বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার বলেছেন, আমাদের জুলাই বিপ্লবের মূল প্রেরণা ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিপ্লব ও মুক্তির পক্ষে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কবিতাগুলো নজরুলের লেখা। আমাদের ছেলেমেয়েদের যে উদ্বুদ্ধ করেছে, তা বিভিন্ন গ্রাফিতি দেখলেই বোঝা যায়। আবু সাঈদরা একেকটা কাজী নজরুল।
শনিবার বিকালে রাজধানীর মিরপুর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন-২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান আলোচকের বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তাহমিনা আখতার।
বিশেষ অতিথি ছিলেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অ্যাডহক কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধি মো. শাকিল মোল্লা।
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আখলাক আহম্মদ।
প্রতিষ্ঠানটির গণিত বিভাগের সহকারী শিক্ষক ফরহাদুল ইসলাম ও বাংলা বিভাগে সিনিয়র শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় কুরআন তেলওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়।
এসময় কবি নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা ও সংগীত পরিবেশন করা হয়। এতে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাকরা অংশ নেন।
কবি আব্দুল হাই শিকদার বলেন, বেঁচে থাকার জন্য যেমন দরকার আলো বাতাস খাদ্য ও পানি, বাংলাদেশের জন্যও সেই রকম প্রয়োজনীয় নজরুল। তিনি আমাদের সাহিত্যের অধিক সাহিত্য। জীবনের অধিক জীবন। কারণ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং নজরুল এক অবিভাজ্য সত্তা। এর বিভাজন হয় না। দুধের সঙ্গে সাদা রঙ্গের যে সর্ম্পক, দেহের সঙ্গে আত্মার যেমন সর্ম্পক, সেই সর্ম্পক হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজী নজরুলের। একটার সঙ্গে একটা আলাদা করা যায় না।আবেগের সঙ্গে বেগ, প্রেম ও প্রকৃতির সঙ্গে বিপ্লব, বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞান, শ্রমজীবীর ঘামের সঙ্গে মরমিবাদ, ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার যে জ্যোতির্ময় মিশ্রণ নজরুলে, তা আর কোথাও নেই। বাংলা ভাষায় কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, আমরা যদি একটি আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ চাই, একটি স্বার্বভৌমত্ব বাংলাদেশ চাই, একটা অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই, শোষণ মুক্ত বাংলাদেশ চাই, আমরা যদি নারী মুক্তির বাংলাদেশ চাই, আমরা যদি কল্যাণ ও মঙ্গলের বাংলাদেশ চাই, তাহলে নজরুল ইসলামের বিকল্প নেই।
যদি নজরুলের জন্ম না হতো, তাহলে বাংলাভাষীরা কোনোদিন জানতেও পারত না, তার ভিজে স্যাঁতসেঁতে জলমগ্ন ভাষার ভেতরে লুকিয়ে ছিল ডিনামাইটের মতো বিধ্বংসী ক্ষমতা। বিসুভিয়াসের মতো উত্তপ্ত লাভা উদ্গিরণের ভয়াল তাণ্ডব। স্বর্গ-মর্ত্য করতলে নেওয়া গতির উন্মাতাল প্রবাহ। চিরকালের মধ্যে নজরুল হয়ে উঠলেন জাতির মূল কণ্ঠস্বর। জাতির নায়ক। মাত্র ৮ বছর সময়ের মধ্যে ভয়াবহ এবং বিস্ময়কর সব কীর্তি স্থাপন করে স্তম্ভিত করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদকে।
কবি বলেন, নজরুলের আবির্ভাবের ৮ বছর পর অর্থাৎ ১৯২৯ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ৩০ বছরের নজরুলের গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো জাতীয় কবির সম্মান। আর অনুষ্ঠানের সভাপতি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ঘোষণা করলেন, ফরাসি বিপ্লবের সময় ফরাসি জনগণ যেমন রুশো ভলটেয়ারের লেখা পাঠ করে এক একজন অতি মানবে পরিণত হয়েছিল, তেমনি নজরুলের লেখা পাঠ করেও আমাদের জনগণও একদিন অতি মানবে পরিণত হবে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস বলেছিলেন, আমরা যখন যুদ্ধে যাব তখনো নজরুলের গান গেয়ে যুদ্ধে যাব, কারাগারে যাওয়ার সময়ও গাইব নজরুলের গান। এরও বহু পরে মওলানা ভাসানী যখন শোষণবিরোধী সংগ্রাম চালাচ্ছেন তখন তিনি বলেছিলেন, অন্য অনেককে ছাড়া আমাদের চলে কিন্তু নজরুল ছাড়া আমাদের চলে না। কারণ নজরুলের প্রতিটি রচনা আসলে এক একটি যুদ্ধ ঘোষণা। এ যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের জনগণের পরম পাথেয় নজরুলের রচনা, তার কবিতা ও সংগীত। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নেতাজি সুভাষ এবং মওলানা ভাসানীর প্রতিটি কথাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। এখনো তা ধ্রুবতারার মতো অনির্বাণ দীপ্তি নিয়ে বিরাজ করছে।
আবদুল হাই শিকদার বলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য, জনগণের মুক্তির জন্য নজরুল তার জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। কিন্তু পেছনে রেখে গেছেন যে অবিস্মরণীয় সৃষ্টি সম্ভার; যার আলো ও উত্তাপ যুগ যুগ ধরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের দেখাবে পথ, জোগাবে অনুপ্রেরণা। এ কথা গতকাল যেমন সঠিক ছিল আজও তাই আছে। আগামীকালও তাই থাকবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরা নজরুল চর্চা করব আমাদের আজকের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। হাঙরের কুমিরের ঢেউয়ের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে নজরুলই আমাদের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও উপাদান। শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়; সব কালের সব ব্যথিত বঞ্চিত শোষিত মানুষের কাছে নজরুলই সবচেয়ে নির্ভুল বাতিঘর। আমাদের চেতনার অফুরন্ত উৎস।
তিনি আরও বলেন, নজরুল শুধু কবি নন, শুধু সংগীতজ্ঞ নন, শুধু আমাদের সাংস্কৃতিক পিতা নন, তিনি আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক। অন্য অনেককে বাদ দিয়ে হয়তো চলা যাবে কিন্তু নজরুলকে বাদ দেওয়া অসম্ভব। এ কথা নেতাজি সুভাষচন্দ্র এবং পরে মওলানা ভাসানী বুঝেছিলেন সেই ১৯২৯ সালে, যখন নজরুলের বয়স মাত্র ৩০। নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ কারও সঙ্গে তুলনা করে কাউকে ছোট করা উচিত না। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাথার উপরকার তারকাখচিত আকাশ। নজরুল আমার সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সুখ-দুঃখের রক্তমাংসের মাটির পৃথিবী। মেহনতি মুক্তিকামী গণমানুষের আত্মা। জসীম উদ্দিন আমাদের নকশী কাঁথার মাঠ। জীবনানন্দ আমাদের রূপসী বাংলার নিঝুম নিসর্গ। আর নজরুল সব বিবেচনায়ই আমাদের প্রাণের হাজার তারের বীণা। এসময় তিনি শিক্ষার্থীদের কবি নজরুল ইসলামকে ধারণ ও লালন করার আহবান জানান। যদি শিক্ষাথীরা তাকে ধারণ করেন, তাহলে অন্তত একজন আদর্শবান মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক তাহমিনা আখতার বলেন, কবি নজরুল তার সাহিত্যের ভাববস্তুতে সাম্য, মানুষের মুক্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মতো মূল্যবোধ সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি সব সময়ই মানুষকে জাগাতে চেয়েছিলেন এবং বাঙালি বারবার নজরুল দ্বারা উজ্জীবিত হয়েছে।
অ্যাডহোক কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধি মো. শাকিল মোল্লা বলেন, আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম একজন গানের কবি, প্রেমের কবি, মানবতার কবি। জাতীয় কবির স্মৃতি এদেশ থেকে কখনো মুছে ফেলা যাবে না। তিনি আজীবন আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।