মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী
পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা নদী, মেঘে ঢাকা শিখর আর ঝরনার কলতান—প্রকৃতির এ রূপ দেখতে চাইলে যেতে হবে বান্দরবানে। অল্প সময়ের ভ্রমণ হলেও এখানে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই মনে গেঁথে থাকে দীর্ঘদিন। দুই দিনের সফরে ঘুরে এলাম এ পাহাড়ি জেলার নীলগিরি, নীলাচল, চিম্বুক পাহাড়সহ আরও কয়েকটি দর্শনীয় স্থান।
আমার কর্মস্থল উত্তরার মাইলস্টোন কলেজ। কলেজ ছুটি মানেই ঘুরে আসার সেরা সময়। গত ২৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ব্যস্ত নগরীর ক্লান্তিকর সপ্তাহ শেষে আমি পা বাড়ালাম পাহাড়ের শহর বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। রাতের বাসে চড়ে রওনা দিয়েছিলাম, মনে ছিল অফুরন্ত কৌতূহল আর আনন্দের প্রত্যাশা। বাসের জানালা দিয়ে রাতের অন্ধকারে আলোকিত মহাসড়ক পেরিয়ে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল, সামনের যাত্রা হবে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার। পাহাড়, নদী আর মেঘের সঙ্গে কাটবে পরবর্তী দু’টি দিন।
২৭ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল ৮টায় পৌঁছলাম বান্দরবান শহরে। চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা শহরটি যেন সবুজের আচ্ছাদনে জেগে উঠেছে। দেরি না করে নাস্তা সেরেই সকালেই শুরু হলো আমাদের ভ্রমণ। আমরা ২ জন সহকর্মী। সাথে যুক্ত হলো বান্দরবানের অধিবাসী আমাদের সাবেক শিক্ষার্থী মং মং প্রু মারমা। সারাদিনের জন্য একটি সিএনজি থ্রি হুইলার ভাড়া করে নিলাম। প্রথমে ঘুরলাম বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়—পাহাড়ি প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা অনন্য এক ক্যাম্পাস। এরপর যাত্রা প্রান্তিক লেকে, যেখানে নীরবতা আর নীল জলের মায়া মন ভরিয়ে দেয়। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা এ লেক যেন পাহাড়ের বুক চিরে গড়ে ওঠা এক নীল জলরাশি। লেকের চারপাশের নীরবতা ভ্রমণপিপাসু মনে এনে দেয় অদ্ভুত প্রশান্তি।
দুপুরের পর দেখা হলো মেঘলা পর্যটনকেন্দ্র, পাহাড়, কৃত্রিম লেক আর ঝুলন্ত সেতুতে সাজানো এক জনপ্রিয় স্পট। এখান থেকে অল্প দূরেই অবস্থিত নীলাচল ভিউ পয়েন্ট। পাহাড়ি শহর বান্দরবানকে প্রায় ২০০০ ফুট উপর থেকে এক নজরে দেখার দুর্লভ সুযোগ মেলে এখানেই। দিন শেষে নীলাচল ভিউ পয়েন্ট থেকে শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। নীলাচল থেকে বান্দরবান শহর ও আশপাশের পাহাড়ি অঞ্চল একসাথে দেখা যায়। উপরে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, পুরো পৃথিবী যেন হাতের মুঠোয় ধরা। পাহাড়ের গায়ে মেঘের আছড়ে পড়া, শহরের নীচু জমির দৃশ্য আর দূরে দিগন্ত ছোঁয়া পর্বতমালা—সবকিছু মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত ছবি। তারপর গেলাম বান্দরবান শহরের সন্নিকটেই সাঙ্গু নদীর তীরে। মেঘের ভেলায় ভাসা পাহাড় আর নদীর শান্ত সৌন্দর্যে দিনটি হয়ে উঠল পরিপূর্ণ।
২৮ সেপ্টেম্বর রবিবার ভোরেই ভাড়ায় নেয়া সিএনজি চালিত থ্রি হুইলারে করে যাত্রা শুরু নীলগিরির পথে। পথটা পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে গেছে দুই পাশে ঘন সবুজের মাঝখান দিয়ে; কোথাও শুধু একপাশে বন অন্য পাশে খাড়া নেমে গেছে পাহাড়ের ঢাল। কোলাহলবিহীন এই রাস্তায় যেতে কখনও মনেই হবে না যাতায়াতে ক্লান্তি আসে, বরং বেশ উপভোগ করা যায়। সিএনজি ড্রাইভারের অসামান্য দক্ষতায় আকাবাকা পাহাড়ি পথ ধরে সকাল ৮টার মধ্যেই নীলগিরি পৌঁছে গেলাম। মেঘের রাজ্যে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার অনুভূতি পাওয়া যায় নীলগিরিতে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সড়ক বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে মেঘের রাজ্যে প্রবেশ করার অনুভূতি হচ্ছিল। নীলগিরিতে দাঁড়িয়ে যখন চারপাশে তাকালাম, চোখে ভেসে উঠল অসীম সবুজ পাহাড়ের সারি আর ভাসমান মেঘের খেলা। প্রকৃতির এত কাছাকাছি আসার সৌভাগ্য হয়তো জীবনে ঘন ঘন আসে না। সেখানে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই ছিল অপূর্ব ও অবিস্মরণীয়।
এরপর নীলগিরি থেকে ফেরার পথে একে একে ঘুরে দেখলাম ডাবল হ্যান্ড ভিউ পয়েন্ট ও টাইটানিক ভিউ পয়েন্ট। পাহাড়ি গায়ে গড়ে ওঠা এসব ভিউ পয়েন্ট থেকে চারপাশের অপার সৌন্দর্য চোখে বন্দি করে রাখা যায় না। দুপুরের আগে উঠলাম বিখ্যাত চিম্বুক পাহাড়ে। বান্দরবানের অন্যতম উচ্চতম এই পাহাড় থেকে দূরের দিগন্ত পর্যন্ত দেখা যায়, যা ভ্রমণকে করে তোলে রোমাঞ্চকর।
বিকেলের দিকে যাত্রা হলো শৈলকুপা জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে। ঝিরি পথ বেয়ে নেমে আসা পানির শব্দ, চারপাশের শীতল পরিবেশ—সব মিলিয়ে জলপ্রপাতের কাছে কাটানো মুহূর্তগুলো ছিল একেবারেই অন্য রকম।
এই দুই দিনে আরও কয়েকটি দর্শনীয় স্পট ঘুরে দেখেছি। প্রতিটি জায়গাতেই প্রকৃতির অন্য রূপ, অন্য সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে। স্থানীয় পাহাড়ি মানুষের সরলতা, তাদের আন্তরিক হাসি আর পাহাড়ি খাবারের স্বাদ ভ্রমণকে করেছে আরও প্রাণবন্ত।
রাতের বাসে ঢাকার পথে ফিরলেও মনে রয়ে গেল দুই দিনের অসংখ্য রঙিন স্মৃতি। পাহাড়, ঝরনা আর মেঘমালা—সব মিলিয়ে বান্দরবান ভ্রমণ সত্যিই ছিল এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। দুই দিনের এ যাত্রা শেষ হলেও মনে রয়ে গেছে অসংখ্য স্মৃতি। বান্দরবান শুধু ভ্রমণ নয়, প্রকৃতির সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ আলাপ, যা বারবার আমাকে আবার ডাকবে ফিরে যেতে।
এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় মহান আল্লাহ কত অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। তার সৃষ্টি কেবল উপকারই নয়, বরং চরম সৌন্দর্যেও পূর্ণ। প্রকৃতির এমন প্রতিটি দৃশ্য যেন এক একটি আয়াত, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ‘আল্লাহ তাআলা সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং জ্ঞান ও হিকমতের অধিকারী।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক
আরএইচ/