নূর মুহাম্মদ রাহমানী
চলছে ইবাদতের মাস রমজান। এটি আমল সঞ্চায়নের মাস। দান-দাক্ষিণ্যের মাস। সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাস। এ মাসের প্রতিটি আমলই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এতে প্রতিটা কাজে সওয়াব হয় অনেক। একে সত্তর। এ মাসের অন্যতম একটি আমল হতে পারে মানুষকে সাহরি খাওয়ানো। আমরা সাধারণত মানুষকে ইফতার করানোতে উদগ্রীব থাকি। এটা অবশ্যই অনেক বড় নেক কাজ। কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের মানুষকে সাহরি খাওয়ানোর দিকেও নজর দেওয়া দরকার। সাহরিকে রাসুল (সা.) বরকতময় খাবার বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি খাও, কেননা সাহরিতে বরকত রয়েছে।’ (বুখারি : ১৮২৩)। সাহরির এ খাবারে বরকত ধরে রাখতে হলে যারা সাহরির ব্যবস্থা করতে পারে না তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
সাহরির মাধ্যমে একজন রোজাদার রোজা রাখা ও পূর্ণ করার শক্তি পায়। সহজে অন্যান্য ইবাদত করা তার জন্য সহজ হয়। তাই এটা অনেক বড় ইবাদত। যারা সাহরি খাবে তারা সাধারণত ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে পড়বে। আর সাহরির সময় তো দোয়া কবুলের সময়। তারা সে সময় মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করারও সুযোগ লাভ করবে। সে সময় সাহরি আয়োজনকারীর জন্য তারা প্রাণভরে দোয়া করবে। এটা তো অনেক বড় সফলতার কথা। সৌভাগ্যের কথা।
গরিব-অসহায় মানুষ যাদের সাহরির ব্যবস্থা করতে কষ্ট হয় তাদের জন্য সাহরির ব্যবস্থা করা। বাসা-বাড়িতে দাওয়াত করে এনে খাওয়ানো। সম্ভব না হলে তাদের বাড়িতে খাবার পাঠিয়ে দেওয়া। ক্ষুধার সময় মানুষকে খাবার দেওয়া অনেক বড় ইবাদত। মানুষকে খাবার দেওয়ার নির্দেশ করেছেন প্রিয়নবী (সা.)। তিনি বলেছেন, ‘কয়েদীকে মুক্ত কর, ক্ষুধার্তকে খাবার দাও এবং অসুস্থের সেবা কর।’ (বুখারি : ৩০৪৬)। খাবার খাওয়ানো মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণ। নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম, যে খাবার খাওয়ায়।’ (আততারগিব ওয়াত তারহিব : ৯৪৮)। খাবারে বেশি মানুষকে শরিক করা খুবই বরকতের। এ খাবারকে উত্তম খাবার বলেছেন প্রিয়নবী (সা.)। তিনি বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর নিকট ওই খাবার উত্তম যাতে ভক্ষণকারী হাত বেশি থাকে।’ (সিলসিলাতুত সহিহাহ : ১৪৯৪)।
সাহাবায়ে কেরাম সাহরি খাওয়ানোর আমলটি খুব গুরুত্বের সঙ্গে করতেন। বিশিষ্ট তাবেয়ি তাউস (রহ.) থেকে বর্ণনা আছে, ‘আমি ইবনে আব্বাস (রা.) কে বলতে শুনলাম, ওমর (রা.) সাহরিতে আমাকে খাওয়ার জন্য ডেকেছেন। এরই মধ্যে লোকদের হট্টগোল শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী হচ্ছে? আমি বললাম, মানুষ মসজিদ থেকে বের হচ্ছে।’ (মুখতাসারু কিয়ামিল লাইল : ৯৭)। মূলত লোকেরা যৌথভাবে সাহরি খাওয়ার পর বের হচ্ছিলেন।
বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর সঙ্গে কখনও কখনও তাঁর শাগরেদ কম আর বেশি যা কিছু থাকত তা দিয়েই সাহরি খেতেন। ইবনে আবি শায়বা (রহ.) আমের ইবনে মাতার (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) ঘরে এলাম, তিনি সাহরির অতিরিক্ত খাবার বের করলেন। আমরা তাঁর সঙ্গে সাহরি খেলাম। নামাজের জন্য ইকামত বলা হলে আমরা বের হলাম এবং তাঁর সঙ্গে নামাজ পড়লাম।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৯০২৪)। সিলাহ ইবনে যুফার (রহ.) বলেন, আমি হুজাইফা (রা.) এর সঙ্গে সাহরি খেলাম। তারপর মসজিদে চলে গেলাম। দুই রাকাত ফজরের সুন্নত পড়লাম, অতঃপর নামাজের জন্য ইকামত বলা হলে আমরা নামাজ পড়লাম।’ (নাসায়ি : ২১৫৪)। এ ছাড়াও আরও বহু বর্ণনা দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায়, সাহাবায়ে কেরাম সাহরি খাওয়ানোর আমলটি গুরুত্ব দিয়েই করতেন।
যিনি বলেন আমার অন্তর অনেক পাষাণ। আমি এ বদ স্বভাবের পরিবর্তন ঘটাতে চাই। তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ হবে মানুষকে সাহরি খাওয়ানো। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.) এর দরবারে অন্তরের কঠোরতার অভিযোগ করলেন। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি চাইলে তোমার অন্তর নরম হবে, তুমি মিসকিনকে খাবার দাও এবং এতিমের মাথায় হাত রাখ।’ (মুসনাদে আহমদ : ৭৫৭৬)। মানুষকে সাহরি খাওয়ানো অনেক বড় আমল। এ আমল মানুষকে জান্নাত পর্যন্ত নিয়ে যায়। আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণিত, তিনি রাসুল (সা.) কে বললেন, ‘এমন আমল বলে দেন, যা জান্নাত আবশ্যক করে দেবে। তিনি বললেন, ‘ভালো কথা বলা এবং খাবার খাওয়ানো।’ (আল মুজামুল কাবির : ৪৭০)।
সাহরিতে রান্না করতে যেয়ে তরকারিতে একটু বেশি পরিমাণে ঝোল দেওয়া, যেন গরিব প্রতিবেশীদের শরিক করা যায়। প্রতিবেশীদের খাবার দেওয়ার গুরুত্ব দিয়েছেন প্রিয়নবী (সা.)। হজরত আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে আবু জর, যখন তুমি ঝোল রান্না কর, তখন এতে পানি বেশি দাও এবং প্রতিবেশীদের স্মরণ রেখ।’ (মুসলিম : ৬৬৮৮)।
আমি নিজে পেট ভরে সাহরি খেলাম। কিন্তু আমার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকল। এটা অনেক বড় অমানবিকতা। এটা কোনো মুসলমানের কাজ হতে পারে না। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে নিজে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।’ (মুসনাদে আবি ইয়া‘লা : ২৬৯৯)।
অসহায় মানুষকে খাবার না দেওয়ার পরিণতি অনেক খারাপ। যে সকল ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ নিজেরা উদর পূর্তি করে; কিন্তু অভাবী অসহায় মানুষদের প্রতি নজর দেয় না, তাদের সম্পর্কে কোরআনে এসেছে, ‘তারা কিয়ামতের দিন জাহান্নামে থাকবে এবং তারা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ বলবে, আমরা না নামাজ পড়তাম, না মিসকিনদের খাবার খাওয়াতাম।’ (সুরা মুদ্দাস্সির : ৪৪)। তাই অন্তত এ অভিশাপ থেকে বাঁচতে হলেও অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত। তাদের সাহরি খাওয়ানো উচিত।
বাসা-বাড়ির কাজের লোকদের নিয়ে সাহরি খাওয়া। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছেন, ‘যখন তোমাদের মধ্যে কারও খাদেম খাবার নিয়ে আসে, তখন সে যদি তাকে সঙ্গে না বসায়, তাহলে কমপক্ষে এক দু লোকমা এ খাবার থেকে তাকে খাইয়ে দেবে, কেননা সে (রান্না করার সময়) এর গরম ও তৈরি করার কষ্ট সহ্য করেছে।’ (বুখারি : ৫৪৬০)।
আল্লাহ তায়ালা সওয়াব কুড়ানোর এ মহান মাসে আমাদের বিত্তবান লোকদের অভাবী লোকদের প্রতি সুনজর দেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক হাদিস ও ফতোয়া বিভাগ, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ
আওয়ার ইসলামে লেখা পাঠাতে মেইল করুন-newsourislam24@gmail.com
ওআই/আবদুল্লাহ তামিম
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        