ, বাড়িতে যাওয়ার পর সাধারণ মানুষ তোমার ইলমের গভীরতা কিন্তু বুঝবে না। অবশ্য তাদের বোঝার ক্ষমতাও সে রকম নেই। কিন্তু তারা যে জিনিসটা দেখবে তা হল তোমার বাহ্যিক রূপ, আচরণ, ঈমান ও আমল। এগুলো দিয়েই তারা তোমাকে মূল্যায়ন করবে। আর তোমরা তো জানো, আমলসমূহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। এই নামায বাজামাত আদায় করা। বাড়িতে গেলে অনেক তালেবে ইলম নামাজের ব্যাপারে প্রচুর অবহেলা করে, গাফেল হয়ে যায়, অলসতায় করে। খবরদার! নামাজের ব্যাপারে কোনো প্রকার গাফিলতি করবে না। নামাজ যেন কখনো ক্বাযা না হয়।
৩. তিন নম্বর কাজ হল, আব্বা আম্মার খেদমত করা। এটা খুবগুরুত্বপূর্ণ। সারা বছর তো মা-বাবার খেদমতের সুযোগ হয়ে ওঠে না। তাই বন্ধের এই সময়টা মা বাবার খেদমত করার জন্য গনিমত। তাই বাপ-মায়ের খেদমত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত। এতে আল্লাহও সন্তুষ্ট হবেন। বাবা মাও সন্তুষ্ট হবেন। হাদিসে এসেছে,
رضا الرب في رضا الوالد
পিতামাতার সন্তুষ্টির মাঝে রব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি নিহিত।
৪. চার নম্বর কাজ হল, আকাবির ও বড় বড় উলামায়ে কেরামের জীবনী পড়া। জীবন গড়ার ক্ষেত্রে আকাবিরদের জীবনী পড়ার বিকল্প নেই। তাদের জীবনী পড়লে তুমি অনুধাবন করতে পারতে পারবে, কীভাবে তারা ‘বড়’ হয়েছেন। কোন গুণ, কোন ত্যাগ আর কোন আত্মনিবেদন তাদের মহান করেছে। এবং তাদের বড় হওয়ার পেছনের রহস্যটা কী? তাদের জীবনচরিত অধ্যয়ন করলে তুমি তোমার জীবনের জন্য একটি মাইলফলক পেয়ে যাবে।
আকাবিরদের জীবনী নিয়ে বহু মূল্যবান কিতাব রচিত হয়েছে। তুমি যেকোনো একটি পড়তে পার। তবে বিশেষভাবে এই কিতাবগুলো থেকে শুরু করা যেতে পারে।
ক. আববীতি (জাকারিয়া কান্ধলভী রা.)
খ. রাহে মানযিল (মানযুর নোমানী রা.) ছোট্ট কিতাব, তালিবুল ইলমের জীবন-রহস্য বোঝার জন্য খুবই উপকারী।
গ. তালিবানে ইলমের জীবন পথের পাথেয় (আবুল হাসান আলী নাদভী রা.) খুব গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।
ঘ. তালেবুল ইলম: পথ ও পাথেয়। (মাওলানা আব্দুল মালেক দা.) ইত্যাদি।
৫. পাঁচ নম্বর কাজ, ঘরে তালিম করা। প্রত্যেক দিন অন্তত একবার করে তালিম করবে। সন্ধায় হতে পারে। অথবা অন্য কোনো সময়ও হতে পারে। এবং বিভিন্ন বিষয়ে তালিম হতে পারে। যেমন--
ক. কুরআনুল কারিমের তেলাওয়াতের তালিম। তোমাদের মা-বোনদের অনেকেই হয়ত কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে না। বা পারলেও তেওয়াত সহিহ নয়। তুমি সহিহ শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পার। তাদেরকে এই বিশুদ্ধ তেলাওয়াত শিক্ষা দেওয়া তোমার দায়িত্ব।
খ. “রিয়াজুস সালিহিন” এবং “মা‘আরেফুল হাদিস” কিতাবদ্বয়ের তালিম হতে পারে।
এই দু‘টি কিতাব প্রত্যেক মুসলিমের ঘরে ঘরে থাকা দরকার। কোনো ঘর এই কিতাব-শূন্য হওয়া উচিত নয়। তো তোমরা এই দুই কিতাবের তালিম করতে পার।
গ. মাসায়েলের তালিম করতে পার। নারীরা কত কত মাসআলা জানে না। শুধু নামাজের কথাই ধর! তারা কি নামাজের জরুরি সব মাসআলা জানে? জানে না। অন্য বিষয়ের কথা না হয় বাদই দিলাম।
ঘ. “ফাজায়েলে আমল” কিতাবের তালিম করতে পার। সুন্দর কিতাব।
৬. বাড়িতে ছয় নম্বর কাজ হলো নিজে কুরআন তেলাওয়াত করা। তোমরা যারা হাফেজ আছ, প্রতিদিন অন্তত তিন পারা তেলাওয়াত করবে, আর যারা গাইরে হাফেজ আছ তারা অন্তত এক পারা তেলাওয়াত করবে। কিছু অংশ তরজমা ও তাফসিরসহ পড়বে শিখবে। মনে রাখবে, সাধারণ মানুষ কুরআনের তরজমা ও তাফসির পড়বে। কিন্তু একজন তালিবুল ইলম তরজমা ও তাফসির শিখবে, শুধু পড়বে না। তরজমা ও তাফসির শিখতে হলে শুধু পড়া যথেষ্ট নয়। বরং পূর্ণ মনোযোগ ও সচেতনতার সাথে ভাবতে হবে। আরবি ভাষার সাথে মিলাতে হবে। একজন তরজমাকারী কিভাবে তরজমা করছেন সেটা খেয়াল করতে হবে। এমনিভাবে একজন মুফাসসির কীভাবে তাফসির করেছেন, তা গভীরভাবে লক্ষ করতে হবে। কারণ তুমি শুধু তাফসিরের পাঠক নও, বরং তুমি আগামীদিনের মুফাসসির। তাই তোমাকে সেভাবেই প্রস্তুতি নিবে হবে।
৭. সাত নম্বর কাজ, মসজিদের তালিমে অংশগ্রহণ করা। যদি তালিম আগ থেকে চালু থাকে তো ভালো। যদি চালু না থাকে তাহলে চালু করবে। গুরুত্বের সাথে অংশ গ্রহণ করবে। অন্যদেরকে সেখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য তারগিব দিবে।
৮. আট নম্বর কাজ, ছোট-বড় সবাইকে আগ বেড়ে সালাম দিবে। মুরুব্বীদের সাথে হাসি মুখে কথা বলবে। তাদের থেকে দুআ নিবে। ছোটদের সাথে স্নেহের আচরণ করবে। আর সমবয়সীদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে। কারও সাথে অযথা বাকবিতÐে লিপ্ত হবে না। তোমার আচরণের মাধ্যমে তাদেরকে দীনের প্রতি আহ্বান করবে। তারা যেন তোমার আচরণেই মাদরাসা ও দীনী শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়, আকৃষ্ট হয়।
৯. নয় নম্বর কাজ, সমাজে সেবামূলক কাজ করবে। খেদমতুল খালক খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর সুযোগ তোমাদের হয় না। তাই ছুটির সময়কে এই কাজের জন্য গনিমত মনে করা চাই। তুমি তোমার সাধ্য মতো সমাজে ছোট ছোট সেবামূলক কাজ করো। যেমন কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখে যাও। বয়স্কদের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াও। মসজিদ-মাদরাসার কাজে সাহয্য কর। অসহায়দের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা কর। চলাচলের রাস্তা, পুকুরের ঘাট মেরামত করো। এগুলো ছোট ছোট কাজ, কিন্তু এগুলোর মূল্য আল্লাহ তা‘য়ালার কাছে যেমন অনেক, তেমনি মানুষের কাছেও অনেক।
১০. দশ নম্বর কাজ, আলেম উলামা ও মাদারিস মারাকিয যিয়ারত করবে। বিশেষ করে তুমি যাদের কাছে পড়েছ, তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করবে। তাঁদের থেকে দুআ নিবে। তাঁদের সম্মান করবে। তাঁরা তোমাদের দেখে অনেক খুশি হবেন এবং অন্তর থেকে দুআ করবেন। এমনিভাবে তুমি যে মাদরাসায় আগে পড়েছ, সেখানে যিয়ারত করতে যাবে। এ ছাড়া তোমাদের এলাকায় বা আশ পাশের এলাকায় যদি কোনো মাদরাসা থাকে সেখানে যাবে। সেখানকার উস্তাাদদের সাথে সাক্ষাৎ করবে। তাদের সাথে পরিচিত হবে।
১১. এগার নম্বর কাজ, প্রতিদিন অন্তত একটি করে মাসনুন দুআ মুখস্থ করবে এবং আমল করবে। এর গুরুত্ব অনেক। আমরা মুসনুন দুআর ব্যাপারে বড়ই গাফেল। দেখ, প্রতিদিন যদি একটি করে মাসনুন দুআ মুখস্থ করো, তাহলে এক সপ্তাহে সাতটি এবং এক মাসে ত্রিশটি। পাশাপাশি যদি সেগুলোর উপর আমল কর কত বড় একটা খাযানা হয়ে যাবে?! আর মাসনুন দুআ মুখস্থ করার সহজ তরিকা হল আমল করা। যে দুআটি মুখস্থ করছ, সেটা আমলে নিয়ে আস। মুখস্থ করার পর থেকেই আমল করতে থাক। দেখবে মনে থাকবে।
মোটকথা, মাদরাসার ছুটি মানে শিক্ষার ছুটি নয়। বরং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, যথা সময় নামাজ আদায়, কুরআন তেলাওয়াত, মা-বাবার খেদমত এবং আকাবির-আসলাফদের জীবনী পঠনের মধ্য দিয়ে একটি সুন্দর ও সুশৃংখল অবসর যাপন করার নামই হল ছুটি। ছুটির এই এগার কাজ তোমার জীবন গড়ার এগার ধাপ।
তোমাদের মধ্যে যারা এগুলো আমলে আনবে, তারা ছুটি শেষে শুধু বিশ্রাম নয়; বরং নতুন আলো, নতুন নূর নিয়ে ফিরবে। আল্লাহ আমলে আনার তাওফিক দান করুন, আমিন।
(মালিবাগ জামিয়ার শাইখুল হাদিস মাওলানা আবু সাবের আব্দুল্লাহর তরবিয়তি মজলিসের বয়ান)
[স্বরলিপি: কাউসার বিন ইব্রাহিম, ইফতা বিভাগ, দ্বিতীয় বর্ষ, জামিয়া শারইয়াহ মালিবাগ ঢাকা]
এনএইচ/
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                         
                               
                               
                              _medium_1761797081.jpg)