।।মুফতী গোলাম রাজ্জাক কাসেমী।।
দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেলো মাহে রমজানের অধিকাংশ প্রহর ৷ আমরা কি এর যথাযথ মূল্যায়ন করতে পেরেছি ? এর উত্তর হয় যদি 'না' তাহলে বলি, এখনো সময় আছে; এখনো সুযোগ হাত ছাড়া হয়নি ৷ সময় এখন তওবা করে নিজেকে পাপমুক্ত করার ৷ আত্মসংশোধনের মধ্যদিয়ে খোঁজে নিতে হবে উত্তরণের পথ ৷ যেন বিগত অবহেলিত দিনগুলোর ক্ষতি কাটিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারি ৷ তবেই হবে সত্যিকারের মুক্তি ৷ মনে রাখতে হবে, সময়ের কাটা কারো জন্য অপেক্ষা করে না ৷ পাপ মোচনের শ্রেষ্ঠ মুহুর্তগুলো হারিয়ে যাচ্ছে কর্পূরের মতো ৷ যাপিত জীবনের পাপ মোচনের পূর্বেই যদি রমজানের বেলা ফুরিয়ে যায় হেলায়-খেলায়, তাহলে এ জীবন ব্যর্থ ৷ অথচ মাহে রমজান গুনাহ মাফ এবং মাগফিরাত লাভের মধ্য দিয়ে চিরশান্তি ও চিরমুক্তির একটি সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু যে ব্যক্তি এ সুযোগ কাজে না লাগায়— তার ধ্বংস অনিবার্য, তার বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
কেননা, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, নবী (সা.) মিম্বারে ওঠলেন এবং বললেন—আমিন, আমিন, আমিন। বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি মিম্বারে উঠছিলেন এবং বলছিলেন, আমিন, আমিন, আমিন। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই জিবরাইল আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি বললেন, যে রমজান পেলো অথচ তাকে ক্ষমা করা হলো না, সে জাহান্নামে যাবে এবং আল্লাহ তাকে দূরে সরিয়ে দেবেন—বলুন আমিন। আমি বললাম আমিন; যে তার মা-বাবা উভয়কে পেলো অথবা তাদের একজনকে পেলো অথচ তাদের মাধ্যমে সে পুণ্যের অধিকারী হতে পারলো না এবং সে মারা গেলো, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং আল্লাহ তাকে দূরে সরিয়ে দেবেন—বলুন আমিন। আমি বললাম আমিন; যার কাছে আপনার নাম উচ্চারিত হলো অথচ সে আপনার প্রতি দরুদ পাঠ করলো না এবং মারা গেলো, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং আল্লাহ তাকে দূরে সরিয়ে দেবেন—বলুন আমিন। আমি বললাম আমিন। (সহিহ ইবনে হিব্বান : ১৮৮)
অপর এক হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি রমজান পেয়েও নিজের পাপ মোচন করাতে পারলো না মহানবী (সা.) তাকে ধিক্কার দিয়ে বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক, যার কাছে রমজান মাস এসে চলে গেল অথচ তার পাপগুলো ক্ষমা করা হয়নি।’ (আদাবুল মুফরাদ : ৫০২)
আমাদের মনে রাখা দরকার, যে দোয়ায় স্বয়ং নবীজী (সা.) 'আমিন' বলেছেন— সে দোয়া কখনও বিফলে যায় না। নবীজি (সা.) যার জন্য ধ্বংসের দোয়া করেছেন তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী ৷ তাই আমাদের সতর্ক হওয়া জরুরি, রমজান শেষ হবার পূর্বেই ভেবে দেখা দরকার, আত্মশুদ্ধি অর্জনে আমরা নিজেদের কতটুকু পরিপূর্ণ করতে পেরেছি।
আল্লাহ তাআলা রমজান মাসে সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)
আর আল্লাহভীতির মূলকথা হলো গুনাহ ও পাপ থেকে বেঁচে থাকা। এ জন্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও তদানুযায়ী আমল করা বর্জন করেনি, তার এই পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ ( বুখারি : ১৯০৩)
অপর হাদিসে এসেছে, ‘অনেক রোজাদার এমন আছে, যাদের রোজা পালনের সার হলো তৃষ্ণার্ত আর ক্ষুধার্ত থাকা। ’ (ইবনে মাজাহ : ১৬৯০)
মাহে রমজান মাগফিরাত লাভের শ্রেষ্ঠ সুযোগ ৷ তাই এ মাসে উঠতে-বসতে সর্বাবস্থায় আমরা এ দোয়া পাঠ করবো— ‘আসতাগফিরুল্লাহা রাব্বি মিন কুল্লি যামবিও ওয়াতুবু ইলাইহি।’ অর্থ: ‘আমি আমার প্রভু আল্লাহর কাছে আমার সমুদয় পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তারই দিকে প্রত্যাবর্তন করছি।’
পাশাপাশি সিয়াম পালনের এই পবিত্র মাসে নিজেকে গুনাহমুক্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ৷ কেননা, যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা, অন্যায়, অপরাধমূলক চিন্তাভাবনা এবং অসৎ কাজকর্ম থেকে বিরত থেকে রোজা রাখাও পাপ মার্জনা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাধ্যম ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “মানব সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের সাওয়াব দশ গুন থেকে সাতশ গুন পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, আদম সন্তানের যাবতীয় আমল তার নিজের জন্য কিন্ত রোজা বিশেষ করে আমার জন্যই রাখা হয়। আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দিবো। রোজা পালনকারীর জন্য তা ঢাল স্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারো রোজার দিন আসে সে যেন ঐ দিন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে এবং অনর্থক শোরগোল না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করতে চায়, সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার”। সে মহান আল্লাহর শপথ, যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন! রোজা পালনকারীদের মুখের দুর্গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে কস্তুরীর সুগন্ধির চেয়েও উত্তম হবে। আর সিয়াম পালনকারীদের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে— যার মাধ্যমে সে অনাবিল আনন্দ লাভ করে। একটি হলো, যখন সে ইফতার করে তখন ইফতারির মাধ্যমে আনন্দ পায় আর দ্বিতীয়টি হলো, যখন সে তার প্রভুর সাথে মিলিত হবে তখন সে রোজা পালনের জন্য আনন্দিত হবে।” ( মুসলিম : ২৫৯৬)
অপর হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজান মাসের রোজা পালন করবে, আল্লাহ তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন। ’ ( বুখারি : ১৯০১) অন্যত্র এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'যুদ্ধের মাঠে ঢাল যেমন তোমাদের রক্ষাকারী, রোজাও তদ্রূপ জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার ঢাল।'
( ইবনে মাজাহ :১৬৩৯)
এছাড়া পবিত্র রমজানের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে আল্লাহ বান্দার দোয়া কবুল করেন এবং পাপ মার্জনা করেন। যেমন ইফতারের আগমুহূর্ত। এই সময়গুলোতে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি প্রার্থনা করা এবং অতীত পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত । রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না—(১) ন্যায়পরায়ণ শাসক, (২) রোজাদার যতক্ষণ না সে ইফতার করে এবং (৩) মাজলুম ব্যক্তির দোয়া। ’ ( ইবনে মাজাহ : ১৭৫২)
লেখক-মুহাদ্দিস ও বিভাগীয় প্রধান আরবি ভাষা ও সাহিত্য, মদিনাতুল উলুম মাহমুদিয়া, নারায়ণগঞ্জ ৷
-কেএল
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        