শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫ ।। ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ ।। ১৭ মহর্‌রম ১৪৪৭

শিরোনাম :

মেসওয়াকের গুরুত্ব ও ফজিলত


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
প্রতীকি ছবি

|| মুফতি আশিকুল ইসলাম রহমতনগরী ||

মানব জীবন মর্যাদার শীর্ষে উন্নীত হওয়ার অন্যতম মাধ্যম হলো রাসুল সা. এর সুন্নত। তাইতো রাসুল সা. বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে ভালবাসবে সে আমাকেই ভালবাসবে, আর যে আমাকে ভালবাসবে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে”।  (মেশকাত শরীফ-১৭৫)

রাসুল সা.-এর ‍সুন্নতগুলোর মধ্যে প্রিয় একটি সুন্নত হলো মেসওয়াক। এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মেসওয়াকের মাধ্যমে রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। কিন্তু আফসোস, আমাদের নিকট রাসুল সা.-এর এই প্রিয় সুন্নতটি বড় অবহেলিত, এটাকে ছোট মনে করে ছেড়ে দিচ্ছি। অথচ রাসুল সা. এর বর্ণাঢ্য সীরাতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই, তিনি সুন্নতসমূহের মধ্য থেকে মেসওয়াককে বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। 

মেসওয়াক উন্নত রুচি, সুস্থ্য মস্তিষ্ক ও পরিস্কার-পরিচ্ছান্নতার সহায়ক। একজন মুমিনের ভিতর যত পরিচ্ছন্ন ও উন্নত তার বাহির তত পরিপাটি ও কলুষমুক্ত। আর পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা আভিজাত্যের পরিচয়, এবং একজন মানুষ বলতেই তার স্বভাবে পবিত্রতা অপরিহার্য অনুষঙ্গ। হাদীস শরীফে এসেছে, عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ: قَصُّ الشَّارِبِ، وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ، وَالسِّوَاكُ،
রাসুল সা. বলেছে, ১০টি বিষয় মানুষের স্বভাবজাত বিষয়।এর মধ্যে একটি হলো মেসওয়াক। (মুসলিম২৬১)

উক্ত হাদিসে মেসওয়াককে স্বভাবজাত বিষয় বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর স্বভাবজাতি বিষয়ের বৈশিষ্ট হলো তা কখনো সত্ত্বা থেকে পৃথক হয় না বরং মিশে থাকে। প্রিয় সুন্নতটির প্রতি আরো গুরুত্বারূপ করতে গিয়ে রাসুল বলেন,
لَقَدْ أَمَرْتُ بِالسِّوَاكِ، حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيَنْزِلُ بِهِ عَلَيَّ قُرْآنٌ، أَوْ وَحْيٌ "

আমাকে মেসওয়াক করার নির্দেশ এত বেশী দেওয়া হয়েছে যে, আমি আশঙ্ক করতে লাগলাম এ ব্যাপারে  আমার উপর কুরআন অথবা ওহী নাজিল হয়ে যাবে। (মুসনাদে আহমদ-৩১২২) অন্য হাদীসে এসেছে, রাসুল সা. বলেন, " أُمِرْتُ بِالسِّوَاكِ حَتَّى خَشِيتُ أَنْ يُكْتَبَ عَلَيَّ "
আমাকে মেসওয়াক করার নির্দেশ এত বেশী দেওয়া হয়েছে যে, আমি আশঙ্কা করলাম  যে, এটা আমার উপর (আবশ্যক) ফরজ হয়ে যাবে। (মুসনাদে আহমদ-১৬০০৭) রাসুল সা. আরো বলেন, أُمِرْتُ بِالسِّوَاكِ حَتَّى خَشِيتُ أَنْ أَدْرَدَ، 

আমাকে মেসওয়াক করার নির্দেশ এত বেশী দেওয়া হয়েছে যে, আমি ভাবতে শুরু করলাম  যে,  না যেন আমি আমার দাঁত ভেঙে ফেলি। (মুসনাদে বাযযার-৬৯৫২)

উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে বুঝা যায় রাসুল সা.কে মেসওয়াকের ব্যাপারে কী পরিমান তাকীদ দেয়া হয়েছে।

এই গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতটি রাসুল সা. কীভাবে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন, তার কয়েকটি নমুনা তুলে ধরা হলো,
১.  রাসুল সা. ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে মেসওয়ক করতেন,          
 শুরায়হ রহি: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আয়েশা রা. কে জিজ্ঞাসা করলাম,
" بِأَيِّ شَيْءٍ كَانَ يَبْدَأُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ بَيْتَهُ؟ قَالَتْ: بِالسِّوَاكِ
রাসুল সা. ঘরে প্রবেশ করার পর প্রথমে কী করতেন? তিনি বললেন, মেসওয়াক করতেন।(নাসায়ী-৮)
২. ভোর রাতে ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে প্রথমে মেসওয়াক করতেন। হুযায়ফা রা. বলেন, 
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «إِذَا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ، يَشُوصُ فَاهُ بِالسِّوَاكِ»
রাসুল সা. যখন রাতে (সালাত আদায়ের জন্য) জাগ্রত হতেন, তখন মেসওয়াক দিয়ে মুখ পরিস্কার করতেন। (বুখারী-২৪৫)
৩. রাসুল সা. সবসময় মেসওয়ক করতেন,
عَنْ أَبِي مُوسَى قَالَ: " دَخَلْتُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَسْتَنُّ وَطَرَفُ السِّوَاكِ عَلَى لِسَانِهِ وَهُوَ يَقُولُ: عَأْ عَأْ 
 আবু মুছা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,  আমি রাসুল সা. এর নিকট গেলাম, তখন তিনি মেসওয়াক করছিলেন আর মেসওয়াকের একপার্শ্ব তাঁর জিহবার উপর ছিলো এবং আ‘ আ‘ করছিলেন। (নাসায়ী-৩)
৪. ঘুমানোর সময় মেসওয়াক বিছানায় মাথার নিকট রাখতেন, ইবনে উমর থেকে বর্ণিত
" أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَنَامُ إِلَّا وَالسِّوَاكُ عِنْدَهُ، فَإِذَا اسْتَيْقَظَ بَدَأَ بِالسِّوَاكِ "
রসুল সা. ঘুমানোর সময় মেসওয়াক মাথার নিকট রাখতেন, ঘুম থেকে ‍জাগ্রত হয়ে প্রথমে মেসওয়াক করতেন। (মুসনাদে আহমদ ৫৯৬৯)
৫. রাসুল সা. এর জীবনের শেষ আমল ছিলো মেসওয়াক: আয়েশা রা থেকে বর্ণিত: 
عَنْ عَائِشَةَ، دَخَلَ عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ أَبِي بَكْرٍ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنَا مُسْنِدَتُهُ إِلَى صَدْرِي، وَمَعَ عَبْدِ الرَّحْمَنِ سِوَاكٌ رَطْبٌ يَسْتَنُّ بِهِ، فَأَبَدَّهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَصَرَهُ، فَأَخَذْتُ السِّوَاكَ فَقَصَمْتُهُ، وَنَفَضْتُهُ وَطَيَّبْتُهُ، ثُمَّ دَفَعْتُهُ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاسْتَنَّ بِهِ، فَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَنَّ اسْتِنَانًا قَطُّ أَحْسَنَ مِنْهُ، فَمَا عَدَا أَنْ فَرَغَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَفَعَ يَدَهُ  أَوْ إِصْبَعَهُ ثُمَّ قَالَ «فِي الرَّفِيقِ الأَعْلَى». ثَلاَثًا، ثُمَّ قَضَى، وَكَانَتْ تَقُولُ: مَاتَ بَيْنَ حَاقِنَتِي وَذَاقِنَتِي  
আব্দুর রহমান ইবনু আবু বকর রা. রাসুল সা. এর কাছে এলেন।তখন আমি রাসুল সা.কে আমার বুকে হেলান দেয়া আবস্থায় রেকেছিলাম এবং আব্দুর রহমানের হাতে তাজা মেসওয়াক ছিলো, যা দিয়ে সে দাত পরিস্কার করছিলো।তখন রাসুল সা. তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন, আমি মেসওয়াকটি নিলাম এবং তা চিবিয়ে নরম করলাম। তারপর তা রাসুল সা.কে দিলাম।তখন রাসুল সা. তা দিয়ে দাত মর্দন করলেন।আমি তাকে এর পূর্বে এত সুন্দরভাবে মেসওয়াক করতে কখনো দেখিনি।(বুখারী-৪৪৩৮)
 উপরোক্ত হাদীসগুলো দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, মেসওয়াকের গুরুত্ব অপরীসিম।আমলটিকে ছোট মনে করে আমরা তা অবহেলায় ছেড়ে দিচ্ছি, অথচ রাসুল সা. অন্তিম মূহুর্তেও মেসওয়াক করতে ছাড়েননি।

রাসুল সা. নিজে যেমন মেসওয়াকের আমল করেছেন, সাহাবায়ে কেরামগণকেও মেসওয়াক করার প্রতি জোর তাকীদ দিয়েছেন। বুখারী শরীফে আনাস রা. থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, রাসুল সা. বলেছেন, «أَكْثَرْتُ عَلَيْكُمْ فِي السِّوَاكِ» আমি মেসওয়াক সম্পর্কে তোমাদেরকে যথেষ্ট পরিমান নির্দেশ দিয়েছি। (বুখারী-৮৮৮) 

রাসুল সা. মেসওয়াকের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে গিয়ে প্রতি নামাযের সময় মেসওয়াক করতে বলেছেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সা. বলেছেন,
«لَوْلاَ أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي أَوْ عَلَى النَّاسِ لَأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ صَلاَةٍ»
আমি যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্টকর মনে না করতাম, তাহলে আমি তাদেরকে আদেশ দিতাম যাতে প্রত্যেক নামাযের সময় মেসওয়াক করে নেয়। (বুখারী ৮৮৭)
আলী রা. বলেন, মেসওয়াকের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে রাসুল সা. আমাদেরকে মেসওয়াকের আদেশ দিয়েছেন।

এছাড়াও  মেডিকেল সাইন্স অনুযায়ী মেসওয়াক করার দ্বারা মানবদেহের অনেক উপকার রয়েছে। যেমন কিডনীর পাথর প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, এলার্জি, মুখের ব্রুণ ও কালো দাগ দূরিভীত করে।মাথা ব্যথা নিরাময় করে, মন-মস্তিস্ক ও দেহ সতেজ রাখে, দাতের মাড়ি শক্ত হয়, মেধা বৃদ্ধি হয়, হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়, ইত্যাদি।

সর্বোপরি মেসওয়াক হলো রাসুল সা. এর একটি প্রিয় সুন্নত, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির মাধ্যম ও মুখ পবিত্রতার উপকরণ এবং মৃত্যুর সময় ঈমান নসীব হয়।নিজের স্বভাব ও  উন্নত রুচির পরিচায়ক।অবহেলা করে যেন নিজেদের থেকে সুন্নতকে বিলীন করে না দেই।কাল কেয়ামতের কঠিন মুসীবতের সময় এই প্রিয় সুন্নত আমলগুলোয় আমাদের নাজাতের ওসীলা হতে পারে।তাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই কখনো কোনো সুন্নত স্বেচ্ছায় তরক করবো না ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে এই প্রিয় সুন্নটির উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: মুফতি ও মুহাদ্দিস, মারকাযুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া উত্তর বাড্ডা ঢাকা।
নায়েবে মুফতি, জামিয়াতুস সুন্নাহ ঢাকা।
সিনিয়র মুফতি, মারকাযুত তালীম আল ইসলামী গুলশান, ঢাকা।

এমএম/ 


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ