বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫ ।। ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ ।। ৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৭


প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজন ধর্মীয় শিক্ষক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

||মুনীরুল ইসলাম||

বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের শতকরা ৯১.০৪ ভাগ নাগরিক মুসলমান। ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়; এটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এবং নৈতিকতা, শিষ্টাচার, মানবিকতা ও সমাজ গঠনের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। এই ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা যদি শিশু বয়সেই আগামী প্রজন্মের হৃদয়ে সঞ্চারিত না হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়বে। এজন্য দেশের প্রায় ৬৫ হাজার প্রাইমারি স্কুল তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি।

নৈতিকতার প্রথম পাঠ

প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষাঙ্গন। এখানেই গড়ে ওঠে তাদের চিন্তা, চরিত্র ও মূল্যবোধের ভিত। এই স্তরে শিশুরা যে শিক্ষা পায়, তা-ই তার সারাজীবনের নৈতিক ও মানসিক গঠন নির্ধারণ করে। যদি এই পর্যায়ে ইসলামের মৌলিক বিষয়Ñ ঈমান, আকিদা, কুরআন তেলাওয়াত, নামাজ, রোজা, আদব-আখলাক ইত্যাদি শেখানো না হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধর্মীয় দিক থেকে পিছিয়ে পড়বে। আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। যদি ছোটবেলা থেকেই সঠিকভাবে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে, তবে তারা বড় হয়ে সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, দায়িত্বশীল ও সৎ মানুষ হিসেবে সমাজে অবদান রাখবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় শিক্ষার ঘাটতি

বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইসলাম শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে থাকলেও বাস্তবে তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। বিষয়টাও আরো ঢেলে সাজানো দরকার। তাছাড়া অধিকাংশ বিদ্যালয়ে আলাদা ধর্মীয় শিক্ষক নেই। সাধারণ শিক্ষকরা অন্য বিষয় পড়ানোর পাশাপাশি ধর্ম শিক্ষা পড়ান, ফলে ধর্মীয় বিষয়গুলো শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়, বিশুদ্ধ কুরআন তেলাওয়াত, প্রয়োজনীয় দোয়া-কালাম, ঈমান-আকিদার মৌলিক বিষয়, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, নবী-রাসুলের প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আখেরাত ও তাকদিরের ধারণা ইত্যাদি শিশুরা সঠিকভাবে জানতে পারে না। এতে তাদের ধর্মীয় ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তারা ইসলামি মূল্যবোধ থেকে ধীরে ধীরে বিচ্যুত হতে থাকে।

ইসলামি শিক্ষার গুরুত্ব

ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে ফরজ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ প্রথম ওহি নাজিল করেই বলেন, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ [সুরা আলাক : আয়াত ১] মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে উত্তম সে ব্যক্তি, যে কুরআন শেখে এবং তা শিক্ষা দেয়।’ [সহিহ বুখারি]

তাই শিশুদেরকে কুরআনের হরফ, তেলাওয়াত, অর্থ ও আদর্শ শেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয়। প্রাথমিক স্তরে একজন ইসলামি শিক্ষক থাকলে শিশুদের মধ্যে এই ধর্মীয় অনুপ্রেরণা জাগ্রত হবে।

জাতীয় শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় শিক্ষার অবস্থান

বাংলাদেশের ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বলা আছে, ‘শিশুদের নৈতিক ও মানবিক বিকাশের জন্য ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।’ কিন্তু নীতিগত সিদ্ধান্ত থাকলেও বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়ে গেছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিশাল অংশে আজও ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক নেই। ফলস্বরূপ, ধর্ম শিক্ষা পাঠ্যবই থাকলেও তা শিশুর অন্তরে যথাযথ প্রভাব ফেলতে পারছে না। যদি এই নীতিকে বাস্তবায়ন করতে হয়, তবে প্রত্যেক বিদ্যালয়ে একজন যোগ্য আলেম ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া অপরিহার্য।

সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ও তার প্রতিকার

বর্তমান সমাজে যে নৈতিক অবক্ষয় ও অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, তার অন্যতম কারণ ধর্মীয় শিক্ষার অভাব। শিশু বয়সে যদি সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারাম, ন্যায়-অন্যায়, মানবতা ও নৈতিকতার পার্থক্য শেখানো হয়, তাহলে বড় হয়ে তারা ভুল পথে পা বাড়াবে না। একজন শিশুর হৃদয়ে যদি আল্লাহভীতি, মানবপ্রেম ও সততার বীজ বপন করা যায়, তবে সেই শিশু বড় হয়ে দুর্নীতি, মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক থাকলে শিশুদের মনোজগতে সঠিক দিকনির্দেশনা তৈরি হবে। তারা শিখবেÑ অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে, মুরব্বিদের সম্মান করতে, মিথ্যা ও অন্যায় থেকে বিরত থাকতে এবং নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতে।

একটি জাতি তখনই টিকে থাকে, যখন এর অধিবাসীরা ন্যায়পরায়ণ ও সৎ হয়। প্রযুক্তি বা উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন তার ভিত্তি থাকে নৈতিকতায়। যদি প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক থাকেন, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকেও পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে। আজ আমরা দেখি, মেধাবী তরুণ দুর্নীতির দায়ে কারাগারে, প্রযুক্তিবিদ অনৈতিক লেনদেনে জড়িত, রাজনীতিক নীতিহীনতায় নিমজ্জিত। এই সংকটের মূল সমাধান নৈতিক শিক্ষায়, আর একজন ধর্মীয় শিক্ষকই এর ভিত্তি গড়ে দিতে পারেন।

বিদেশে ধর্মীয় শিক্ষার দৃষ্টান্ত

অনেক উন্নত মুসলিম দেশ যেমন সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তানÑ তাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষাকে প্রাথমিক স্তর থেকেই বাধ্যতামূলক করেছে। এমনকি অনেক অমুসলিম দেশেও মুসলিম সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ নামে আলাদা বিষয় চালু আছে। তাহলে প্রায় ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে কেন শিশুদের ঈমানি শিক্ষার জন্য একজন ইসলামি শিক্ষক থাকবে না?

চাই প্রশিক্ষিত দক্ষ শিক্ষক

ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের পাশাপাশি তাদের সঠিক প্রশিক্ষণও অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক যুগের শিশুরা কেবল মুখস্থনির্ভর শিক্ষা নয়, ব্যাখ্যামূলক ও বাস্তবজীবনভিত্তিক শিক্ষায় আগ্রহী। তাই এই শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনÑ শিশু মনোবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ, আধুনিক শিক্ষণপদ্ধতির জ্ঞান, বিশুদ্ধ কুরআন তেলাওয়াত, কুরআন-হাদিস ও ফিকাহে মজবুত দক্ষতা, নৈতিক আদর্শে দৃঢ় অবস্থান এবং নিজে ইসলাম পরিপালনকারী।

এক্ষেত্রে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস পাস ও প্রশিক্ষিত আলেমকে উপযুক্ত মনে করছি। পাশাপাশি নুরানি ট্রেনিংপ্রাপ্ত হলে কোমলমতি শিশুদের জন্য ‘নুরুন আলা নুর’ বা সোনায় সোহাগা হবে। তাহলে একদিকে যেমন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব পূরণ হবে, অন্যদিকে হাজার হাজার কওমি আলেমের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে এবং একটি ভিন্ন অঙ্গনে মনপ্রাণ উজাড় করে আগামী প্রজন্মকে গড়ে তোলার সুযোগ পাবেন। এমন একজন ধর্মীয় শিক্ষকই বিষয়গুলো শিশুদের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন।

জাতীয় ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় শিক্ষা

ধর্মীয় শিক্ষা সমাজে সহনশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবিকতা জাগ্রত করে। যদি শিশু বয়সেই ইসলাম ধর্মের আদর্শে লালিত হয়, তাহলে তারা বড় হয়ে চরমপন্থা, ঘৃণা বা সহিংসতায় জড়াবে না। ইসলাম শেখায়, ‘ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই’। এই মৌলিক নীতিটি বুঝে নিলে শিশুরা অন্য ধর্মের মানুষকেও সম্মান করতে শেখে। ফলে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামি শিক্ষা হলো সেই আলোর প্রদীপ, যা জাতিকে নৈতিক অন্ধকার থেকে মুক্ত করে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে কেন?

দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আশানুরূপ শিক্ষার্থী নেই। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে তো শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। দিন দিন এই বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। অপর দিকে বাড়ছে নুরানি ও কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী সংখ্যা। তারা শিক্ষার্থী জায়গা দিতে পারছেন না। এর প্রধান কারণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা দানের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকা। একটি মুসলিম প্রধান দেশের অভিভাবকরা স্বাভাবিকভাবেই চাইবে, তাদের সন্তানরা সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি অন্তত ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষাটুকু পাক। চরিত্র নির্মাণ, মূল্যবোধ গঠন ও ধর্মীয় বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হোক।

অপরদিকে কওমি মাদসারার প্রাথমিক স্তরে ইসলাম শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, অংক, ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গুলোও রয়েছে। সার্বক্ষণিক যত্নও পাচ্ছে অনেক গুণে ভালো। সচেতন অভিভাবক সমাজের ব্যানারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন প্রচারও দেখা গেছে, তারা বলেছেনÑ ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ না দিলে আমাদের সন্তানদের এখানে পড়াব না, তাদের মাদরাসায় নিয়ে ভর্তি করব।’ ইতোমধ্যে তো অনেকে ভর্তি করেছেনই, ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা পড়ানোর ব্যবস্থা না নিলে এই গতানুগতিক প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীশূন্য হয়ে অকেজো হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছি। কারণÑ

‘সময় এখন পাঁচ আগস্টের আগের না

বইছে বাতাস ফাগুন ফুলের, মাঘের না।’

শেষ কথা হলো, প্রায় ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ জাতীয় দায়িত্ব ও সময়ের দাবি। শিশুরা যদি ধর্মীয়ভাবে শিক্ষিত হয়; তারা সৎ, ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী এবং সমাজে শান্তি ও মানবতার দূত হয়ে উঠবে। তাই সরকারের প্রতি অনুরোধÑ প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবিলম্বে একজন করে ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিন। এটি শুধু শিক্ষাব্যবস্থাকে নয়, পুরো জাতিকেও নৈতিকভাবে শক্তিশালী করবে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম;

পরিচালক, সম্পাদনা কেন্দ্র; নির্বাহী সম্পাদক, লেখকপত্র

এনএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ