মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ২১ শাওয়াল ১৪৪৫


মুহিব খানের ‘কাব্যানুবাদ’ নিয়ে মুসা আল হাফিজের আপত্তি


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মুসা আল হাফিজ ||

এক কবি আল কুরআনের অনুবাদ করেছেন কবিতার মাধ্যমে।তিনি أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ এর অনুবাদে লিখেছেন, আশ্রয় চাহি আল্লাহর, যেন শয়তান দূরে রয়। আর  ﷽ এর অনুবাদ করেছেন  শুরু করিলাম আল্লাহর নামে, দয়ালু-করুণাময়। আপনি পাঠক। আলিম নন। আপনার কাছে খুব ভালো লেগেছে। আপনি খুশি। কবিতার মাধ্যমে কুরআনের অনুবাদ পড়তে পারলাম।

কিন্তু যিনি আলিম, তিনি এই অনুবাদ পড়ে বিচলিত, সন্ত্রস্থ । কারণ এখানে কুরআনের ভুল অনুবাদ করা হয়েছে। শুধু ভুল অনুবাদ নয়, বরং কবিতার প্রয়োজনে কুরআনের অর্থে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে।আর রাজিম এর তর্জমাকে একদম পরিহার করা হয়েছে। রাহমান ও রাহিম এর যথোচিত  অনুবাদকে উপেক্ষা করা হয়েছে। যে বিষয়ের প্রতি সকল অনুবাদক সচেতন, দায়িত্বশীল, যত্নবান।

 আবার সূরা ফাতেহায় - 
ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ-  এর অনুবাদে কবি  লিখেছেন দয়ালু মহানুভব। 
স্পষ্ট বিকৃতি। আর রাহিম এর অর্থ মহানুভব? এই শব্দ দিয়ে আর রাহিম এর তর্জমা হয়ে যায়?

আপনি বলবেন , কবিতার প্রয়োজনে কিছু পরিবর্তন বা হ্রাসকরণ তো হতেই পারে। এটা আপনি বলছেন কুরআনের সংজ্ঞার সাথে পরিচয় না থাকার কারণে । কুরআন হচ্ছে শব্দ ও অর্থের সমষ্টি। কুরআনের শব্দে বিকৃতি ঘটালে যেমন কুরআন বিকৃত হয়, অর্থে বিকৃতি ঘটালেও কুরআন বিকৃত হয়।

এই বিকৃতি যাতে না ঘটে, সেজন্য কবিতার মাধ্যমে কুরআনের অনুবাদের বিরুদ্ধে ফিকহে্র কিতাবে কঠিন, কঠোর শতর্কবাণী রয়েছে। বেশির ভাগ ফকিহ একে নাজায়েজ বলেছেন।

যারা একে জায়েজ বলেছেন, তাদের সংখ্যা খুবই কম। তারাও বহু শর্ত সহকারে এর বৈধতা দিয়েছেন। তাদের প্রধান শর্ত হচ্ছে কবিতার প্রয়োজনে কুরআনের কোনো শব্দের অর্থকে বাদ দেওয়া  যাবে না, অর্থকে বিকৃত করা যাবে না, কুরআনের শব্দের মানসুস ( অকাট্য দলিলে   প্রমাণিত) অর্থকে এক পাশে রেখে অন্য অর্থ নেওয়া যাবে না। যদি এমনটি করা হয়, তাহলে সেই কাব্য অনুবাদ কোনোভাবেই বৈধ নয়, হালাল নয়।  বরং এমন কাব্যানুবাদের জন্য তারা শক্ত কঠোর শাস্তিবাণীও উচ্চারণ করেছেন।

এমনতরো ফতোয়া যেসব কিতাবে আছে, তার সংখ্যা বিপুল , এসব কিতাব সালাফের হাত দিয়ে রচিত হয়েছে।

যে অনুবাদের নমুনা দেখালাম, এটা মুহিব খানের কাব্যানুবাদে আছে। এখন আলেমরা যদি ফিকহের দাবিতে কুরআনের শুদ্ধতার প্রশ্নে কথা বলেন, সেটাকে আপনার শ্রদ্ধা করা উচিত। আলেমরা কুরআনের অর্থবিকৃতির অধিকার কোনো কবির হাতে তুলে দেবেন, সেটা ভাবা অন্যায়।

 তার অনুবাদে এমন সমস্যা রয়েছে বিস্তর।  কবিতার প্রয়োজনে আল্লাহর বাণীতে হ্রাস-বৃদ্ধি বা অর্থে রূপান্তরের  নজির ছড়িয়ে আছে পৃষ্ঠায় -পৃষ্ঠায়। সূরা বাকারার প্রথম পৃষ্ঠা থেকে  একটা নমুনা  লক্ষ্য করুন ।

وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ

এর তর্জমায় লেখা হয়েছে- তাহাদের তরে রয়েছে আযাব চরম শাস্তি তারি/কেননা তাহারা চরম মিথ্যাচারী । এখানে عَذَابٌ أَلِيمٌ বা চরম যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি কথাটায় আল্লাহ নিদের্শক কোনো যমীর  নেই। ফলে তারি কথাটা এখানে প্রক্ষেপণ। এ প্রক্ষেপণ কেন দরকার হলো? কাব্যের কারণে। এটাই নিষিদ্ধ। আর এখানে يَكْذِبُونَ এর অর্থেও ব্যাকরণ লঙ্ঘণ হয়েছে।  ইয়াকযিবুন কথাটা দিয়ে কাযিবুন এর   অর্থ তোলা হয়েছে কাব্যের প্রয়োজনে। একে ব্যাখ্যা হিসেবে আনতে চাইলে তর্জমায় নয়, ব্রাকেট দিয়ে আলাদাভাবে আনতে পারেন।

وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

এর তর্জমায় লেখা হয়েছে তাহাদের তরে রয়েছে আযাব চরম শাস্তি তার। (এখানেও আযাবের সাথে আল্লাহকে বুঝায় এমন কোনো যমীর নেই, ফলে তার কথাটা হলো প্রক্ষেপন। কাব্যের প্রয়োজনে এটা ঘটেছে। )

إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ

এর তর্জমায় লেখা হয়েছে শান্তি স্থাপনকারী আমরাই নির্দোষ নিশ্চয়। 
(এখানে নির্দোষ কথাটা প্রক্ষেপন।ব্যাখ্যা হিসেবে একে আনার অবকাশ আছে। কিন্তু তা আনতে হবে আলাদাভাবে)

 أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلَـٰكِن لَّا يَعْلَمُونَ

এর তর্জমায় লেখা হয়েছে সাবধান এরা নিজেরাই বোকা, কিন্তু জানে না হায়।

(এখানে হায় কথাটা  বাড়ানো হয়েছে। কাব্যের প্রয়োজনে কুরআনের অনুবাদে এটা  প্রক্ষেপণ।  একেও ব্যাখ্যা হিসেবে আনা যেতে পারে বড়জোর। কিন্তু তর্জমা হিসেবে নয়)

দুই.
কিন্তু আমরা কেবল তার অনুবাদ নিয়ে কথা বলছি না। তার আগে বাংলা ভাষায় আল কুরআনের কাব্যানুবাদ করেছেন অনেকেই। একটা মিথ্যা কথা প্রচার হয়েছে যে, তার আগে বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ কাব্যানুবাদ হয়নি কুরআনের।  অনেকগুলো পূর্ণাঙ্গ কাব্যানুবাদ প্রকাশিত  হয়েছে ইতোপূর্বে।

 ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় কবি পান্না চৌধুরীরর ছন্দোবদ্ধ বাংলা কোরআন (রকমারিতে পাবেন, এর পিডিএফও পাওয়া যায়) ।   ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়  'পবিত্র আল কোরআনের পুঁথি অনুবাদ', অনুবাদক  মাওলানা আব্দুল হামিদ কাসেমী।

প্রকৌশলী কাজী আকবর শাহ এর কাব্যে আল কুরআন দুই খণ্ডে  প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। প্রফেসর মুহা: মনসুর উর রহমানের আল কোরআন বাংলা কাব্যানুবাদ প্রকাশিত হয় তিন খণ্ডে, ২০০৬ , ২০১৮ ও ২০২১ সালে।

 মোসাম্মত ফাতীমা কবীরের কুরআনের সহজ-সরল কাব্যানুবাদ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে,  বিশিষ্ট কবি আ. শ. ম. বাবর আলীর কাব্যে আল কুরআন প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে।  

সাম্প্রতিক এই অনুবাদের সবগুলোই আল কুরআনের পূর্ণাঙ্গ কাব্যানুবাদ। একটা অনুবাদে কবিতার পাশাপাশি গদ্যেরও আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

এই অনুবাদগুলো প্রকাশিত হবার পরে মুহিব খানের কাব্যানুবাদ প্রকাশিত হয়। অন্য অনুবাদকদের কেউই নিজের কাজকে এতো বড় আকারে উপস্থাপন করেননি, যেটা করেছেন খান।  প্রথমে তার কাজকে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাব্যানুবাদ বলে দাবি করেছেন তাঁর বড় ভাই।

স্বাভাবিকভাবেই কওমির হাজার হাজার শিক্ষার্থী এতে আবেগে বিহ্বল হয়েছেন ।  এ জাতীয় দাবির মাধ্যমে ফায়দা হয় না আসলে।

এর পর থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলা ভাষার প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের প্রচারণা চলছে। এজন্য বড় বড় লকব,  পদক ও সম্মাননার দাবি-দাওয়া তো চলছেই।

তিন. বাংলা ভাষায় আল কুরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাব্যানুবাদ প্রকাশিত হয়    ১৯০৭ সালে। এর লেখক ছিলেন   আবদুল ছাত্তার সুফী। এতে তিনি ত্রিপদী ছন্দ ব্যবহার করেন।  কলকাতা থেকে অনুবাদটি প্রকাশিত হয়। এতে ছন্দকাব্যের  পাশাপাশি কাব্যিক গদ্যও ব্যবহার করা হয়েছে।  

এ ঘটনার ৪২ বছর আগে প্রথম আংশিক কাব্যানুবাদ প্রকাশিত হয় । কাজটি করেন  মওলানা  আকবর আলী।  ১৮৬৫ সালে কাব্যে প্রকাশিত হয়    আমপারা ও সুরা ফাতিহার অনুবাদ। এরপর আংশিক কাব্যানুবাদ করেছেন অনেকেই।

 পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ  যারা করেন , তাদের মধ্যে আছেন  মাওলানা খোন্দকার আবুল ফজল আবদুল করিম (১৮৭৬-১৯৪৭)। টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণকারী খোন্দকার আবদুল করিম ১৯১৪ সালে ‘কোরআন’ নামে বাংলা ভাষায় পবিত্র কোরআন অনুবাদ করেন এবং টাঙ্গাইল থেকে মুদ্রণ করে প্রকাশ করেন। এতে পদ্য ও গদ্যের মিশ্রণ ছিলো। শুরুর দিকে  নিরঙ্কুশ গদ্য ছিলো,    তবে শেষের দিকে কেবলই পদ্য ছিলো।

মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী লিখেন আরেকটি কাব্যানুবাদ।  কক্সবাজার জেলায় জন্মগ্রহণকারী মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীর ‘মহা কোরআন কাব্য’ প্রকাশিত হয়  ১৯২৭ সালে,  কলকাতা থেকে।  তিনিও  গদ্য ও পদ্য—দুই রীতি ব্যবহার করেন।

 এই অনুবাদকগণ ছিলেন বিজ্ঞ আলেম। তারা কবিতার পাশাপাশি গদ্যও অবলম্বন করেছেন সম্ভবত  ফিকহি আপত্তির প্রতি নজর রেখে।

তবে নিরঙ্কুশ কাব্যে আল কুরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন রাজশাহীর গোদাগাড়ির মুহাম্মদ  খলিলুল্লাহর। তার  পূর্ণাঙ্গ কাব্যানুবাদ প্রকাশিত হয় 1997 সালে।  এর নাম ছিলো   'ভাবানুবাদে কাব্যে কোরান। পুরো কুরআনের কাব্যানুবাদ ছিলো এটা। তিনি নানা ক্ষেত্রে সতর্ক থেকেছেন। তার কাজটির নামের প্রতি তাকালে তা লক্ষ্য করা যায়;  ভাবানুবাদে কাব্যে কুরআন !

চার. এই সব কাব্যানুবাদের যেগুলোতে আমার নজর বুলানোর সুযোগ হয়েছে, সবখানেই কম-বেশি কাব্যের কারণে কুরআনের অর্থে  আপোষ করা হয়েছে। যারা কম আপোষ করেছেন, তারা কাব্যানুবাদে পুরোপুরি কাব্যলগ্ন থাকতে পারেননি। ফলে অনেকেই গদ্যের আশ্রয় নিয়েছেন।  তবে কেউ কেউ দাবি করেছেন, তারা আল কুরআনের সরাসরি কাব্যানুবাদ করেন নাই,  ভাবের অনুবাদ করেছেন।

কুরআনের কাব্যানুবাদের প্রশ্নে ফকিহদের নেতিবাচক অবস্থান কারণহীন নয়। সমস্ত কিছু যাচাই-বাছাই করে এবং সমস্ত ইল্লত ও দালায়িল সামনে রেখে শরিয়তের চাহিদাকে তারা উপস্থাপন  করেছেন।

সালাফ কখনো কাব্যের মাধ্যমে কুরআনের অনুবাদকে পছন্দ করেননি। সেখানে  আলেমদের অবস্থান থাকলে   তাকে কেউ যদি  খারাপ অভিধায় আখ্যায়িত করেন, সেটা তার নিজস্ব সমস্যা, আলেমদের নয়।


সম্পর্কিত খবর