 মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব : পবিত্র কুরআন শরিফে ‘রিবা’কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় ‘রিবা’কে সুদ বলা হয়। মূলত আরবি ‘রিবা’র মূলমর্ম ও প্রকৃত অর্থপ্রকাশক উপযুক্ত প্রতিশব্দের অভাবে এর অনুবাদ করা হয় উর্দু ও ফার্সী শব্দ ‘সুদ’ দিয়ে।
মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব : পবিত্র কুরআন শরিফে ‘রিবা’কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় ‘রিবা’কে সুদ বলা হয়। মূলত আরবি ‘রিবা’র মূলমর্ম ও প্রকৃত অর্থপ্রকাশক উপযুক্ত প্রতিশব্দের অভাবে এর অনুবাদ করা হয় উর্দু ও ফার্সী শব্দ ‘সুদ’ দিয়ে।
সুদকে ইংরেজিতে বলা হয় ইউজারি (usury) বা ইন্টারেস্ট (interest)। ‘রিবা’ পরিভাষাটি আরবি শব্দমূল ‘রাবউন’ থেকে উদ্ভুত। যার বাংলা অর্থ হচ্ছে বেশি হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, অতিরিক্ত হওয়া, সম্প্রসারিত হওয়া, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু আরবির রিবাকে উর্দু ভাষার ‘সুদ’ শব্দ দিয়ে অনুবাদ করলেও এর পূর্ণ অর্থ প্রকাশ পায় না। বরং উর্দু ‘সুদ’ আরবি ‘রিবা’ এর ব্যাপক অর্থের একটি অংশ মাত্র। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্ব নির্ধারিত হারে যে অধিক পরিমাণ পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয়, তাই ‘রিবা’ বা সুদ।
রিবা প্রধানত দুই প্রকার : ১. রিবা নাসিআহ; একে রিবাল করয ও রিবাল কুরআনও বলা হয় ২. রিবাল ফদল; একে রিবাল বাইও রিবাল হাদিসও বলা হয়।
রিবান নাসিআহ : আরবি ‘নাসিআহ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে মেয়াদ, সময় নেয়া, বিলম্ব বা প্রতীক্ষা করা। ইমাম আবু বকর আল জাস্সাস তার বিখ্যাত তাফসির ‘আহকামুল কুরআনে’ রিবার সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে: ‘রিবান নাসিআহ হচ্ছে ঋণের ওপর সময়ের অনুপাতে ধার্যকৃত অতিরিক্ত অংশ।’ জাহিলিয়াতের সময় সুদ ছিল, কোনো নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রদত্ত ঋণের আসলের উপর ঋণগ্রহীতা কর্তৃক দেয় নির্ধারিত অতিরিক্ত।’ অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রদানের শর্তে কাউকে মেয়াদি ঋণ দেয়া। যেমন কেউ যদি কাউকে ১০০ টাকা ঋণ দেয় এ শর্তে, তাকে মেয়াদান্তে ১১০ টাকা দিতে হবে। এখানে অতিরিক্ত ১০ টাকাকে রিবান নাসিআহ বলা হবে। (আহকামুল কোরআন ১/৫৫৭) প্রখ্যাত মুফাস্সির জারির ইবন আত-তাবারি মুজাহিদের সূত্রে জাহেলি যুগে প্রচলিত রিবা সম্পর্কে নিম্নে বর্ণিত হাদিস উল্লেখ করেছেন, ‘জাহিলি যুগে কোনো ব্যক্তি ঋণদাতার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করত। অতঃপর সে ঋণদাতাকে বলত, আমি এতো এতো পরিমাণ বেশি দেবো, আমাকে সময় বাড়িয়ে দাও।’ ইমাম ফখরউদ্দিন আর-রাজি জাহিলি যুগের রিবা সম্পর্কে বলেছেন, ‘জাহিলিয়াতের যুগে রিবান নাসিআহ ছিল সুপরিচিত ও স্বীকৃত। সে সময় তারা অর্থ ঋণ দিত এবং মাসিক ভিত্তিতে একটা অতিরিক্ত পরিমাণ আদায় করত, কিন্তু মূলধন ঠিক থাকত। অতঃপর মেয়াদ শেষে ঋণদাতা ঋণগ্রহীতার কাছে আসল অঙ্ক ফেরত চাইত। ঋণগ্রহীতা আসল অঙ্ক ফেরত দিতে না পারলে ঋণদাতা আসলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দিত এবং মেয়াদ বাড়িয়ে দিত।’ এ ছাড়া হাদিসে রিবা বা সুদের সংজ্ঞায় আরো বলা হয়েছে, ‘যে ঋণ মুনাফা টেনে আনে তাই রিবা বা সুদ।’
রিবাল ফদল: আরবি ‘ফদল’ শব্দের অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত। একই জাতীয় জিনিস লেনদেনে কমবেশি করে আদায় করার নাম রিবাল ফদল। অর্থাৎ, একই জাতীয় দ্রব্য বা মুদ্রার লেনদেনকালে একপক্ষ আরেক পক্ষের নিকট থেকে চুক্তি মোতাবেক শরিয়ত সম্মত বিনিময় ব্যতিত যে অতিরিক্ত মাল গ্রহণ করে তাকে রিবাল ফদল বলে। যেমন, এক কেজি উন্নতমানের খেজুরের সাথে দেড় কেজি নিম্নমানের খেজুর বিনিময় করা। রিবাল ফদলকে মালের সুদও বলা হয়। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘সোনার বিনিময়ে সোনা, রূপার বিনিময়ে রূপা, গমের বিনিময়ে গম, যবের বিনিময়ে যব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবণ আদান-প্রদান করলে, তা সমান সমান ও হাতে হাতে হতে হবে। অর্থাৎ নগদ হতে হবে। কমবেশি করলে বা বাকিতে করলে, তা সুদী কারবার বলে গণ্য হবে। এতে দাতা-গ্রহীতা সমান অপরাধী বিবেচিত হবে।’ (বুখারি, মুসলিম)
রিবান নাসিআহর প্রচলিত কয়েকটি রূপ
১. সুদী ব্যাংক: বাংলাদেশের সুদী ব্যাংকগুলোর অন্যতম প্রধান কার্যক্রম সাধারণ স্বল্প সুদে ঋণ নেয়া ও বেশি সুদে ঋণ দেয়া। সুদী ব্যাংকগুলো সুদের কার্যক্রমে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখে না। আরও নানা কার্যক্রম করে থাকে। তাই ওলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত হলো সুদী ব্যাংকের কারেন্ট একাউন্ট ছাড়া বাকি সব একাউন্ট সুদী একাউন্ট। চাই তা উচঝ হোক বা ঋউজ হোক অথবা সাধারণ ফিক্সড ডিপোজিট হোক; সবই রিবান নাসিআহ একাউন্ট। তবে ইদানিং ঝঘউ কারেন্ট একাউন্ট নামে এক ধরনের একাউন্ট বের হয়েছে। তাতে সুদের মিশ্রণ দেয়া হয়। এ ধরনের সুদী একাউন্ট খোলাই গুনাহ। কারণ সুদের চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া গুনাহ। আর সুদ গ্রহণ করলে তো সুদ খাওয়ার গুনাহ হয়ই। তাছাড়া সুদী ব্যাংকগুলোবিভিন্ন নামে লোন দিয়ে থাকে। যেমন কার লোন, হোম লোন, হাউজ লোন, ইনভেস্টমেন্ট লোন, সিসি লোন, কৃষি লোন, স্টুডেন্ট লোন ইত্যাদি। এগুলো সবই রিবান নাসিআহ। কারণ এ ধরনের লোনে ঋণ দিয়ে সুদ গ্রহণ করা হয়।
২. প্রচলিত প্রাইজবন্ড : বর্তমান প্রচলিত প্রাইজবন্ডে রিবান নাসিআহ রয়েছে। কারণ যে টাকা দিয়ে প্রাইজবন্ড কেনা হচ্ছে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ঋণ হিসেবে আছে। সুতরাং প্রাইজবন্ড ছাড়ার পর একটি নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর ড্র করার মাধ্যমে বিজয়ীদেরকে যে পুরুস্কার দেয়া হয় তা ঋণের বিনিময়ে দেয়া হচ্ছে বিধায় তা রিবান নাসিআহ বা সুদ। {ফাতওয়ায়ে উসমানী-৩/১৭৩-১৭৬}
৩. জমি বন্ধক : বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায়ই জমি বন্ধকের নিয়মটি চালু আছে।জমির মালিক জমি প্রার্থীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে। বিনিময়ে টাকার মালিক বন্ধক জমিটি ভোগ করে এবং মেয়াদান্তে পুরো টাকা ফেরত পায় এবং জমির মালিক তার জমি হস্তগত করে নেয়। এখানে জমির মালিক জমি বুঝে পায় আর টাকার মালিক টাকা বুঝে পায় কিন্তু মাঝখানে টাকার মালিক ঋণ দেয়ার কারণে যে জমিটি ভোগ করল সেটি নিঃসন্দেহে রিবান নাসিআহ এর অন্তভুর্ক্ত, যা হারাম। এধরনে বন্ধক বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন নামে প্রচলিত থাকলেও সবগুলোর হুকুম একই। ঋণদাতার জন্য বন্ধকি জমি ভোগ করা সম্পূর্ণ নাজায়েজ।
উল্লেখ্য, উক্ত কারবার বৈধভাবে করতে চাইলে শুরু থেকেই বন্ধকি চুক্তি না করে ভাড়া বা লীজ চুক্তি করবে। যার বিবরণ হলো, জমির মালিক জমি ভাড়া দেবে। তার যত টাকা প্রয়োজন সেজন্য যত বছর ভাড়া দিতে হয় একত্রে তত বছরের জন্য ভাড়া দেবে এবং অগ্রিম টাকা নিয়ে নেবে। যেমন, এক বিঘা জমির বার্ষিক ভাড়া ৫ হাজার টাকা। মালিকের ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। তাহলে সে ৪ বছরের জন্য জমি ভাড়া দেবে। এক্ষেত্রে অগ্রিম ২০ হাজার টাকা নিয়েনেবে। এক্ষেত্রে জমির ভাড়া স্থানীয়ভাড়া থেকে সামান্য কম বেশিও হতে পারে। এরপর ভাড়ার মেয়াদ শেষ হলে অর্থ দাতা জমি ফেরত দেবে, কিন্তু প্রদেয়টাকা ফেরত পাবে না।
মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৮/২৪৪-২৪৫, শরহু মুখতাসারিত তহাবী ৩/১৪৯, রদ্দুল মুহতার ৬/৪৮২, বাদায়েউস সানায়ে৫/২১২, শরহুল মাজাল্লা, খালেদ আতাসী ৩/১৯৬-১৯৭, ইলাউস সুনান ১৮/৬৪, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা,হাদীস: ২১০৭৮ ১৩/৬৪৮,আন্নুতাফ ফিল ফাতাওয়া২৯৬, বাদায়েউস সানায়ে৬/৫১৮, ফাতাওয়ায়ে খানিয়া ৩/৫৯৬, ফাতাওয়ায়ে বাযযাযিয়া ৬/৭৪, রদ্দুল মুহতার ৬/৫২৩, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ৩৭৮৩, ফাতহুল কাদীর ৬/৮০-৮১
লেখক : সম্পাদক, মাসিক আরবি ম্যাগাজিন ‘আলহেরা’
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        