||বিশেষ প্রতিনিধি||
কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওয়ায়ে হাদিসকে ২০১৮ সালে মাস্টার্স সমমান দিয়েছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে সাত বছরেও এই সনদ কার্যকারিতা পায়নি। সরকারি কিছু দফতরে এই সনদ গ্রহণ করার কথা থাকলেও সেটা করা হয়নি। সনদের স্বীকৃতি দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকার ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে গণঅভ্যুত্থানে। প্রায় দেড় বছর ধরে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। এই সরকারের আমলে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নের দাবি উঠছে নানা মহল থেকে। কিছু ক্ষেত্র নির্ধারণ করে এই সনদের কার্যকারিতার সুপারিশ করেছে কওমি মাদরাসার বোর্ডসমূহের সর্বোচ্চ অথরিটি আল-হাইয়্যাতুল উলয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়াও।
এবার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মূল্যায়ন এবং কিছু ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। যদিও বিষয়টি তার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নয়, তবু তিনি এর কার্যকারিতার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এই ধারাবাহিকতায় তিনি তিন মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার বা আধা সরকারি চিঠি পাঠিয়েছেন।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে তিনটি ডিও লেটার পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি দাওরায়ে হাদিসের সনদধারীদের কর্মসংস্থানের ব্যাপারে সুপারিশ করেছেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরারকে লেখা চিঠিতে ধর্ম উপদেষ্টা উল্লেখ করেন-
আপনি নিশ্চয় অবগত রয়েছেন যে, বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজারের অধিক কওমি মাদরাসা রয়েছে। এসকল মাদরাসা হতে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদ লাভ করে থাকেন। গত ১০/০৯/২০১৮ খ্রি. মহান জাতীয় সংসদে ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি'আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর অধীন কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) এর সমমান প্রদান আইন, ২০১৮' পাস হয় এবং তা একই তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
আপনার মন্ত্রণালয়াধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ইসলাম শিক্ষা’ পাঠ্য বই চালু আছে। মাধ্যমিক স্তরে ইসলাম শিক্ষা পাঠদানের জন্য ‘সহকারী শিক্ষক (ধর্ম)' নিয়োগদান করা হয়ে থাকে। আরবি বা ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক (সম্মান) বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদেরকে বর্ণিত পদে নিয়োগ দানের বিধান রয়েছে। উল্লিখিত পদে নিয়োগ লাভের যোগ্যতা হিসেবে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদকে অন্তর্ভুক্ত না করার কারণে দাওরায়ে হাদিস সনদধারীরা উক্ত পদে নিয়োগ লাভের জন্য আবেদন করতে পারছেন না। ফলে ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি'আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ' এর অধীন কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) এর সমমান প্রদান আইন, ২০১৮' এর কোনো সুফল দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদধারীরা অদ্যাবধি পাননি। এতে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে এবং কওমি অঙ্গনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বর্ণিতাবস্থায় ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি'আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ' এর অধীন কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) এর সমমান প্রদান আইন, ২০১৮ বাস্তবায়ন এবং দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদধারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আপনার মন্ত্রণালয়াধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে 'সহকারী শিক্ষক (ধর্ম)' বা অনুরূপ পদসমূহে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে দাওরায়ে হাদিস সনদধারীদের নিয়োগ দানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আপনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সহযোগিতা কামনা করছি।
একই বিবরণ সম্বলিত আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে লেখা চিঠিতে বলা হয়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ অনুসারে নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স প্রদান করা হয়ে থাকে। উল্লিখিত বিধিমালায় নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স পাবার যোগ্যতা হিসেবে সরকার কর্তৃক স্বীকৃত কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদরাসা বোর্ড কর্তৃক নিবন্ধিত কোন মাদরাসা হতে আলিম সার্টিফিকেটধারী হওয়ার বিধান রয়েছে। নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স পাবার ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধানের পাশাপাশি কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদকে অন্তর্ভূক্ত করা হলে দাওরায়ে হাদিস সনদধারীরাও উক্ত লাইসেন্সের জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবেন।
বর্ণিতাবস্থায় ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি'আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ' এর অধীন কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) এর সমমান প্রদান আইন, ২০১৮ বাস্তবায়ন এবং দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদধারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আপনার মন্ত্রণালয়াধীন নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে দাওরায়ে হাদিস সনদধারীদেরকে অগ্রাধিকার দেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আপনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সহযোগিতা কামনা করছি।
আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আশরাফ উদ্দিনকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়-
আপনার মন্ত্রণালয়াধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে ‘ধর্মীয় শিক্ষক’ এর পদ রয়েছে। উল্লিখিত পদে আবেদনকারী শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক স্বীকৃত কোন মাদরাসা হতে ফাজিল পাশের কথা উল্লেখ রয়েছে। কামিল অথবা ইসলামিক স্টাডিজ, আরবি ইত্যাদি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি পাশ। প্রার্থীদেরকে অগ্রাধিকার দেয়ার বিধান রয়েছে। উল্লিখিত পদে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধানের পাশাপাশি কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদকে অন্তর্ভূক্ত করা হলে দাওরায়ে হাদিস সনদধারীরাও উক্ত পদের জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবেন।
বর্ণিতাবস্থায়, ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি'আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ' এর অধীন কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) এর সমমান প্রদান আইন, ২০১৮ বাস্তবায়ন এবং দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর সনদধারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আপনার মন্ত্রণালয়াধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে ‘ধর্মীয় শিক্ষক' নিয়োগের ক্ষেত্রে দাওরায়ে হাদীস সনদধারীদের নিয়োগ দানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আপনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সহযোগিতা কামনা করছি।
প্রসঙ্গত, ড. মাওলানা আ ফ ম খালিদ হোসেন কওমি মাদরাসায় পড়াশোনা করেছেন। এজন্য নিজ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন না হওয়ার পরও শুরু থেকেই তিনি কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে আন্তরিকতা প্রদর্শন করে আসছেন। তিনি কওমি মাদরাসার সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষকে বারবার অনুরোধ করেছেন, এ ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার।
কয়েক মাস আগে হাইয়্যাতুল উলয়ার একটি প্রতিনিধি দল ধর্ম উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি এ ব্যাপারে করণীয় বলে দেন। পরে তিনিসহ একটি প্রতিনিধি দল শিক্ষা উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং প্রধান উপদেষ্টাকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে দাওরায়ে হাদিসের সনদকে কোন কোন ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায় সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়।
এনএইচ/