বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫ ।। ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ ।। ৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৭


জনবহুল কড়াইল বস্তির আগুন কী বার্তা দেয়?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

||ফিয়াদ নওশাদ ইয়ামিন||

আগুন লাগা নিছক দুর্ঘটনা হলেও তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে যতটা জ্বালিয়ে দেয়, তার দাগ থাকে আরও বহুদিন। সম্প্রতি রাজধানীর কড়াইল বস্তির ভয়াবহ আগুন শহরটিকে আবার স্মরণ করিয়ে দিল একটি পুরনো সত্য মানুষ যত আধুনিক হোক যত নগরায়নই হোক, অসাবধানতার আগুন একবার ছড়িয়ে পড়লে সভ্যতার পর্দা মুহূর্তেই খুলে যায়। হাজার হাজার মানুষের বসবাস এই ঘনবসতিতে আগুন শুরু হয়েছিল একটি ছোট্ট স্পার্ক থেকেই আর সেই স্পার্কের লেলিহান শিখা রাতারাতি পুরো এলাকা গিলে খেয়েছে।

ঢাকার বস্তিগুলো এমনিতেই ঝুঁকির ওপর দাঁড়ানো ছোট ঘরগুলোর ভিতর দাহ্য উপকরণ টিন কাঠ প্লাস্টিক ফোম মিলে তৈরি হয় আগুন ছড়ানোর উপযুক্ত পরিবেশ। সংকীর্ণ গলি, জটলা পাকানো বৈদ্যুতিক তার, বাতাসে শুকনো কাঠের গন্ধ সব মিলিয়ে একটি স্পার্কই যথেষ্ট বড় বিপর্যয় ঘটাতে। কড়াইলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি মানুষ দৌড়ে পালাতে পালাতে হারিয়েছে স্বপ্ন, হারিয়েছে শেষ অবলম্বন। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস সদস্যদেরও সংকটে পড়তে হয়েছে সংকীর্ণ গলি পানি আনার লাইন স্থাপন করতেও লেগেছে বহুগুণ বেশি সময়, আর প্রতিটি সেই মিনিটই তখন কারও ঘর কারও জীবন কারও স্মৃতিকে আগুনের কাছে সমর্পণ করে দিচ্ছে।

 ধারণা করা হয় এই আগুনের সূচনা হয়েছিল গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে। রাজধানীতে দীর্ঘদিন ধরে চলা গ্যাস সংকটের কারণে বস্তিবাসী বাধ্য হয় নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহার করতে আর সেই সুযোগে অবৈধ সিলিন্ডার সিন্ডিকেটগুলো স্বল্পশিক্ষিত দরিদ্র মানুষের কাছে নিচু মানের সিলিন্ডার সরবরাহ করে। এসব সিলিন্ডার শুধু প্রাণঘাতীই নয় বরং বস্তির মতো জনবহুল ও ঘিঞ্জি পরিবেশে তা হয়ে ওঠে জীবন্ত বিস্ফোরক। একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের চাপেই কয়েকশো ঘর মুহূর্তে আগুনে পুড়ে যেতে পারে। কড়াইলের আগুন সেই সম্ভাবনাকেই নির্মমভাবে বাস্তবে পরিণত করেছে। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় কেন এমন এলাকাগুলো আজও এতটা অপরিকল্পিত রয়ে গেল কেন হাজার মানুষের জীবন ভর করে থাকে কিছু জীর্ণ তার, কিছু নিম্নমানের সিলিন্ডার। কেন দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপন্ন হওয়ার পরও তারা গ্যাস পায় না। আর উৎসহীন নজরদারির ওপর কেন আগুন নেভানোর মৌলিক জ্ঞান থেকেও মানুষ বঞ্চিত থাকে।

এই পরিস্থিতির প্রতিকার শুরু করতে হলে প্রথমত ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগগুলো চিহ্নিত করে প্রযুক্তিগতভাবে সংস্কার করা অপরিহার্য। বস্তি এলাকাকে বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আনলে তারের জট, অতিরিক্ত লোড আর শর্ট সার্কিটের মতো বিপদ অনেকটাই কমবে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নিম্নমানের ও অবৈধ গ্যাস সিলিন্ডারের বাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা। সরকারি সংস্থা, সিটি করপোরেশন ও তদন্ত দলকে যৌথভাবে এই এলাকায় সিলিন্ডারের মান পরীক্ষা, বিতরণ ব্যবস্থার পর্যবেক্ষণ এবং অপরাধী সিন্ডিকেটগুলোকে আইনের আওতায় আনা এখন জরুরি। এর পাশাপাশি বস্তি এলাকার সংকীর্ণ গলি পুনর্বিন্যাস করে জরুরি সড়ক তৈরি করাও অপরিহার্য কারণ ফায়ার সার্ভিস যদি আগুনের কাছে পৌঁছাতেই না পারে তবে আগুন নেভানো আর প্রতিরোধ দুটোই অর্থহীন হয়ে যায়। কমিউনিটি-ভিত্তিক ফায়ার সেফটি প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত মহড়া বস্তিবাসীদের দক্ষ করে তুলতে পারে, যাতে ছোট আগুনকে বড় হতে না দেওয়ার সক্ষমতা তাদের মাঝে গড়ে ওঠে। কিন্তু এসবের বাইরে আরও বড় একটি বিষয় আছে পুনর্বাসন। আগুন নিভলেও মানুষের জীবনে আগুনের ক্ষত বহুদিন জ্বলতে থাকে। তাই প্রতিবার আগুন লাগার পর তাদের আবার সেই একই জায়গায় ফিরে যেতে দেওয়া মানে নতুন একটি আগুনের অপেক্ষা করা। দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পিত বহুতল আবাসনই একমাত্র স্থায়ী সমাধান যেখানে থাকবে নিরাপদ বিদ্যুৎ, নিয়মিত গ্যাস, অগ্নিনিরোধী নির্মাণসামগ্রী ও পানির উৎস। কড়াইল বস্তির আগুন শুধু কয়েকশো ঘর পোড়ায়নি এটি নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা, নিরাপত্তাহীনতার নগ্ন সত্য এবং আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাবকেও সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। আগুনের উৎস রহস্য হতে পারে, কিন্তু এর শিক্ষাটি কখনই রহস্য হয়ে থাকা উচিত নয়। শহরকে নিরাপদ করার জন্য আমাদের সকলেরই উচিত ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে অসাবধানতায় আগুন না লাগে সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখা।

লেখক: কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ মিডিয়া কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট

এলএইস/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ