||মুফতি এনায়েতুল্লাহ||
দেশ নির্বাচনী হাওয়া বইছে। একজন পেশাদার ভোট কুশলী হিসেবে ফেসবুকে সময় দেওয়া কঠিন। তাতে প্রতিদিনকার রুটিন কাজে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। মাঠে পর্যায়ে নানা কাজ করতে হচ্ছে। কাজের ধরন ও পরিধি ভিন্ন। ভিন্ন ভিন্ন প্রার্থী, এলাকা ভিন্ন, প্রেক্ষাপট ও মাঠের পরিস্থিতিও বেশ গয়রহ। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। আজকের আলোচ্য বিষয়, ইসলামি দলের নেতাকর্মীদের মনোভাব ও আমার পর্যালোচনা।
আমি সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নেই, তবে মনে আছে কোন দল আমি সাপোর্ট করি। কিন্তু ইসলামি দলগুলোর কর্মপন্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, ভালো লাগলে প্রশংসা করি; সম্ভব হলে দলের নেতাদের মনের কথা জানাই ফোনে। আর কোনো পলিসি, কর্মপন্থা মনমতো না হলে- চুপ থাকি। কারণ, আমি যেহেতু ওই দলের কেউ না, তাই তাদের কর্মপন্থা নিয়ে কথা বলা, সমালোচনা করা শোভন নয়। এটা ভদ্রোচিত আচরণ নয়। যদি পেশাদার রাজনৈতিক বিশ্লেষক হতাম- সেক্ষেত্রে এটা করা যেতো, কিন্তু আমার পেশা তো ভিন্ন। সুতরাং ওইটা আমার সাবজেক্ট না।
তাহলে এতো লম্বা ভূমিকা কেন?
কারণ, বর্তমানে ইসলামি দলগুলোর মাঝে ভয়ংকরভাবে আস্থার সংকট চলছে। এর প্রভাবে নেতাকর্মীরা পরস্পরে বাজে ধরনের অসহনশীল আচরণ করছে, একে অন্যকে গালি দিচ্ছে, হুমকি দিচ্ছে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে জেতার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক তর্কে কিংবা আলাপে জিততে এমন আচরণ আগে দেখা যায়নি। কেন এমন হলো? সহজ উত্তর, ‘গঠনমূলক রাজনীতির অভাব।’
রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থাকবে- আর সমালোচনা তো ডালভাত; তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো, ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের বিশেষণ গায়ে যুক্ত হওয়া। যেহেতু আপনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতা, কর্মী বা সমর্থক। আপনার কাজ, চলাফেরা, আচার-আচরণ আতশ কাঁচের নিচে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এরই অংশ হিসেবে, আপনার গালি দেওয়া চলবে না, সমালোচনা করতে হবে সীমার মধ্যে থেকে, মিথ্যা তথ্য-বক্তব্য আর গুজবে তো কান দেওয়াই যাবে না। তাহলে উপায়? সেই গঠনমূলক রাজনীতির চর্চা।
এই গঠনমূলক রাজনীতিটা কী?
যেমন ধরুন, আপনি দলকে আপনি অন্যের সামনে মহান, বড় আর অনন্য করে তুলতে মিথ্যা তথ্য সম্বলিত বিশাল একটি লেখা দিলেন ফেসবুকে। আপনার অনুরাগী-অনুসারীরা সেখানে লাইক কমেন্টের বন্যা বইয়ে দিলো। বিশাল আত্মতৃপ্তি, কিন্তু আখেরে লাভ কী হলো? এর বদলে আপনি এই সময়টায় আপনার দলের উপকার হয়- এমন কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করে কিছু প্রস্তাবনা প্রস্তুত করে দলীয় দায়িত্বশীলের হাতে দিন, প্রথম প্রথম তিনি হয়তো এটাতে মনোযোগ দেবেন না, কিন্তু এক সময় আপনি হয়ে ওঠবেন দলের অন্যতম চিন্তক। যাদেরকে রাজনীতির ভাষায় বলে বুদ্ধিজীবী।
ফেসবুকে বিরোধীমতের কাউকে কষে গালি দিয়ে, হেয় করে, কুৎসা রটিয়ে ক্ষণিক তৃপ্তি মিলে, কিন্তু আপনাকে, আপনার দলকে, আপনার নেতাকে পর্যবেক্ষণ করা সাধারণ মানুষ বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, আর যাই হোক- গালি ও মিথ্যার সঙ্গে আমি নেই। এভাবে দলে নেতার সংখ্যা বাড়ে কিন্তু কর্মী জুটে না। জনসম্পৃক্ত হয় না দল।
ধরুন, আন্তর্জাতিক ফোরামে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করার মতো যোগ্য লোকের অভাব রয়েছে, দলের নেতারা ফেসবুকে মেধাঅপচয়কারী কর্মীদের সেখানে কাজে লাগতে পারে। আন্তর্জাতিক পলিসি ও অর্থনৈতিক ফোরামে আলোচনা করা, সম-সাময়িক বিষয়ে তথ্যভিত্তিক গবেষণা করা, দেশের ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরের জন্য আলাদা আলাদা দায়িত্বশীল নিয়োগ করা। যারা, প্রয়োজনের সময় সর্বশেষ তথ্যসমৃদ্ধ একটি গবেষণাপত্র, বিকল্প প্রস্তাব কিংবা সঠিক নির্দেশনা জাতিকে দিতে পারে। নেতারা কর্মীদের এসব বিষয়ে কাজে লাগাতে পারে।
এখন চলছে, জোট রাজনীতি নিয়ে চর্চা। কে কয়টা সীট পাবে, কে কোন জোটে যাবে- এটা নিয়ে পরস্পরকে হেয় করতে, নিজেদের সিদ্ধান্ত যথার্থ প্রমাণে মরিয়া। কোনো দরকার নেই, আপনি কেন জোটে যাবেন, কেন জোটে যাবেন না- এটা দলের সিদ্ধান্ত। যখন সময় হবে, আপনি দলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন; তা না করে, আপনি যা এখনও অস্তিত্বে আসেনি, আসবে কিনা- নিশ্চিত জানাও নেই। সেটাই নিয়েই শুরু করলেন গালাগালি। কেন? আপনার কি আস্থা নেই আপনার নেতার প্রতি? না আপনার নেতা আপনাকে এভাবে মাঠে বিরোধীপক্ষকে গালি দিতে বলেছেন?
ইসলামি দলের কর্মী আপনি, কিন্তু আপনার সহনশীলতার অভাবের পরিণতি খুবই মারাত্মক। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি অসহিষ্ণুতার প্রভাবে সাধারণ জনগণের মধ্যে রাজনীতির প্রতি অনীহা তৈরি হয়। বিশেষ করে ইসলামপন্থীদের নিয়ে মানুষ খারাপ মন্তব্য করে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অশালীন ভাষা ব্যবহার রাজনীতি নয়, এমন অবস্থা পরিবেশকে উত্তপ্ত ও বিভাজিত করে। প্রতিহিংসা ও তাচ্ছিল্য রাজনীতির পরিভাষা নয়। আপনি যে রাজনৈতিক আদর্শ লালন করেন না কেন, আপনাকে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। বিশ্বাস করতে হবে, আপনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছেন, সুতরাং মানবিকতা প্রদর্শন জরুরি।
মনে রাখবেন, রাজনীতি কেবল দল বা ক্ষমতার লড়াই নয়। এটি আচরণ, শিষ্টাচার এবং নৈতিকতার প্রতিফলন। রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে মানুষ মোটাদাগে কী চায়? প্রকৃত অর্থে তারা মূলত চায় সততা, সহনশীলতা ও দায়িত্বশীলতা। এবার আপনি ভাবুন, আপনি কী করছেন? কী করা ছিলো আপনার কাজ?
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ভোট কুশলী
এলএইস/