রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫


কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাজী ওয়াদুদ নওয়াজ।।

আল-কোরানের জ্ঞান অহির মাধ্যমে প্রাপ্ত চিরন্তন (Absolute) জ্ঞান।আর অন্য সূত্র থেকে মানব জাতির অর্জিত জ্ঞান আপেক্ষিক (Relative)।বিজ্ঞান তার ঐতিহাসিক বিকাশের বিশেষ পর্যায়ে কোনও আপেক্ষিক জ্ঞানকেই তুলে ধরে। আল-কোরানের দৃষ্টিতে “ইমান” সমস্ত জ্ঞানের মূল ভিত্তি। স্রষ্টার সৃষ্টি-রহস্য উন্মোচনের প্রচেষ্টা কোরানের দৃষ্টিতে সর্ব শ্রেষ্ঠ এবাদত। আর এ সম্পর্কিত জ্ঞানই হলো সর্ব শ্রেষ্ঠ জ্ঞান।

আল-কোরান আল্লার সৃষ্টি-রহস্য উদ্ঘাটনের ইংগিতবাহী বলেই “মহা-বিজ্ঞানময় গ্রন্থ” মানব প্রকৃতির সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য গুলি বুঝা ও সেই অনুযায়ী ব্যক্তি ও সমাজ জীবন নিয়ন্ত্রন করার লক্ষ্যে জারিকৃত শরিয়া আইন সমূহও সেই জ্ঞানেরই ধারা বাহিকতা ।

“আল-কোরানের আলোকে না দেখলে এ বিশ্ব-জগতের সব কিছুই অসার ও অর্থহীন ।“বলেছেন Prof. P.A Wahid তাঁর The Quran : Scientific Exegesis গ্রন্থটিতে।

শুধুমাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আল্লাহ আল-কোরান নাযিল করেননি।আল্লাহর সৃষ্টি-প্রশাসনের বাস্তবতা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবনের নিমিত্তে সমগ্র মানব জাতির জন্য আল-কোরান নাযিল করা হয়েছে। “এটা সেই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নেই, এটি মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত। ” [আয়াত-২:২]

এ (কোরান )হচ্ছে মানুষের জন্য সুস্পষ্ট দলীল,(সর্বোপরি )বিশ্বাসীদের জন্যে তা হচ্ছে জ্ঞানের কথা,পথনির্দেশ ও অনুগ্রহ।[আয়াত:৪৫:২০] “আমি যদিএ কোরানকে কোনো পাহাড়ের উপর অবতীর্ন করতাম তাহলে আপনি (নিশ্চয়ই) তাকে দেখতেন,কিভাবে তা বিনীত হয়ে আল্লার ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে পড়ছে। আমি এসব উদাহরণ মানুষের জন্য একারনেই বর্ণনা করছি,যেন তারা কোরানের মর্যাদা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করে। “[আয়াত-৫৯:২১]

পড়, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে, জমাট রক্ত-পিণ্ড থেকে।পড়, তোমার সেই মহান দয়ালু প্রভুর নামে,যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়ছেন।তিনি এমন কিছু তাকে শিখিয়েছেন, যা তিনি না শিখালে সে জানতেই পারতোনা। অথচ এই মানুষটিই বড় হয়ে বিদ্রোহে মেতে ওঠে।সে দেখতে পায় এখন তার কোনও অভাব নাই।অথচ এ নির্বোধ ভেবে দেখেনা (একদিন) প্রভুর কাছেই তার প্রত্যাবর্তন হবে[আয়াত:৯৬:১-৮]

উপরোক্ত চারটি আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ মানব জাতির কাছে সুষ্পষ্ট ভাবে কোরান শিক্ষার গুরুত্বকে তুলে ধরেছেন।(আয়াত:৯৬:১-৮)এ আল্লাহ কর্তৃক মানুষকে ‘পড়া’র নির্দেশ আসলে কোরান ও বিশ্ব-প্রকৃতি থেকে জ্ঞান অর্জন করার নির্দেশ।আল-কোরানের আয়াত ২:২ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে কোরানের জ্ঞানভাণ্ডারে প্রবেশের চাবিকাঠি হলো “ইমান” ও “তাকওয়া”।

আল-কোরান বিশ্বাসীদের জন্য দলীল।এ কথার আসল তাৎপর্য হলো, দলীল যেমন সম্পত্তির মালিকের কাছে তার মালিকানার বৈধ প্রমানপত্র, কোরানও তেমনি বিশ্বাসীদের কাছে আল্লাহর অস্তিত্বের বৈধ প্রমানপত্র।তাদের কাছে আর অন্য কোনও প্রমানের প্রয়োজন নাই।বিশ্বাসীদের জন্য কোরান হলো জ্ঞানের ভাণ্ডার।

স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্য ও সৃষ্টি প্রশাসন সম্পর্কিত জ্ঞান,ন্যায়-অন্যায়,পাপ-পূণ্য সম্পর্কিত জ্ঞান,-এসব কিছুই আল-কোরানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।বিশ্বাসীদের জন্য সহজ-সরল পথ প্রদর্শনের আলোক বর্তিকা এই আল-কোরান,সমগ্র মানব জাতির জন্য আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত।স্তূপিকৃত কঠিন পাথর দ্বারা আল্লাহ পাহাড় তৈরী করেছেন ।কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় সেই পাথরের বুক চিরেও ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়।

আর এই আল-কোরান প্রস্তর-কঠিন মানুষের অন্তরকেও বিগলিত করে তার হৃদয় ও চক্ষুতে রক্ত ও অশ্রুর প্লাবণ বইয়ে দেয়।যেমন হয়েছিল কঠিন হৃদয় সিংহ পুরুষ হযরত উমর (রা:) এর ইসলাম গ্রহনের প্রাক্কালে।আল-কোরান মানুষের মৌলিক প্রকৃতির শিকড় ধরে টান দেয়, অস্তিত্বের গভীরে তোলে আলোড়ন, চিন্তা-চেতনায় নিয়ে আসে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব।।আর তারই প্রতিফলন ঘটেছিল ইসলামিক সভ্যতার ক্রম-বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে।ইসলাম গ্রহনের পূর্ব-মুহূর্তে হযরত উমর(রা:) এর মানসিক প্রতিক্রিয়া কোরানের আয়াত:৫৯;২১ ও ৩৯:২৩ এর সত্যতা ঘোষণা করে।

আল্লাহ বলেন:-“নিশ্চয়ই আমি উপদেশ গ্রহণ করার জন্য কোরানকে সহজ করে দিয়েছি, কে আছে তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার?”[আয়াত:৫৪:২২]
“আমি কোরানকে মানুষের জন্য সহজবোধ্য করে অবতীর্ণ করেছি আছে কি কেউ এথেকে শিক্ষা নেওয়ার?”[আয়াত—৫৪:৩২]
মানুষের কাছে কোরানকে সহজ বোধ্য করার লক্ষ্যে কোরানে গৃহীত আল্লাহর পদক্ষেপ সমূহ নিম্নরূপ:

১. আমি এ কোরানে মানুষদের (বোঝানোর} জন্য (ছোট বড়)সব রকমের উদাহরণই পেশ করেছি,যাতে করে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।[আয়াত:৩৯:২৭]
২. ভাষা-শৈলী,সুর-লালিত্য ও ধ্বনি-মাধুর্য যা কোরানকে হেফজ করা মানুষের জন্য সহজ করে দিয়েছে। পপৃথিবীতে এমন গ্রন্থ আর দ্বিতীয়টি নাই যা কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে এমন স্থান করে নিয়েছে।

“ আল্লাহ পাক সর্বোৎকৃষ্ট বাণী অবতীর্ণ করেছেন, তা এমন (উৎকৃষ্ট) কিতাব যার প্রতিটি বাণী পরস্পরের সাথে সামঞ্জস্যশীল, অভিন্ন((যেখানে আল্লাহর ওয়াদাগুলি বারবার পেশ করা হয়েছে),যারা তাদের প্রভুকে ভয় করে,এ (কিতাব শোনার) ফলে তাদের চামড়া (শরীর) কেঁপে ওঠে,অতঃপর তাদের দেহ ও মন বিগলিত হয়ে আল্লাহ পাকের স্মরণে ঝুঁকে পড়ে;-------“ । [আয়াত:৩৯:২৩ ]

৩. ইহুদিদের মতো না জানা বস্তুর কার্য-কারন সম্পর্কের ভিত্তিতে আল্লাহর অস্তিত্ব বুঝার চেষ্টা না করে, অজ্ঞতার অন্ধকারে হাঁতড়ে না ফিরে মানুষের জ্ঞানের আলোকে,জ্ঞাত বস্তুর মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্ব অনুসন্ধান করেতে হবে। এটাই কোরানের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।আল-কোরানে আল্লাহ বলেন-
“মূলতঃ প্রতিটি মানুষ – যে আনুগত্যের দিকে ফিরে আসতে চায়,(এর প্রতিটি জিনিসই) তার চোখ খুলে দিবে।এবং তাকে(আল্লার অস্তিত্বের )পাঠ মনে করিয়ে দিবে”।[আয়াত-৫০:৮]

“যারা (নিশ্চিতভাবে) বিশ্বাস করতো বিশ্বাসকারীদের জন্যে পৃথিবীতে নিদর্শনাবলী রয়েছে, এবং তোমাদের নিজেদের (এদেহের) মধ্যেও, তোমরা কি অনুধাবন করবেনা? আকাশে রয়েছে তোমাদের রিযিক ও প্রতিশ্রুত সব কিছু।“[আয়াত:৫১:২০-২২]

মানুষের বুঝার সুবিধার জন্য আল্লাহ কোরানকে সহজ করে দিয়েছেন।কিন্তু আমরা আমাদের স্বার্থবুদ্ধি ও নির্বুদ্ধিতার কারনে একে জটিল করে ফেলছি।ব্যক্তি,পরিবার,সমাজ জীবন ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিসরে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সৃজনশীল কোরান অনুশীলণের কোনও বিকল্পনাই।

পাশ্চাত্যশিক্ষা- সংস্কৃতির কলুষ-কদর্যতা থেকে ইসলামী মূল্যবোধ, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো আল-কোরান।ধর্মহীন তথা ধর্ম-নিরপেক্ষ বস্তুবাদী মতাদর্শ মানব জাতিকে প্রবৃত্তির দাসে পরিনত করেছে। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সর্বোচ্চ ইসলামী নৈতিকতা তথা তাকওয়া প্রতিষ্ঠা করতে হলে জাতীয় পর্যায়ে কোরান ও বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতেহবে। তথাকথিত গনতান্ত্রিক অধিকার বা মানবাধিকারের নামে ধর্মীয়মূল্যবোধ, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে কলুষিত করার অধিকারকে কোরান কখনও স্বীকৃতি দেয়নি। কোরানের দৃষ্টিতে এটা শাস্তি যোগ্য গর্হিত অপরাধ।

আল্লাহর নাজিলকৃত গ্রন্থ ও বিশ্ব-জগতে দৃশ্যমান আল্লাহর নিদর্শন সমূহ অস্বীকার কারী সমস্ত বস্তুবাদী নাস্তিকদের কোরান অন্ধ,মূক ও বধির বলে আখ্যা দিয়েছে। কোরানবলে –“তাদের অন্তর আছে কিন্তু তারা বুঝতে পারেনা, তাদের চোখ আছে কিন্তু তারা দেখতে পায়না,তাদের কান আছে কিন্তু তারা শুনতে পায়না- তারা পশু সদৃশবা তারও অধম, তারা বেপরোয়া, কখনও ভ্রূক্ষেপ করবেনা”। আল্লাহ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্ব-জগত ও মানুষকেসৃষ্টিকরেছেন।অন্ধ প্রকৃতির খেয়াল-খুশী তাই বিশ্ব-প্রশাসন ও ক্রম-বিকাশের চালিকা-শক্তি হতে পারেনা।

আল-কোরানে আল্লাপাকের সুস্পষ্টঘোষণা- আমি সত্য দিয়ে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড বানিযেছি। “(হে মানুষ) তুমি কি দেখতে পাওনা, আল্লাহ তা’আলা আসমান ও জমীনকে যথাবিধি (সত্য দিয়ে) সৃষ্ট করেছেন,তোমাদের অস্তিত্ব বিলোপ করে নতুন(কোনো) সৃষ্টি (তোমাদের জায়গায়) আনয়ন করতে পারেন।“ [আয়াত:১৪:১৯]
কোরান ও বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই কেবল সেই সত্যকে উপলব্ধি করাযায়।

প্রকৃতি বিজ্ঞান ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বস্তু-জগতের (আয়াতে মুহকাম)অন্তর্নিহিত সত্যকে প্রকাশ করে,পক্ষান্তরে আল-কোরান ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য(আয়াতে মুহকাম) ও অতিন্দ্রিয় (আয়াতে মুতাশাবিহাত) উভয় সত্যের মধ্যে সংযোগ সেতু নির্মান করে।বস্তু-জগতের চিরন্তন বাস্তবতা (Ulmate Naure of Things) অনুধাবন করতে হলে এই দুই সত্যের সম্মিলনের মাধ্যমেই তা সম্ভব।

আল- কোরানেরআয়াত-৪১:৫৩ এর মাধ্যমে আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছেন- অচিরেই আমি আমার (কুদরতের) নিদর্শন সমূহ দিগন্ত বলয়ে প্রদর্শন করবো এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যেও (তা আমি দেখিয়ে দেবো), যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের ওপর এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে,এ (কোরানই মূলতঃ)সত্য; (হে নবী! আপনার জন্য) এ কথা কি যথেষ্ঠ নয়,আপনার প্রভু (আপনার) সব কিছু সম্পর্কে অবহিত। [আয়াত-৪১:৫৩]

উপরোক্ত আয়াতটির মাধ্যমে একটা বিষয় পরিষ্কার যে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার মাধ্যমেই কেবল মানবজাতি কোরানের সত্যতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।আপেক্ষিক তত্ব, এসট্রোফিজিকস, কসমোলজির মাধ্যমে ম্যাক্রো পর্যায়ে ও জীব-বিজ্ঞান,জেনেটিক্স,আণবিক ও কোয়ান্টাম বায়োলজির মাধ্যমে মাইক্রো পর্যায়ে আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য উদঘাটন করে বিজ্ঞান আল-কোরানের সত্যতা ঘোষণা করবে।

আল্লার সর্বব্যপী জ্ঞান পুরা সৃষ্টি-জগত বেষ্টন করে আছে,কোরানের মাধ্যমে সেই জ্ঞান আল্লাহ মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন, সৃজনশীল ভাবে সেই জ্ঞান মানব জাতির কল্যানে ব্যবহার করার জন্য।যে কোনও যুগ বা কালে মানব জাতির বিকাশমান জ্ঞান-ভাণ্ডারের সঙ্গে সম্পৃক্তির মাধ্যমেই কেবল এই সৃজশীলতার বিকাশ সম্ভব।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ