বুধবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৫ ।। ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ ।। ৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৭


পাঠ্যবইয়ে যুক্ত হচ্ছে বাকশাল থেকে হাসিনার পলায়ন কাহিনী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাধ্যমিকের বইয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন-পরিমার্জন করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড—এনসিটিবি। নতুন শিক্ষাবর্ষে সরবরাহের জন্য প্রস্তুত পুস্তকগুলো থেকে অনেক বিতর্কিত বিষয় বাদ পড়েছে। সাথে যুক্ত হয়েছে জুলাই বিপ্লব, বহুল বিতর্কিত শাসন শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল থেকে শুরু করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের ঘটনা। একই সঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু থেকে এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসন এবং পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়ার শাসনের কথাও স্থান পেয়েছে।

এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এবার পাঠ্যবইয়ে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে গত বছরের ছাত্র-জনতার জুলাই গণবিপ্লবের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে স্থান পেয়েছে পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং বৈষম্যের চিত্র। পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছে ১৯৭৫ সালের শেখ মুজিব সরকারের সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল প্রতিষ্ঠা; ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান।

২০২৬ সালের ৬ষ্ঠ থেকে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের ‘স্বাধীন বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান’ নামে নতুন অধ্যায়ে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির বাংলা সাহিত্য কণিকা বই থেকে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ বাদ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অন্য সব শ্রেণির বইয়ের কনটেন্টে ছোটখাটো পরিবর্তন হচ্ছে।

নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের ‘স্বাধীন বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান’ অধ্যায়ে যুক্ত করা হয়েছে ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন; পরে ক্রমাগত কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা, বিরোধী দলমতের মানুষের ওপর দমন-নিপীড়ন, দুর্নীতির প্রসার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল করার মাধ্যমে দলীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হাসিনার বেপরোয়া হয়ে ওঠা; ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক সংকটের শুরুসহ বিভিন্ন বিষয়।

এভাবে ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার আওয়ামী রোডম্যাপও পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হয়েছে।

হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অর্থনৈতিক ফলাফল ছিল দীর্ঘমেয়াদে ধ্বংসাত্মক। কমিশনের প্রতিবেদনের বরাতে দুর্নীতির মাধ্যমে বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ বিদেশে পাচার, একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে একটি ‘চোরতন্ত্র’ কায়েম, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল ও ভঙ্গুর করে দেওয়ার কথাও তুলে ধরা হয়েছে।

পাঠ্যবইয়ে আরো বলা হয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদের কথা বলে ক্ষমতা গ্রহণের পর বহুগুণ দুর্নীতি বৃদ্ধি এবং প্রায় ৯ বছরের আন্দোলনে নূর হোসেন, নাজির উদ্দিন জেহাদ, ডা. শামসুল আলম খান মিলনসহ অনেকে জীবনদান করেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। ১৯৯১ সালে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা নেয়।

২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের গুরুত্ব তুলে ধরতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ তিনটি দিক উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার বৈষম্যকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা ২০২৪ সালের জুনে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলে। এ আন্দোলন চলাকালে ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ নির্মম হামলা চালালে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। ১৬ জুলাই রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদ এবং চট্টগ্রামে ওয়াসিম আকরাম, ফয়সাল শান্তসহ কয়েক শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে শহীদ হন।

এ ঘটনায় সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং রাজপথে জন-আক্রোশের বিস্ফোরণ ঘটে। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলন দমাতে সরকারের মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগে শত শত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা শাহাদাতবরণ করে। সরকার আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। হাসিনার সরকার যত বেশি শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে, মানুষ তত বেশি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটে এবং হাসিনাসহ ফ্যাসিস্ট কাঠামোর সহযোগীরা ভারতে পালিয়ে যায়।

গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার অনুমতি না থাকায় নাম ও পদবি প্রকাশ না করে এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, গত বছরের পাঠ্যবইয়ের অনেক বিষয় নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে এনসিটিবি। সেগুলো মাথায় রেখেই এবার উচ্চপর্যায়ের কমিটিতে আলোচনার পর কিছু সুপারিশ আসে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে কিছু বইয়ে কনটেন্টে বড় পরিবর্তন-পরিমার্জন করা হয়েছে।

এনসিটিবির শিক্ষা ও সম্পাদনা বিভাগের প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ ফাতিহুল কাদীর আমার দেশকে বলেন, উচ্চপর্যায়ের কমিটির সুপারিশের আলোকে মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ের কনটেন্টে সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় এবং পৌরনীতি বইয়ে দেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এরই মধ্যে বইগুলো প্রকাশ হয়েছে; তবে তা এখনই অনলাইনে আপলোড হচ্ছে না।

এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, ‘বেশকিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও পরিবর্তিত-পরিমার্জিত নতুন পাঠ্যবই বছরের শুরুতেই আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে পারব বলে খুবই আশাবাদী।’

এলএইস/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ