মধ্যপ্রাচ্যের চলমান অস্থিরতা নিয়ে নতুন এক বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন তুরস্কের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক লেভেন্ত গুলতেকিন। তার মতে, দখলদার ইসরাইল এই অঞ্চলে কোনো শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র টিকে থাকুক তা চায় না। ইরাক ও সিরিয়ার পর এবার ইরান ও তুরস্ককে খণ্ডবিখণ্ড করার ষড়যন্ত্র করছে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, “ইসরাইল এখন নতুন মধ্যপ্রাচ্য গঠনের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।”
রোববার (২ নভেম্বর) ইরানি বার্তাসংস্থা ইরনা জানিয়েছে, লেভেন্ত গুলতেকিন তার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় এসব মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “ইরান ইস্যু আজ পশ্চিম এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা। এই ইস্যুর মধ্যে তুরস্কও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইসরাইলের লক্ষ্য হলো এই দুই দেশকেও দুর্বল করা, যাতে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে কোনো ঐক্যবদ্ধ শক্তি না থাকে।”
গুলতেকিনের বক্তব্য অনুযায়ী, ইসরাইল ও তার মিত্ররা বহু বছর ধরেই একে একে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে দুর্বল করছে। তিনি বলেন, “প্রথমে তারা ইরাককে ভেঙে দিয়েছে, এরপর সিরিয়াকে। এখন তাদের পরিকল্পনা ইরান ও তুরস্ককে নিয়ে। ইসরাইল চায় এই অঞ্চলটিতে এমন কোনো দেশ টিকে না থাকুক, যা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে বা পশ্চিমা চাপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এই পরিকল্পনাই আজ নতুন আকারে ফিরে এসেছে গাজা সংকটের পর। বিশ্ব যখন গাজা যুদ্ধবিরতির কথা বলছে, তখন ইসরাইলের দৃষ্টি কিন্তু গাজার বাইরে— ইরান ও তুরস্কের দিকে। গাজা সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, কিন্তু এরপরই শুরু হবে নতুন অস্থিতিশীলতার অধ্যায়।”
তুর্কি এই বিশ্লেষক ব্যাখ্যা করে বলেন, “ইসরাইল এখনো তার মূল পরিকল্পনা থেকে সরে আসেনি—এ অঞ্চলের শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে বিভক্ত করা। তারা মনে করে, রাষ্ট্রগুলো যত ছোট হবে, তত সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ইরান ও তুরস্ক তাই এখন ইসরাইলি নীতির নতুন টার্গেটে পরিণত হয়েছে।”
গুলতেকিন আরও দাবি করেন, ইরানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের শত্রুতা আবারও তীব্র হয়েছে। তিনি বলেন, “ওয়াশিংটন ও তেলআভিভের এই বিরোধিতা কেবল পরমাণু কর্মসূচি বা শাসনব্যবস্থা নিয়ে নয়— বরং ইরানকে তিন বা চারটি ভাগে ভেঙে দেওয়ার এক গভীর পরিকল্পনা এর সঙ্গে জড়িত।”
তিনি এ সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্পর্ক নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। গুলতেকিন বলেন, “ট্রাম্প প্রতিটি বক্তৃতায় এরদোগানের প্রশংসা করেছেন এবং তুরস্কের সেনাবাহিনীর শক্তির কথা বলেছেন। কিন্তু এই প্রশংসার আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। ইতিহাস বলছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশংসা করে যাদের, তাদেরই একসময় নিজের স্বার্থে দুর্বল করে দেয়।”
তার বিশ্লেষণে তিনি আরও বলেন, “তুরস্ক নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও ঐতিহাসিক কৌশলগত অবস্থানের দেশ। সিরিয়া ইস্যুতে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ইসরাইল এখন চায় তুরস্ককেও এমন এক অভ্যন্তরীণ সংকটে ফেলতে, যাতে তার সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
গুলতেকিনের বক্তব্যে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির গভীর অস্থিরতার ইঙ্গিত মেলে। তিনি বলেন, “নতুন মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা কেবল মানচিত্রের রূপান্তর নয়— এটি মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ধ্বংসের পরিকল্পনা। ইরানকে টুকরো করা আর তুরস্ককে অস্থিতিশীল করা— এই দুই লক্ষ্য পূরণ করতে পারলেই ইসরাইল নিজেকে নিরাপদ মনে করবে।”
উল্লেখ্য, লেভেন্ত গুলতেকিন অতীতেও ইরানের দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্যের প্রশংসা করেছেন। তিনি একবার বলেছিলেন, “ইরানিরা এই অঞ্চলের জনগণকে দেখিয়েছে, কীভাবে মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ও ঐক্য এক জাতিকে টিকিয়ে রাখতে পারে।”
তথ্যসূত্র : ইরনা
এরএইস/