শনিবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৫ ।। ২ কার্তিক ১৪৩২ ।। ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৭


ইমারাতে ইসলামিয়া সফরের অভিজ্ঞতা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মামুনুল হক

আমাদের ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান সফরটা মানুষের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টিকারী একটা সফর। এক দিক থেকে এটা একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়ও ছিল। তবে বরাবরই আলহামদুলিল্লাহ চ্যালেঞ্জ নিতে আমি বেশি একটা ভয় করি না। আল্লাহ পাকের মেহেরবানি। এ ক্ষেত্রেও আমার মধ্যে কোনো দ্বিধা এবং জড়তা কাজ করেনি। আফগানিস্তান সফরের অভিজ্ঞতা খুব সংক্ষিপ্তভাবে বলাটা আসলে খুব কঠিন। কারণ সেখানে আমরা যা কিছু দেখেছি, আমরা যা কিছু বুঝেছি, অনুভব করেছি, একটা সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতাই আমাদের হয়েছে। আফগানিস্তানের মৌলিক যে অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের হয়েছে তার মধ্যে প্রথম বিষয়টি হলো- সেখানে ইসলামি শরিয়াহকে অনুসরণ করে পূর্ণাঙ্গ শতভাগ ইসলামের মূলনীতি কুরআন-সুন্নাহর বিধিবিধানকে ফলো করে আধুনিক যুগে একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা তারা পরিচালনা করছে। ইসলামের বিধান পালনের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কোনো মানসিকতার তাদের মধ্যে নেই। তারা পরিপূর্ণই শরিয়াহ মোতাবেক যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টা নজর কাড়ে, সেটা হলো- প্রায় ৩০ জনের মন্ত্রী পরিষদ। তার ৯৫% বা ২-৩ জন বাদে সবাই মাদরাসাপড়ুয়া আলেম। কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত। দেওবন্দি সিলসিলায় তারা পড়াশোনা করেছেন। কেউ পাকিস্তান থেকে কেউ আফগানিস্তান থেকেই। আর দুই একজন আছেন যারা হয়ত বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় পড়াশোনা করেছেন। সম্পূর্ণ একটা সরকারব্যবস্থাই পরিচালিত হচ্ছে কওমি মাদরাসার আলেমদের মাধ্যমে। এটা হলো একটা দেখার বিষয়।

তৃতীয় যে বিষয়টা আমাদের জন্য লক্ষণীয় ছিল, সেটা হলো- সেই রাষ্ট্রের নিয়মনীতি, বিধিমালা, ইভেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের যে চুক্তি এবং দ্বিপাক্ষিক তাদের যে চুক্তি হয়েছে, এমনকি ‘দোহা চুক্তি’ যেটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুবই পরিচিত এবং তাৎপর্যপূর্ণ; এ বিষয়গুলোকে শতভাগ তারা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে এবং কুরআন-সুন্নাহর মানদণ্ডে বাছাই করে, তারপরে এ কার্যক্রমগুলো তারা পরিচালনা করে। এটার জন্য সারাদেশের ৩৪ প্রদেশ থেকে বাছাইকৃত একেবারে শীর্ষ আলেমদের নিয়ে মজলিসে শূরা আছে। মজলিসে শূরার অনুমোদন ছাড়া সেখানে কিছুই হয় না। আর এই মজলিসে শূরার মাথার ওপর আছেন আমিরুল মুমিনিন। তার বিষয়টাও খুবই বিস্ময়কর একটা বিষয়। গোটা জাতির মধ্যে তার প্রতি যে একটা ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা; এক কথায় বলতে গেলে অভূতপূর্ব। প্রত্যেকটা মানুষ হৃদয়ের গহীনে থেকে তাকে ভালোবাসে। তাকে শ্রদ্ধা করে এবং তার আনুগত্য করাটা নিজেদের জন্য জরুরি মনে করে। যার কারণে তাকে কেন্দ্র করে জাতির মধ্যে অভূতপূর্ব একটা ঐক্য সূচিত হয়েছে। এগুলো তো রাষ্ট্রের মূল কাঠামোগত বিষয়।

তারপরে ২০২১ থেকে ২০২৫ চার বছরের বেশি সময় ধরে একটা পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রব্যবস্থা তারা পরিচালনা করছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনায় স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের যে আর্থিক বিষয়, এটা তো অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সেখানে সারা পৃথিবীর অসহযোগিতা রয়েছে। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রের সাথেই তারা প্রোপার চ্যানেলে কোনো অর্থনৈতিক লেনদেন করতে পারছে না। সর্বশেষ শুধু রাশিয়া তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর বাইরে ৪২টি রাষ্ট্রের সাথে প্রাথমিক একটা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে। ৪২টি রাষ্ট্রে তাদের ডিপ্লোমেট আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক কোনো ব্যাংকিং চ্যানেল বা জাতীয় পর্যায়ে বিশ্বের সাথে সম্পর্ক নেই। যার কারণে প্রোপার উপায়ে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা সেখানে আসার কোনো সুযোগ নেই। শুধু দুইটা অভ্যন্তরীণ সোর্স থেকে তাদের রাষ্ট্রের আয় নির্বাহ হচ্ছে। একটা হলো কিছু কাস্টমস তারা পায়। তাদের দেশের সৌল ব্যবহার করে আরবের কিছু দেশ থেকে মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, এই জাতীয় কিছু রাষ্ট্রে যে পণ্যবাহী গাড়িগুলো যাতায়াত করে, এটার জন্য আফগানিস্তান ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। ওই জায়গা থেকে তারা বড় একটা কাস্টমস পায়। এটা হলো একটা আয়ের উৎস। আরেকটা বড় আয়ের উৎস হলো তাদের যে খনিজসম্পদ, এটা আল্লাহ পাকের মেহেরবানি তাদের ওপর। বিপুল পরিমাণ খনিজসম্পদের সমাহার তাদের দেশে আছে। স্বর্ণের খনি, গ্যাসের খনি, কয়লার খনি- এছাড়াও আরও অনেক খনিজসম্পদের মজুদ তাদের আছে। চীনের সহযোগিতায় এখন তারা সেই খনিগুলো উত্তোলন করছে। এই দুইটা সোর্স থেকেই মূলত তাদের জাতীয় আয়। তারা যে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে এবং যে ব্যয় নির্বাহ করছে, সেটা লক্ষণীয়। তারা যখন ক্ষমতায় আরোহণ করে তখন এক আফগানি (আফগান মুদ্রা) সেখানে এক ডলারের বিপরীতে ছিল ১৩০ আফগানি। চার বছরে যেখানে সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক অনেক উত্থান পতন হয়েছে। করোনা ভাইরাসসহ নানা কারণে। মুদ্রার মান কমেছে। আমাদের বাংলাদেশি মুদ্রার মানও ডলারের বিপরীতে অনেক কমেছে। সেই জায়গায় এখন আফগানি মুদ্রা এক ডলারের বিপরীতে ৬৫-৬৬। তো এটা হলো এক দিক। ফিজিক্যালিও আমরা যেটা দেখলাম, আগে কাবুলে যে বাড়ির মূল্য এক লক্ষ ডলার ছিল, চার বছরের ব্যবধানে সেটা দুই লক্ষ ডলারে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ তাদের অর্থনীতি অভ্যন্তরীণভাবেই ব্যাপক সমৃদ্ধ হয়েছে। তাদের আর্থিক যে সক্ষমতাটা সেটা একটা জিনিস থেকে অনুমান করা যায়। সেটা হলো, তাদের দেশে ৪০ বছর ধরে যুদ্ধ করে ২৫ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে। বিশেষ করে বিগত ২০ বছর ধরে ন্যাটো এবং পশ্চিমা আমেরিকার মিত্র বাহিনী বিরুদ্ধে যে লড়াই এবং সংগ্রাম চলছে, এই সংগ্রামে প্রচুর শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। যার কারণে এই এতিম এবং শহীদদের বিধবা পরিবার বিপুল পরিমাণ। রাষ্ট্র কিন্তু তাদের সবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। ৩৪টি প্রদেশের প্রত্যেকটাতেই তারা সরকারিভাবে একটা করে এতিমখানা নির্মাণ করেছে। সুন্দর ইমারত, আধুনিক ব্যবস্থাপনা সুইমিংপুলসহ। তাদের লালন-পালন, শিক্ষা-দীক্ষা, ভরণ-পোষণ সব সরকার গ্রহণ করছে। যথেষ্ট সমৃদ্ধ ব্যবস্থাপনা। ৩৪টি প্রদেশের এতিমখানায় শহীদদের সন্তানদের দায়িত্ব তারা নিচ্ছে। এর চেয়েও ইন্টারেস্টিং যে ইনফরমেশন সেটা হলো, ৮ লক্ষ পরিবারকে তারা প্রতি মাসে ভাতা দেয়। সে ভাতার পরিমাণটাও পরিবার প্রতি ৫ হাজার আফগানি। অর্থাৎ প্রায় ১০০ ডলার। সেই হিসেবে প্রতি মাসে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার শুধু ভাতা দিচ্ছে।

এর চেয়েও বড় আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, তাদের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচারটা আছে, মানবিক বিবেচনায় অনেক অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে করা হয়; বিস্ময়কর বিষয় হলো, এই যে ৮ লক্ষ পরিবারকে তারা ভাতা দিচ্ছে, এর মধ্যে শত্রু-মিত্রের কোনো তারতম্য তারা করে না। তারা যেমনিভাবে তাদের পক্ষীয় শহীদদের পরিবারদের ভরণ-পোষণ দিচ্ছে তেমনিভাবে তাদের বিপক্ষীয় পরিবারদেরও ভাতা দিচ্ছে। এই তথ্য সরাসরি তাদের মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের জানানো হয়েছে। কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই অন্তত ৮ লক্ষ পরিবারকে তারা ভাতা দিচ্ছে। আমি মনে করি এটা অনেক বড় অর্থনৈতিক একটা সক্ষমতার বিষয়। এর বাইরে যে কাজটা করছে সেটা হলো, তারা ব্যাপকভাবে উন্নয়নমুখী, উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করছে। আফগানিস্তানের একেবারে সীমান্ত দিয়ে উজবেকিস্তান, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান চার-পাঁচটা দেশ। আর আফগানিস্তানের মাঝখান দিয়ে একটা নদী প্রবাহিত হয়েছে, যেটা আফগানিস্তানের মূল নদী। এটাকে ‘আমু দরিয়া’ বলা হয়। ঐতিহাসিকভাবে মা-ওরায়ুন নাহার হিসেবে যেটাকে আমরা জানি, এটাই সেই নহর। এই নহরের অপর পাশের লোকদের বুখারা, সমরকন্দের উলামায়ে কেরাম আছে, ইসলামের পরিভাষায় তাদের উলামায়ে মা-ওয়ারাউন নাহার বলা হয়। এই আমু নদীটা আফগানিস্তানের সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত। এই আমু নদী থেকে তারা ভেতরের দিকে ২৮০ কিলোমিটারব্যাপী কৃত্রিম নদী খননের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ৮০-৯০% কাজ প্রায় শেষ। বেশ বড় এরকম ড্যাম নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তাদের কথা হলো, বিগত ৫০ বছর ধরে এ সমস্ত প্রকল্প শুধু আলোচনায় ছিল, কিন্তু কেউ এগুলো হাতে নেওয়ার সাহস করেনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সে ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তাদের টার্গেট হলো ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তারা উৎপাদন করবে। আভ্যন্তরীণ চাহিদা হলো ১২ থেকে ১৫ হাজার এবং বাকি ১৫ হাজার বাইরে তারা সেল করবে। আগামী চার বছরে সাড়ে ছয় লক্ষ কিলোমিটার আফগানের প্রতিটি ঘরে ঘরে তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। এসব থেকে বোঝা যায়, তাদের আত্মবিশ্বাস, কর্মপরিকল্পনা এবং উন্নয়নমূলক যে কাজ, যে ইন্সট্রাক্টর আছে, এগুলো কিন্তু কোনো বিদেশি কোম্পানি না। সব লোকাল কোম্পানি দ্বারাই এই কাজগুলো তারা করছে। বিদেশি চাইনিজ কোম্পানি শুধু খনি উত্তোলনের ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা নিচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের একটা ভিত ইতিমধ্যেই তারা স্থাপন করে ফেলেছে।

৯৫% আলেম-উলামা দ্বারা যে রাষ্ট্র পরিচালিত, সেই রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহের জন্য সাচিবিক দায়িত্ব যারা পালন করছে তারাও মাদরাসাপড়ুয়াই। যেমন তাদের অধিকাংশ মন্ত্রী, আমাদের প্রায় চার-পাঁচজন মন্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে- পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিদ্যুৎমন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, শ্রমমন্ত্রী, আরও ‘আমর বিল মারুফ ও নাহিয়ানিল মুনকার’ নামে একটা মন্ত্রণালয় আছে, সেই মন্ত্রীর সঙ্গে। এছাড়া গভর্নর, প্রধান বিচারপতিসহ অনেকের সাথে আমরা বৈঠক করেছি। তারা শুধু পশতু ভাষাতেই দক্ষ। মন্ত্রীরা অন্য ভাষা খুব একটা ব্যবহার করেন না। কেউ কেউ যারা পাকিস্তানে পড়াশোনা করেছেন, তারা উর্দুতে স্বাচ্ছন্দ বা কিছু আরবি বোঝেন। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের দপ্তরে দোভাষী আছে, খুব ফ্লুয়েন্টলি এবং স্মার্টলি তারা ইংলিশ বলছে এবং এই ইংলিশ যারা শিখেছে তারাও সব আলেম। কেউ মুফতি, কেউ মাওলানা সাহেব। তারা সবাই এই দুই চার বছরের মধ্যে খুব ভালোমানের ইংলিশ আয়ত্ত করে তারাই দোভাষীর কাজগুলো করছে। খুব বিশ্বস্ত লোক ছাড়া সেখানে কাজ করছে, এরকম কাউকে মনে হলো না। এই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ এসব মন্ত্রণালয়েও যারা কাজ করছে তারাও সবাই আলেম-ওলামা, মুফতি এবং অধিকাংশ এখনো মাদরাসায় শিক্ষকতা করছে। আমিরুল মু’মিনিনের পক্ষ থেকে তাদের মন্ত্রীসহ আরও যারা আছে, সবার প্রতি নির্দেশ হলো- মাদরাসায় শিক্ষকতা করতে হবে; ওই শিক্ষকতার পাশাপাশি এই দায়িত্ব অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের এক প্রদেশের গভর্নরের সাথে কথা হলো, তিনি হেদায়া সানি পড়ান। সকালে দেদায়া পড়ান, এরপর সারাদিন তিনি মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেন।

লেখক: আমির, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস; যুগ্ম মহাসচিব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ

[মাওলানা মামুনুল হকসহ একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান সফর করেন। সেই সফরের অভিজ্ঞতা তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুলিখন করেছেন: লাজ্জাস আল হাবিব]

এলএইস/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ