মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমুদুল হাসান।।
নামাযের ওয়াজিব ছুটে গেলে যেমন ‘সিজদায়ে সাহু’ করতে হয়। সিজদায়ে সাহুর মাধ্যমে নামাযের ভুল-ত্রুটির অবসান ঘটে ও নামায পরিপূর্ণ হয়, তেমনিভাবে একমাস রোযা আদায়ে জানা-অজানায় অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায়। এর পরিশোধন করতে এক মাস সিয়াম সাধনা শেষে ঈদের দিন সুবহে-সাদেকের পর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়।
যাদের ওপর যাকাত দেয়া ওয়াজিব অথবা সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ মাল ঈদের দিন সকালে থাকাই যথেষ্ট, এক বছর স্থায়ী ও অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়।
এমন ধনী ব্যক্তি যার ওপর যাকাত ওয়াজিব নয়, কিন্তু তার নিকট এমন মূল্যবান সামানপত্র রয়েছে যে, তার মূল্যের ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়, এমতাবস্থায় তার সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হবে। যেমন, কারো দুটি বাড়ি আছে। একটিতে তিনি নিজে থাকেন অপরটি খালি বা ভাড়া দিয়েছেন। সুতরাং দ্বিতীয় বাড়িটি তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত গণ্য হবে। বাড়িটির মূল্য যদি নেসাব পরিমাণ হয়, তবে সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। আর যদি সেটাও তার জীবন ধারণের কাজে লাগে, তখন সে বাড়িটি তার দরকারি সামানের অন্তর্ভুক্ত হবে। সুতরাং তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে না।
কারো নিকট প্রয়োজনের উর্ধ্বে মাল-সামান আছে। কিন্তু সে ঋণী, সুতরাং ঋণ পরিশোধ করার পরও যদি যাকাত ওয়াজিব হয় পরিমাণ মাল বাকি থাকে, তাহলে ফিতরা ওয়াজিব হবে, নতুবা হবে না।
সদকাতুল ফিতর রোযাদার, অরোযাদার সকলেরই আদায় করতে হবে। নচেৎ গোনাহগার হবে। অনেকেই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে অনিচ্ছুক (তাদের জন্য মাফ নেই) তাদেরকে অবশ্যই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে।
সদকাতুল ফিতর নিজের ও নিজের নাবালেগ সন্তানদের পক্ষ থেকে আদায় করতে হয়। এছাড়া অনুমতি নিয়ে অন্যদেরর ফিতরাও আদায় করা যায়।
ঈদের নামাযের পূর্বে সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম, আগে-পরেও আদায় করা যায়। ঈদের পূর্বে আদায় না করে থাকলে পরে অবশ্যই আদায় করতে হয়। এমনকি রমযান মাসে সদকাতুল ফিতর আদায় করলেও আদায় হয়ে যাবে।
সদকাতুল ফিতরের নেসাব
যে পরিমাণ মালের অধিকারী হলে যাকাত ফরজ হয়, তার সমমূল্যের মাল (যা আবশ্যকীয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত, চাই ব্যবসার মাল হোক বা না হোক) ঈদের দিন প্রভাতে যে ব্যক্তির মালিকানায় থাকে, তার ওপর ফেতরা ওয়াজিব হয়। এরূপ প্রত্যেক মুসলমান ব্যক্তির ওপর সদকাতুল ওয়াজিব।
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ
সদকাতুল ফিতর নগদ টাকা বা অন্যান্য সামানার মাধ্যমে প্রদান করা হয়ে থাকে। যেমন, উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে আদায় করা যায়। উৎপাদিত ফসলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—গম, যব, খেজুর, কিশমিশ, ধান, চাউল ইত্যাদি।
যদি গম, গমের আটা দ্বারা সদকাতুল ফিতরা আদায় করা হয়, তাহলে এক সের সাড়ে বারো ছটাক (১ কেজি ৬৬২.১২ গ্রাম) আদায় করতে হয়।
যদি খেজুর, কিশমিশ ও যব অথবা যবের আটা দ্বারা আদায় করা হয়, তাহলে ৩ কেজি ৭০০ গ্রাম আদায় করতে হয়। অথবা যব, যবের আটার মূল্য কিংবা কিশমিশ, গম, গমের আটার মূল্য এবং খেজুরের মূল্য আদায় করলেও সদকাতুল ফিতর আদায় হয়। তদ্রূপ এসবের মূল্য দ্বারা ক্রয়কৃত কোনো শস্য যেমন—ধান, চাউল, বুট, কালাই ইত্যাদির মাধ্যমেও সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়।
সদকাতুল ফিতর গ্রহণ কারা গ্রহণ করবে?
যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়, তাদেরকেই কেবল সদকাতুল ফিতর দেয়া যায়। সদকাতুল ফিতর দাতা নিজেই গরিব ও অভাবগ্রস্থ লোকদের হাতে দিয়ে মালিক বানিয়ে দিবে। তিনি যদি গরিব-দুঃখীদের মাঝে বিলি-বণ্টন করার জন্য কাউকে ন্যস্ত করতে চান, তা-ও পারবেন। কিন্তু অবশ্যই সে ব্যক্তি আস্থাশীল ও আস্থাভাজন হতে হবে। কারণ, তার অবশ্যই অবগত থাকতে হবে যে, সদকাতুল ফিতর প্রদানকারী যথাস্থানে যথাযথভাবে বণ্টন করতে সক্ষম কিনা!
এমনিভাবে কোনো মাদরাসা-প্রতিষ্ঠান বা কোনো সংস্থায় সদকাতুল ফিতরের টাকা প্রদান করতে হলে সদকাতুল ফিতর আদায়ের পূর্বেই সে প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সম্বন্ধে জানা থাকা একান্ত দরকার। যদি যথাস্থানে খরচ না হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেখানে সদকাতুল ফিতরের টাকা প্রদান করবে না।
সদকাতুল ফিতরের অর্থ দ্বারা মাদরাসা, মসজিদ বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করা বা নির্মাণের কাজ সম্পাদন করা এবং পারিশ্রমিক দেওয়া ও মৃত ব্যক্তি কাফন-দাফন ইত্যাকার ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করা জায়েজ নেই।
নেসাব পরিমাণ মাল আছে—এমন ব্যক্তিকে অথবা হাশেমী বংশের লোকদেরকে অনুরূপ দাদা-দাদি, নানা-নানি, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি, উপর ও নীচের কাউকেই সদকাতুল ফিতর দেওয়া জায়েজ নেই।
যাকাত আদায়ে কমিশন
যে সব মাদরাসায় যাকাতের অর্থ সঠিক-সুন্দরভাবে খরচ করা হয়ে থাকে, কেবল সে সব নির্ভরযোগ্য মাদরাসাতে নিজে উপস্থিত হয়ে অথবা নিজের লোকজনের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাছে দেয়াই উত্তম। এতে অধিক সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়।
বর্তমান সময়ে একটি বিপদ হলো, কতিপয় লোক যাদের মাদরাসার কোনো অস্তিতই নেই অথবা যেখানে যাকাতের জন্য লিল্লাহ বোডিং ইত্যাদি নেই, তারাও যাকাত আদায় করে থাকে। আল্লাহ পাকের কাছে তো বটেই, মানুষের কাছেও ধরা পড়ে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হতে হয়। সে কারণে একশ্রেণির মানুষ সমস্ত মাদরাসার এবং সংশ্লিষ্টদের কঠোর সমালোচনা করে থাকে। এর ফলে যারা প্রকৃত উপযুক্ত তারাও সমালোচিত ও বঞ্চিত হচ্ছে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে সর্তকতা অবলম্বন করা।
ইদানীং অনেককে দেখা যায়, তারা কমিশনের ভিত্তিতে যাকাত কালেকশন করে। কোনো মাদরাসার মুহতামিম অথবা উস্তাদদের মাদরাসার চাঁদা থেকে কমিশন নেয়া সত্যিই লজ্জাজনক। দ্বীনের খেদমতের বিনিময় গ্রহণ না করে পারা যায় না, বিধায় জরুরতের খাতিরে বেতন নিতে হয়। কিন্তু যাকাত কালেকশন করে কমিশন নেওয়ার বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।
অনেক মাদরাসায় তো এমনও হয় যে, মাদরাসার অফিসে রসিদ বই কাটার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন থাকে। দাতারা অনেক সময় নিজেই মাদরাসায় এসে অথবা লোকের মাধ্যমে যাকাতের টাকা পাঠায়। যে রশিদ কেটে দেয় সে ওই টাকার কমিশন গ্রহণ করে। এটি সত্যিই লজ্জাজনক। মনে রাখতে হবে, যাকাতের টাকা থেকে কমিশন নেয়া-দেয়া উভয়টিই নাজায়েজ। যাকাতের টাকা মাদরাসায় পুরোপুরি জমা করে যথাযথভাবে খরচ করতে হবে। কমিশন নেয়া-দেয়া মোটেই ঠিক নয়।
তবে যদি কাউকে কালেকশনের জন্য বেতনভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয় আর তাকে বেতন বাদে ভালো কালেকশনের পুরষ্কার হিসেবে বেতনের অতিরিক্ত অর্থ দেয় তাহলে জায়েজ হবে, তবে সেই অতিরিক্ত টাকা মাদরাসার সাধারণ ফান্ড থেকে হতে হবে। মনে রাখতে হবে, যাকাতের টাকা থেকে দেওয়া মোটেই জায়েজ নয়। তবে বেতনভিত্তিক নিয়োগ ব্যতীত কমিশনের শর্তে যাকাত আদায় করে যাকাতের অথবা অন্য ফান্ডের অর্থ থেকে কমিশন আদান-প্রদান নাজায়েজ।
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে পড়তে পারেন মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান হাফিজাহুল্লাহ রচিত ‘যাকাতের মাসআলা মাসায়েল’ নামক গ্রন্থটি। বইটি পাওয়া যাবে যাত্রাবাড়ি মাদরাসা সংলগ্ন কিতাব মার্কেটে এবং বাংলাবাজারের মাকতাবাতুল আবরারে।
এনটি
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        