শনিবার, ০১ নভেম্বর ২০২৫ ।। ১৬ কার্তিক ১৪৩২ ।। ১০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিরোনাম :
ইসলামিক দলগুলো ছাড়া অন্য দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই : হাসনাত আবদুল্লাহ খতমে নবুওয়ত মহাসম্মেলন সফল করতে গোপালগঞ্জে ওলামা-মাশায়েখ  সম্মেলন অনুষ্ঠিত সৌদির শাসকদের নিয়ে যা বললেন গ্র্যান্ড মুফতি কওমি শিক্ষার্থীদের দেশ-জাতির সেবায় নিয়োজিত করার বিষয়টি কোথায় আটকে আছে? ৪ দিনের কর্মসূচির ঘোষণা প্রাথমিক শিক্ষকদের আলী রীয়াজসহ সংস্কার কমিশনের সব সদস্যকে গ্রেফতার করতে হবে: মাওলানা ইউসুফী আমরা মওদুদি ইসলাম নয়, মদিনার ইসলামের অনুসারী: সালাহউদ্দিন নতুন বাংলাদেশ গড়তে ইসলামী আদর্শের দিকে ফিরে আসতে হবে: প্রফেসর মুজিবুর রহমান জুলাই সনদ দ্রুত বাস্তবায়ন করে দেশ ও শ্রমিকদের অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা করুন: ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন  জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট না হলে ফ্যাসিবাদ পুনরায় মাথা চাড়া দিবে 

আগুনে জ্বলছে সুদান, নীরব পৃথিবীর বিবেকহীনতা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

পৃথিবীর মানচিত্রে সুদান এখন কেবল একটি রাষ্ট্র নয়, এটি মানবতার ভগ্ন আয়না। প্রতিদিন সেখানে ধ্বংসের নতুন ভাষা লেখা হচ্ছে, যেখানে শিশুর কান্না, মায়ের আর্তনাদ, আর ভস্মীভূত ভবনের ধোঁয়া মিলেমিশে এক বিকৃত বাস্তবতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। রাজধানী খার্তুম থেকে শুরু করে দারফুরের বিস্তীর্ণ মরুভূমি—সবখানেই যুদ্ধ এখন এক মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের জীবন আজ পরিসংখ্যান, মৃত্যু এখন খবরের এক লাইনে সীমাবদ্ধ।

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই গৃহযুদ্ধ, মূলত সুদানের সেনাবাহিনী (Sudanese Armed Forces—SAF) ও আধাসামরিক Rapid Support Forces (RSF)-এর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই। কিন্তু এই যুদ্ধের প্রকৃত ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই সংঘর্ষে কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কয়েক মিলিয়ন মানুষ দেশছাড়া হয়েছে। হাসপাতালগুলো পরিণত হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে, খাদ্য ও ওষুধের অভাবে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। শহরগুলো ধ্বংসস্তূপ, শিশুদের ভবিষ্যৎ মুছে যাচ্ছে ধুলোয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি জানায়, পশ্চিম কুরদোফানের একটি হাসপাতালে বিমান হামলায় ৪০ জনেরও বেশি নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে। আকাশ থেকে ফেলা বোমা আর মাটিতে ছোঁড়া গুলি এখন একে অপরের সঙ্গী। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, RSF ও SAF উভয়পক্ষই নির্বিচারে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা চালাচ্ছে—বাজারে, মসজিদে, স্কুলে। এক রিপোর্টে বলা হয়, দারফুর অঞ্চলে নারীদের ওপর সংঘটিত যৌন সহিংসতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে সেটি আর “অস্ত্র” নয়, বরং “অস্ত্রের কৌশল” হয়ে গেছে।

এই নিষ্ঠুর বাস্তবতা কেবল সুদানের নয়; এটি আমাদের পুরো সভ্যতার নৈতিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন, আরব লীগ—সবাই নিন্দা জানাচ্ছে, কিন্তু নিন্দা কখনও লাশকে ফেরাতে পারে না, ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে অন্ন তুলতে পারে না। আন্তর্জাতিক মহল বারবার “সংলাপ” আর “সমঝোতা”র কথা বলছে, কিন্তু গোলাগুলির নিচে চাপা পড়ছে প্রতিটি শব্দ। শান্তির আহ্বান এখন ব্যঙ্গের মতো শোনায়—যেন কেউ আগুনের মাঝে বসে পানি নিয়ে কবিতা লিখছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, “সুদানে যুদ্ধাপরাধ এখন নিয়মিত ঘটনা। বেসামরিকদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো, ধর্ষণ, গণহত্যা, এবং খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা—এসবই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের জঘন্য উদাহরণ।” একইভাবে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের ভাষায়, “দায়বদ্ধতার অভাব এই যুদ্ধকে টিকিয়ে রাখছে।” অর্থাৎ, অপরাধীরা জানে—তাদের বিচার হবে না। এটাই আজকের পৃথিবীর নীরব লজ্জা।

যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো—এটি মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। একদিন যাদের সঙ্গে রুটি ভাগ করা হতো, আজ তারা একে অপরের দিকে বন্দুক তাক করছে। সুদানের মানুষ আজ অভিশপ্ত ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আবারও ছিন্নমূল। হাজারো নারী ধর্ষণের শিকার, শত শত শিশু নিখোঁজ, এবং লক্ষ লক্ষ পরিবার সীমান্তের ওপারে আশ্রয় খুঁজছে। ইউনিসেফ সতর্ক করেছে—সুদান এখন বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি।

তবুও পৃথিবী চুপ। সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, কিন্তু দ্রুত হারিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিজের স্বার্থে ব্যস্ত, আর মানবতা যেন নিঃশব্দে নির্বাসনে চলে গেছে। এই নীরবতা কেবল কূটনৈতিক নয়, এটি নৈতিকও। কারণ আমরা সবাই জানি—যখন অন্যত্র মানুষ মরছে, তখন আমাদের নীরবতা সেই হত্যারই অংশ।

সুদানে এখন প্রতিটি ভোর মানে অনিশ্চয়তা, প্রতিটি রাত মানে আতঙ্ক। তবুও কিছু মানুষ বেঁচে আছে আশায়—যেন কেউ কোথাও থেকে ফিরে আসবে ন্যায়বিচার নিয়ে। কিন্তু সেই ন্যায়বিচারের পথ এখন এতটাই দূর, এতটাই ধুলোমলিন, যে হয়তো ইতিহাস একে আর চিনবেও না।

এই যুদ্ধ কেবল ক্ষমতার লড়াই নয়, এটি মানবতার মৃত্যুশয্যা। যারা আজ বোমা ফেলছে, তারা হয়তো ভাবছে—তারা জিতছে। কিন্তু বাস্তবে তারা হারাচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস—নিজেদের আত্মা। আর যারা দূরে বসে কেবল দেখছে, তারাও নীরবভাবে এই অপরাধের সাক্ষী হয়ে যাচ্ছে

পৃথিবী যদি এখন না জাগে, তাহলে আগামীকাল ইতিহাস জিজ্ঞেস করবে—সুদানে যখন মানুষ মরছিল, আমরা কোথায় ছিলাম? সেই প্রশ্নের উত্তর তখন কেবল একটাই থাকবে—আমরা ছিলাম নির্লিপ্ত, নীরব, আর অপরাধের অংশীদার।

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর

আরএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ