বিশেষ প্রতিনিধি
জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশন ঢাকায় তাদের দপ্তর খুলতে চায়। এ ব্যাপারে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিগগির এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সঙ্গে সরকারের একটি চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্যেই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠছে। আলেম-উলামা, ইসলামি রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন দীনি সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। এমনকি বামপন্থী সংগঠনগুলোও এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। যদিও তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন।
তবে ‘ইসলামি’ নাম যুক্ত থাকা দল জামায়াতে ইসলামী অবশ্য সরকারি এই সিদ্ধান্তে কোনো সমস্যা দেখছে না। বৃহৎ দল বিএনপিরও সায় রয়েছে এই সিদ্ধান্তে। গত ২৯ জুন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের ঢাকায় একটি অফিস স্থাপনের প্রস্তাবে নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয়ের একটি শাখা তারা ঢাকায় চালু করতে চাচ্ছিলেন। এটা নিয়ে তারা আলোচনা করছিলেন। এই আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এটার একটা খসড়া সমঝোতা স্মারক উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। আমরা কয়েকজন উপদেষ্টা এটা পরীক্ষা করবো।
তিনি জানান, পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্কের কাছে পাঠাবে বাংলাদেশ। সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত হলে ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের একটা অফিস হবে। প্রাথমিকভাবে তিন বছরের জন্য এ কার্যালয় স্থাপন করা হবে এবং দুই পক্ষ পরে যদি মনে করে এটা পুনরায় নবায়ন করা দরকার, তাহলে এটা আরও বাড়তে পারে। অফিস স্থাপনের দুই বছর পর এই বিষয়টি রিভিউ করা হবে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের দপ্তর করার বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপর। গত বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক ঢাকা সফর করেন। তার সঙ্গে বৈঠক শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদ ঢাকায় ওএইচসিআর এর অফিস খোলার বিষয়ে সরকারের সম্মতির বিষয়টি প্রথম সাংবাদিকদের জানান। তখন হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়।
সংগঠনের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ঢাকায় তাদের অফিস খুলতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চরম আত্মঘাতী হবে। নতুন করে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি হোক এবং তাতে অন্তর্বর্তী সরকার আরও দুর্বল হয়ে পড়ুক, তা আমরা চাই না।’ বামপন্থী বেশ কয়েকটি দলও তখন এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
একদিন পরেই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানান, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার তখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে একেক উপদেষ্টা একেক তথ্য দিলেও ভেতরে ভেতরে যে আলোচনা চলছে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৬ জুন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ৫৯তম মানবাধিকার পরিষদে বার্ষিক প্রতিবেদন উত্থাপনে ফলকার টুর্কের দেওয়া বক্তব্যে। অন্য নানা দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের কথাও উঠে আসে তার কথায়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের সুযোগ তৈরি করে আইন সংশোধনে উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি ঢাকায় তার দপ্তরের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করার তথ্যও উঠে আসে টুর্কের মন্তব্যে। এর দুই সপ্তাহের মাথাতেই আইন উপদেষ্টা আনুষ্ঠানিকভাবে এ তথ্য জানান।
এদিকে সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছেন দেশের আলেম-উলামা ও দীনদার মানুষেরা। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর আগে কথিত নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সরকার তাদের যে রূপ দেখিয়েছে সেটাই জাতিসংঘের দপ্তর খোলার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হবে বলে মনে করছেন আলেমরা। হেফাজতে ইসলাম আগামী শুক্রবার (১১ জুলাই) এই ইস্যুতে বিক্ষোভ ডেকেছে।
আজ মঙ্গলবার (৮ জুলাই) জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ মানববন্ধন করবে। এছাড়া অন্যান্য ইসলামি দলগুলোও কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। আলেমদের আপত্তি কেন? হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ মহিবুল্লাহ বাবুনগরী গত ৫ জুলাই রাজধানীর বারিধারায় দোয়া অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস খুলতে দেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যার সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় কাঠামো ইসলামি মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই দেশের সংস্কৃতি, পরিবারব্যবস্থা, নৈতিক রীতিনীতিকে অক্ষুন্ন রাখা আমাদের ধর্মীয় ও নাগরিক দায়িত্ব। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে কার্যালয় স্থাপনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও আশঙ্কা প্রকাশ করছি।
অতীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘মানবাধিকারের' নামে ইসলামি শরিয়াহ, পারিবারিক আইন ও ধর্মীয় মূল্যবোধে হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব হস্তক্ষেপ একদিকে যেমন জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত, অন্যদিকে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় অনুভূতিরও পরিপন্থী।
হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা একটি কমিটিও গঠন করেছি। তারা দেখবে বিশ্বের অন্য যেসব দেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস আছে তারা সেখানে কী করে। আফ্রিকাসহ বিশ্বের কিছু দেশে তাদের অফিস আছে। কিন্তু তাতে কোনো ইতিবাচক ফল আসেনি। অনেক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাজায়ওতো অফিস আছে। কিন্তু সেখানে তো তারা কিছু করছে না।
মহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, তারা এখানে অফিস করলে সমকামিতা উৎসাহিত হবে। তাহলে তো সভ্যতা থাকবে না। তারা কাদিয়ানি, সংখ্যালঘু, পাহাড়ি, নানা ইস্যু তৈরি করবে। খ্রিস্টানদের প্রভাব বেড়ে যাবে। আর নারী স্বাধীনতার নামে তারা নারীদের ইসলামের বিধিবিধানের বাইরে নিয়ে যেতে কাজ করবে। এতে আমাদের মূল্যবোধ, দেশীয় সংস্কৃতিসহ আরও অনেক কিছু ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই আমরা এখানে মানবাধিকার অফিস চাই না। হেফাজতের নায়েবে আমির বলেন, আমাদের এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় কোনো ঘটনা নাই। টুকটাক যা আছে তা আমরাই দেখছি। সরকার দেখবে।
ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধিতা করা হয়েছে। দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখানে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি আছেন। আলাদা করে আর মানবাধিকার কমিশনের অফিস দরকার আছে বলে মনে করি না। আর এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনা তা বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঘটেছে। তার বিচার প্রক্রিয়া চলছে। ফলে মানবাধিকার কমিশনের অফিস আর দরকার নাই।’
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে এখন আর এমন কোনো ইস্যু নাই যে কারণে এখন মানবাধিকার কমিশনের অফিস লাগবে। অযথা তারা এখানে কেন অফিস করবে।
এদিকে সিপিবিসহ বাম দলগুলোও জাতিসংঘের দপ্তর খোলার বিরোধিতায় সোচ্চার। তবে তাদের বিরোধিতার কারণ ভিন্ন। তারা বলছেন, কোনো একটি দেশ যদি দীর্ঘ মেয়াদে সংকটে পড়ে যায় তাহলে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তো এমন কোনো দীর্ঘ মেয়াদে সংকটে পড়ে নাই যে তাদের অফিস লাগবে। কেন এই উদ্যোগ, কোন কোন দেশে আছে এই অফিস? সাধারণভাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চলে অফিস স্থাপন করে। স্থানীয় পর্যায়ের অফিসগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন তৈরি করে। কৌশলগত সহায়তা দেয়, সচেতনতার জন্য অ্যাডভোকেসি করে এবং মানবাধিকার রক্ষার কাজে স্থানীয়দের যুক্ত করে।
মানবাধিকারকে স্থানীয়ভাবে আন্তর্জাতিক মানে নেওয়ার চেষ্টাও ওএইচসিআর এর আওতায় রয়েছে। স্থানীয়ভাবে লিঙ্গ, আবাসন, ভূমি ব্যবস্থাপনা, বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়াও জাতিসংঘের এই সংস্থার এজেন্ডার মধ্যে রয়েছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ওএইচসিআর সদর দপ্তর। এর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন বিশ্বের ১৬টি দেশে সংস্থাটির কার্যালয় রয়েছে।
দেশগুলো হচ্ছে- বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, চাড, কলোম্বিয়া, গুয়াতেমালা, গিনি, হুন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মেক্সিকো, নাইজার, ফিলিস্তিন, সিরিয়া (লেবাননের বৈরুত থেকে পরিচালিত), সুদান, টিউনিশিয়া এবং ইয়েমেন। এছাড়াও, দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি ফিল্ড অফিস এবং ইউক্রেনে একটি মিশন অফিস রয়েছে সংস্থাটির। এর বাইরেও ১৩টি আঞ্চলিক অফিস রয়েছে ওএইচসিআর এর। এর মধ্যে ব্যাংককে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক কার্যালয় অবস্থিত।
তবে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে সংস্থাটির কার্যালয় নেই, কোনো আঞ্চলিক দপ্তরও নেই। ইউরোপ বা উত্তর অ্যামেরিকার কোনো দেশেও দেশটির কার্যালয় নেই। তবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৪৩টি দেশে কার্যক্রমের বিবরণ দেওয়া আছে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নামও।