ব্রিটেনের ইতিহাসে প্রথম হিজাব পরিহিতা মুসলিম নারী হিসেবে শপথ নিয়েছেন ৪০ বছর বয়সী রাফিয়া আরশাদ। গত মে মাসের শেষ দিকে যুক্তরাজ্যের মিডল্যান্ডস সার্কিটের একজন ডেপুটি জেলা জজ হিসাবে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ইউরোপে এমন একটি মুসলিম সংখ্যালঘু দেশে ইসলামফোবিয়ার মোকাবিলা করে কিভাবে তিনি এতো মর্যাদাপূর্ণ একটি আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন সময়ের আলোচিত এই নারী। আল আরাবিয়ায় প্রকাশিত তার সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ ভাষান্তর করেছেন বেলায়েত হুসাইন।
শৈশব থেকেই এই কথার ওপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, বিশ্বের যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশেও হিজাব পরিহিতা একজন পর্দানশীন মুসলিম নারী নিজ যোগ্যতাবলে সমাজের নানাক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে এবং একইসঙ্গে হিজাব মুসলিম নারীর সফলতা অর্জনে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না।
এরপরেও সংখ্যালঘু হয়ে ব্রিটেনের একজন জজ নিযুক্ত হব- এটা আমার কাছে বেশ সংশয়ের ছিল। কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল ঠিক এমনই। সেই লক্ষ্যে ১১ বছর বয়সেই আমি আইনকে পেশা হিসেবে নেয়ার সংকল্প করি।
আজ যেই মুহূর্তে আমি যুক্তরাজ্যের জজ নিযুক্ত হয়েছি তখন আমি তিন সন্তানের জননী। কৃষ্ণাঙ্গ-শেতাঙ্গ কিংবা নারী-পুরুষের বৈষম্যর মধ্যেও ৪০ বছর বয়সে আদালতের সর্বোচ্চ চেয়ারে বসতে পেরে খুব আনন্দ অনুভব করছি। জাতি ও বর্ণ ভেদাভেদ ডিঙ্গিয়ে রক্ষণশীল একজন হিজাবি মুসলিম নারী হয়েও প্রতিকূল পরিবেশে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছি। আমি মনে করি- আমার এই সফলতা শুধুমাত্র মুসলিম নারীদের জন্য নয়; বরং সমগ্র নারী জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
শপথ গ্রহণের পর অনেক নারী-পুরুষ আমাকে ইমেইলে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এদের বেশিরভাগই আমাকে এই বার্তা পাঠিয়েছেন যে, 'হিজাবি নারী হয়ে ব্রিটেনের বিচারকের আসন অলঙ্কৃত করে আমাদের দারুণ আনন্দিত করেছ'। তাদের এতোদিনের ধারণা ছিল, হিজাব পরে তো এদেশের আইনজীবীই হওয়া দুষ্কর কিন্তু তুমি বিচারক হয়ে গেলে!
আমার বেড়ে ওঠা পশ্চিম ইয়র্কশায়ারে। এখান থেকেই আমার আইনি পড়াশোনার সূচনা। হিজাব পরিধান করে আইনজীবী হওয়ার শুরুতেই অসংখ্য বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হই আমি। আমার পরিবারই আমাকে হিজাব পরিত্যাগ করতে চাপ দেয়, তারা বলে, ব্রিটেনের পরিবেশ হিজাবি নারীদের জন্য উপযুক্ত নয়; রক্ষণশীল মানষিকতা থেকে বের না হলে তুমি কখনোই তোমার কাঙ্খিত সফলতা ছুঁতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতেও আমি আমার আত্মবিশ্বাস হারাইনি, আমার দৃঢ় সংকল্প নড়বড়ে হয়ে যায়নি।
২০১১ সালে আমি যখন ইনজাফ কোর্ট স্কুল অফ ল-তে স্কলারশিপ পেতে একটি ইন্টারভিউয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আমাদের পরিবারের একজন সদস্য আমাকে হিজাব না পরার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, যদি আমি এমনটি করি তাহলে আমার স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এমনকি হিজাব না পরতে তিনি আমাকে ধমকও দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি তার সামনে মাথা নত করিনি।
অতঃপর আমি হিজাব পরিধান করেই সেখানে ইন্টারভিউ দিতে যাই এবং পাশ করি। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠান কতৃপক্ষ আমাকে আইনজীবী হিসেবে নির্বাচন করে। এই ঘটনাটি আমার জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দেয় এবং এতে আমার সেই পুরনো বিশ্বাস আরো সুদৃঢ় হয়ে ওঠে।
এরপরেও আমার এই জীবন সহজ ছিল না, আইনজীবী হয়েও হিজাবি হওয়ার কারণে প্রায়শই আমাকে পক্ষপাতিত্বের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অসংখ্য অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছি আমি। একবারের ঘটনা, মামলা লড়তে আমি আদালতে গিয়েছি। সেখানের এক কর্মকর্তা আমাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কি কোন ক্লায়েন্ট? আমি 'না' উত্তর দিলে তিনি ফের জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে অবশ্যই তুমি দোভাষী হবে? আমি এবারও 'না' উত্তর দিলাম। অতঃপর তিনি জানতে চাইলেন, আমি কি কাজের অভিজ্ঞতার জন্য সেখানে এসেছি কি না? এবারও আমি 'না' উত্তর দিয়ে তাকে বললাম, জনাব! আমি এই মামলার আইনজীবী।
মোটকথা, ব্রিটেনের পরিবেশ আমার মতো একজন হিজাবি নারীকে আইনজীবী কিংবা বিচারক হিসেবে মেনে নিতে নারাজ কিন্তু নিখুঁত যোগ্যতা ও প্রতিভার সাক্ষর রাখায় আমি বিচারক নিযুক্ত হয়েছি। এক্ষেত্রে হিজাব আমার জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি। আমার এই ঘটনায় বিশেষ করে মুসলিম নারীদের জন্য একটি শিক্ষা রয়েছে যে, তারাও হিজাব পরিধান করে জীবনের নানা ক্ষেত্রে সফলতার পতাকা উড্ডীন করতে পারে।
-এএ
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        