আবদুর রশীদ।। পৃথিবীতে বসবাসরত সকল জীবজন্তুর সর্বাদিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বেঁচে থাকা৷ আর একটি প্রাণী বেঁচে থাকে কেবল তার রিজিকের উপর ভিত্তি করে৷ কোনো প্রাণীর রিজিকের সম্পূর্ণ অভাব ঘটার অর্থ হল মৃত্যু সুনিশ্চিত৷ কেননা মহান আল্লাহ তা'য়ালা প্রতিটি প্রাণীকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উত্তম রিজিকের ব্যবস্থা করে রেখেছেন; এমনকি কতখানি রিজিক বরাদ্দ তাও নির্দিষ্ট তকদিরে লিপিবদ্ধ আছে৷ মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, আর জমিনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহরই এবং তিনি জানেন তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল। সব কিছু আছে স্পষ্ট কিতাবে৷ (সূরা হুদ: ৬)
রিজিক মহান আল্লাহ তা'য়ালা কর্তৃক বড় নেয়ামত৷ উক্ত রিজিক প্রতিটি প্রাণী ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে প্রাপ্ত হয়ে থাকে৷ রিজিক বৃহৎ অর্থে ব্যবহৃত হয় ৷ রিজিক বলতে শুধু খাদ্য বোঝায় না; বরং জীবন অতিবাহিত হওয়ার যে মাধ্যমগুলো রয়েছে প্রায় সবগুলোই রিজিকের সাথে সম্পৃক্ত৷ যেমন- ব্যবসা, চাকরী থেকে শুরু করে ধনসম্পদ, বাড়ি-গাড়ি, জায়গা-জমি, উপহার ও দান-সদকা, জ্ঞান-বুদ্ধি ইত্যাদি রিজিকের অন্তর্ভুক্ত৷
মহান আল্লাহ তা'য়ালা কাউকে পরিশ্রমের উপর ভিত্তি করে উপযুক্ত উত্তম রিজিক দান করেন, কাউকে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে রিজিক কমিয়ে দেন আবার কাউকে বিনা হিসেবে অঢেল রিজিক দান করে থাকেন৷ মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, আর যাকে চান বিনা হিসাবে রিজিক দান করেন’। (সূরা ইমরান: ২৭) তিনি আরো বলেন, 'আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা করেন রিজিক বাড়িয়ে দেন এবং সঙ্কুচিত করেন। (সূরা আর-রাদ: ২৬; বনী-ইসরাঈল: ৩০; সূরা আনকাবুত: ৬২; সূরা আর-রুম: ৩৭; সূরা সাবা: ৩৯; সূরা যুমার: ৫২; সূরা শুরা: ১২)
আমরা এমন কিছু রিজিক প্রাপ্ত হয় যা কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই অর্জিত হয়৷ যেমন- দেখার জন্য চোখ, চলার জন্য পা ইত্যাদি না চাইতেই প্রাপ্ত হয়েছি৷ আবার এমন কিছু রিজিক আমরা প্রাপ্ত হয় যা সাধারণত আমরা কোনো দিন ইচ্ছা পোষণও করিনি৷ এছাড়াও এমন কিছু রিজিক প্রাপ্ত হয় যা প্রচেষ্টা করে অর্জন করতে হয়৷ তাই আজ কেবল সেই রিজিক প্রসঙ্গে ধারণা দিব যেগুলো সাধারণত প্রচেষ্টার ফলেই অর্জিত হয়৷ এমন রিজিকগুলো চিহ্নিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
ধরুন, আপনার বাড়ির সামনের ফল গাছে বিপুল পরিমাণ ফল ধারণ করেছে৷ এখানে ফলগুলো হল আপনার রিজিক৷ এখন উক্ত রিজিক আপনাকে প্রচেষ্টা করে অর্জন করতে হবে৷ গাছ থেকে না ছাড়িয়ে যদি ঘরে বসে থাকেন, তাহলে উক্ত রিজিক আপনার থাকা স্বত্ত্বেও বঞ্চিত হবেন৷ অতঃপর বলতে পারেন না যে, রিজিকগুলো আসলে আপনার ছিল না৷ এমন উক্তি গ্রহণযোগ্য নয়৷
পথ দিয়ে হেটে যাচ্ছেন এমন সময় আপনার কিছু পরিচিতজন পাশের দোকান থেকে ডাক দিলেন তাদের নাস্তার টেবিলে যোগ দিতে ৷ এখানে ওই আহ্বানটা হল আপনার রিজিক৷ এখন উক্ত রিজিক আপনার প্রচেষ্টার উপর নির্ভরশীল ৷ যদি যোগ দেন, তাহলে প্রাপ্ত হবেন ৷ অন্যথায়, বঞ্চিত হবেন৷
আপনি কোনো পরিচিত কিংবা অপরিচিত লোককে কোনো কাজে সহায়তা করলেন যার বিনিময়ে খুশিতে সে আপনাকে ছোট্ট কিছু উপহারের প্রস্তাব করলেন৷ এখানে উক্ত প্রস্তাবটি হল আপনার রিজিক৷ চাইলে আপনি উক্ত রিজিক গ্রহণ করতে পারেন৷ যদিও আপনার অন্তরে কোনো বিনিময় পাওয়ার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছা ছিল না৷
আপনি কোনো কারণে বেকার হয়ে আছেন এমতাবস্থায় কেউ আপনাকে কোনো চাকরীর প্রস্তাব দিলেন৷ মনে রাখবেন, ওই প্রস্তাবটি হল আপনার রিজিক৷ এখন যদি বলেন আমার কারো দয়ার প্রয়োজন নেই, তাহলে আপনি নিজেই নিজের রিজিক থেকে বঞ্চিত হবেন ৷
পবিত্র কোরআনে সূরা কাসাসের ২৩-২৫ নং আয়াতে হযরত মূসা আ.-এর একটি ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে৷ হযরত মূসা আ. একটি হত্যার অভিযোগে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়ে মাদাইয়ানের কূপের কাছে উপস্থিত হন৷ সেখানে একদল লোক তাদের পশুগুলোকে পানি পান করাচ্ছে এবং তাদের পেছনে দুইজন নারী তাদের পশুগুলোকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷
হযরত মূসা আ. তাদের দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে উত্তরে তারা বলল যে, আমরা ওই রাখালগুলো চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করাতে পারব না৷ অতঃপর মূসা আ: তাদের পক্ষ হয়ে পশুগুলোকে রাখালদের ভিড়ে প্রবেশ করিয়ে পানি পান করালেন এবং নারীদের কাছে পৌঁছে দিয়ে কোনো কথা ছাড়ায় তিনি একটু দূরে গিয়ে ছায়ার নিচে বসে পড়লেন এবং আল্লাহর কাছে শুধু দু'য়া করলেন৷
কিছুক্ষণ পর ওই নারীদের একজন দ্রুত এসে মূসা আ.-কে বললেন, আপনার উপকারের দরুন আমার পিতা (হযরত শোয়াইব) আপনাকে পুরস্কৃত করার জন্য আমন্ত্রণ করছেন৷ মূসা আ. আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সেখানে যায় এবং তাঁর পরিস্থিতির কথা সম্পূর্ণভাবে খুলে বলেন৷ অতঃপর তিনি পুরস্কৃত হলেন এবং উক্ত নারীদের মধ্য থেকে একজনকে বিয়ের প্রস্তাবও পান৷ হযরত মূসা(আ.) প্রস্তাবটি গ্রহণ করলেন এবং একটি চাকরিও পেয়ে যান৷ অতচ মূসা আ. একটু পূর্বেও নিঃস্ব অবস্থায় ছিলেন৷
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হল মূসা আ. ওই নারীর প্রস্তাব পাওয়ার পর বলেননি যে, আমি এমনি খুশিতে কাজটি করেছি, আমার পুরস্কারের প্রয়োজন নেই; বরং তিনি বুঝতে পারলেন যে, উক্ত প্রস্তাবটি হল আল্লাহর পক্ষ থেকে রিজিক৷ ফলে গ্রহণ করায় সাফল্য লাভ করলেন ৷ মনে রাখবেন, আল্লাহ তা'য়ালা ওই জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করে না যারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা পরিবর্তন করে না৷
তবে এটাও জেনে রাখুন— আপনার প্রচেষ্টার পরেও যদি রিজিক না মিলে যে রিজিকের সন্ধানে প্রচেষ্টা করেছেন, তাহলে বুঝবেন আসলেই সেটা আপনার রিজিক ছিলনা ৷ কিন্তু প্রচেষ্টা না করেই এমনটা চিন্তা করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয় ৷
এছাড়াও গরিবদের কিছু হক্ব ধনীদের উপর আবর্তিত৷ তাই যখন কোনো ধনী ব্যক্তি গরীব কোনো ব্যক্তিকে দান করেন তা যেন সাথে সাথে গ্রহণ করে ফেলে ৷ কেননা সেগুলো হল তাদের হক্ব কিংবা আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক; তা ধনীদের কোনো দয়া নয় ৷ আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, 'আর আল্লাহ রিজিক তোমাদের কতককে কতকের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন৷ (সূরা নাহল: ৭১)
অপরদিকে আপনি পুরোপুরি শারীরিক এবং আর্থিকভাবে সামর্থবান৷ এখন আপনার উচিত দ্রুত বিয়ে করা৷ এখানে আপনার সামর্থবানই হল রিজিক ৷ যদি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও বিলম্ব করেন, তাহলে নিজেই নিজের রিজিক থেকে বঞ্চিত হবেন৷ এক্ষেত্রে রিজিক হিসেবে সেরা উপহার হল আপনার প্রণয়ী স্ত্রী৷ অতএব, রিজিক হাজার প্রকারের হতে পারে৷
আল্লাহ তা'য়ালা সূরা জুম'আর ১০নং আয়াতে তাঁর রিজিক বা অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে আমাদের আদেশ করেছেন৷ এখন গুরুত্বপূর্ণ হল হালাল রিজিক অনুসন্ধান করা৷ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হালাল অনুসন্ধানে নিজেদের নিয়োজিত রাখা একান্ত অপরিহার্য৷ যদি কেউ হারাম ও অবৈধ উপার্জনের পথ ছেড়ে হালালের সন্ধানে নিজেকে নিবেদিত রাখে, তার উচিত মহান রবের নিম্নোক্ত কথাটি স্বরণে রাখা ৷ আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দিবেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না। আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন'। (সূরা তালাক্ব: ৩)
সূরা আনকাবুতের ১৭নং আয়াতে মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন যে, আমরা যেন তার কাছেই রিজিক তালাশ করি৷ সুতরাং আমাদের উচিত আল্লাহ প্রদত্ত রিজিককে মূল্যায়ন করা, তাঁর কাছেই রিজিক তালাশ করা, তার কর্তৃক প্রাপ্ত রিজিককে হারামে রূপান্তরিত না করা এবং তাঁর প্রদত্ত রিজিককে চিহ্নিত করে উত্তম রিজিক প্রাপ্ত হওয়ার সাফল্য লাভ করা৷ আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুক৷ আমিন!
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ চট্টগ্রাম, সদস্য, বাংলাদেশ নবীন লেখক ফোরাম
-এটি
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        