বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ।। ১৮ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫


রাজনীতির দৃশ্যপটে ঐক্যফ্রন্ট নাটকীয়তার শেষ কোথায়?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ এহসানুল হক
আলেম, লেখক

জাতীয় নির্বাচন এলেই দেশটা অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। ভাঙাগড়ার খেলায় মেতে উঠে রাজনৈতিক দলগুলো। পর্দার আড়ালে শুরু হয় নেপথ্য কারিগরদের আনাগোনা। কূটনৈতিক পাড়ায় তাকালেই চোখে পড়ে রথি-মহারথি ও কুশীলবদের দৌড়ঝাপ। প্রতিপক্ষের অচল মামলাগুলো সচল হয়ে ওঠে। প্রয়োজন হলে রায় চলে আসে অবিশ্বাস্য গতিতে।

রাজনৈতিক সমঝোতায় কখনো হাসপাতাল হয়ে উঠে নিরাপদ ঠিকানা। কান পাতলেই শোনা যায় দরকষাকষির নানা রকম হিসাব। সকালের সমীকরণ বিকালে বদলে যায়। কে কখন কার বিপক্ষে চলে যায় কিছুই বলা যায় না।

অন্য সব নিবার্চনের মতো এবারও দলবদল ও ভাঙাগড়ার খেলা চলছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে বাহ্যত তেমন কোনো পরিবর্তন না এলেও সবকিছু আছে তাদের নখদর্পনে, চলছে তাদের ইশারায়। জোটের কলেবর বৃদ্ধির অসুস্থ প্রতিযোগিতায় কদর বেড়েছে ছোট দলগুলোর।

পিছিয়ে নেই ইসলামি দলগুলোও। কোনো দল প্রকাশ্যে, আবার কোনো দল অপ্রকাশ্যে সরকারের আনুকুল্য পাবার চেষ্টায় নিয়োজিত আছে। আবার দু’একটি ইসলামি দল দৃঢ়তার সাথে থেকে গেছে সরকারবিরোধী মোর্চায়।

এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সরকারের শেষ সময়ে এসে একটি বিকল্পশক্তি তারা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বেগম জিয়া দীর্ঘদিন যাবৎ এ ধরনের একটি জাতীয় ঐক্যের আহবান করছিলেন।

গত কয়েক বছরের ইফতার মাহফিলে ঐক্যফ্রন্টের এসব নেতৃবৃন্দ একত্রিত হলেও রাজনীতির মাঠে তারা এক শামিয়ানার নিচে সমবেত হবেন- এমনটা সুদূর পরাহত মনে হতো। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত ১৩ অক্টোবর প্রেসক্লাব থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যাত্রা শুরু করেছে।

সাত দফা দাবি ও ১১টি লক্ষ্যকে সামনে রেখে গণফোরামের ড. কামাল হোসেন, জেএসডির আ.স.ম আব্দুর রব, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বিএনপি নেতাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন।

বেগম জিয়ার এত চেষ্টায় কাজ না হলেও এখন কার ইশারায়, কার প্রভাবে তারা ঐক্যবদ্ধ হলেন- সেই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়। এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে আগামী দিনে বিএনপির ভবিষৎ।

ঐক্যফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার দিনে আরেকটি বড় ঘটনা ছিল বি. চৌধুরীর বিকল্পধারার এই ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ে যাওয়া। এই প্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরী।

২২ সেপ্টেম্বর ঐক্যবদ্ধ প্রথম সমাবেশেও তিনি ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ও ড. কামাল হোসেন ঐক্যবদ্ধ থাকার ওয়াদা দিয়ে কাগজে স্বাক্ষরও করেছিলেন। কিন্তু তার পুত্র মাহী বি. চৌধুরীর কারণে এক সাথে পথচলা আর সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়, বিকল্পধারা দেড়শ আসন দাবি করে রাজনৈতিক মহলে হাসির খোরাক জুগিয়েছেন।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে পারা বিএনপির সাফল্য এই অর্থে যে, অনেক দিন পর বিএনপি একটা স্পেস তৈরি করতে পেরেছে। দাঁড়ানোর জায়গা পেয়েছে। বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বের যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

ধারণা করা যায়, স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গী হওয়ার অপবাদও এবার কিছুটা মোচন হবে। দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় এসব নেতাদের যদিও ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব নেই। এককভাবে নির্বাচন করলে বিজয়ী হওয়া তো দূরের কথা জামানতও টিকবে না।

কিন্তু তাদের ফেসভ্যালুর কারণে তাদের সামনে রাখতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির সফলতা হলো, এসব ব্যক্তিবর্গের ইমেজ ব্যবহার করতে গিয়ে তাদের পুরোনো সঙ্গি বিশ দলীয় জোট ও জামাতের ভোটব্যাংক হাতছাড়া করেনি। দুটি পক্ষকেই তারা পাশে রাখতে পেরেছে।

এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর সংকট থেকে বেরিয়ে আসার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য ও মুক্তিযুদ্ধেও অগ্রসেনানী এসব ব্যক্তিবর্গ সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে- এটুকুই প্রাপ্তি বিএনপির। এরচেয়ে বেশি কিছু না।

রাজনীতির এই অস্থির সময়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন ও তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দেখে যে বিষয়টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা হলো- ক্ষমতার এই লড়াই করতে গিয়ে বিএনপি তার স্বকীয়তা ও আদর্শ থেকে খানিকটা দূরে সরে যাচ্ছে।

বিএনপির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বিএনপি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি দল। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এই ভিত্তির ওপরই দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার পরবর্তীতে বেগম জিয়া বিএনপিকে নিয়ে এতকাল সে পথেই হেঁটেছেন। ফলশ্রুতিতে ইসলামপন্থিদের সমর্থন সর্বদা বিএনপির দিকেই ছিল। কিন্তু এবার বিএনপি ভিন্ন পথে হাঁটছে।

ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মাধ্যমে একদিকে তারা বামপন্থি শক্তিকে কাছে টানছে, অপর দিকে ইসলামপন্থি শক্তিকে উপেক্ষা করে চলছে। বিশ দলীয় জোটের বাইরের অন্য ইসলামি দল বা আলেম উলামাদের কাছে টানার তো কোনো তৎপরতাই নেই।

এমন কি শোনা যাচ্ছে, বিশ দলের শরিক ইসলামি দলগুলোকেও বিএনপি এখন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে বিশাল একটি জনগোষ্ঠির সমর্থন তারা সব সময়ের জন্য হারিয়ে ফেলতে পারে।

তাছাড়া ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের অতীত রাজনীতিও স্মরণে রাখা দরকার। ড. কামাল হোসেন মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানে ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন। আসম রব ছিলেন শেখ মুজিবের ‘চার খলিফার’ একজন।

সুলতান মনসুর ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি। মাহমুদুর রহমান মান্না আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। আজ তারা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হলেও তারা সকলেই এক সময়ে আওয়ামী ডাকসাইটে নেতা।

বিএনপির পারপাস তারা কতটা সার্ভ করবেন, সেটা নিয়ে সন্দেহেরে যথেষ্ট কারণ আছে। এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারে সরকার। সরকার এখন এসব নেতাদের যতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, বিএনপি ততোটা পিছিয়ে যাচ্ছে।

বিএনপি নেতারা এতকাল সংলাপের আহবান করলেন কাজ হলো না, ড. কামাল হোসেন গণফোরামের প্যাডে চিঠি লেখার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই সংলাপের জন্য সরকার রাজি হয়ে গেল। আলোচনা হবে আওয়ামী লীগ বনাম ঐক্যফ্রন্ট। লাইম লাইটে আর বিএনপি নেই।

হতে পারে রাজনীতির দৃশ্যপটে ঐক্যফ্রন্টকে সামনে এনে বিএনপি তথা জিয়া পরিবারকে মাইনাস করার আয়োজন চলছে। আর সবকিছু বুঝেও ফাঁদে পা দিতে হচ্ছে বিএনপির। কারণ বিএনপির সামনে এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প আপাতত নেই।

কেউ যদি মনে করে ঐক্যফ্রন্টের দুই সমাবেশ ও হুমকি ধামতিতে সরকার কাবু হয়ে সংলাপ দিয়েছে- তাহলে সেটা ভুল হবে। এমন কোন পরিস্থিতি ঐক্যফ্রন্ট এখনো সৃষ্টি করতে পারেনি। ক্ষমতার শেষ সময়ে সরকার এমনিতেই একটু নমনীয় থাকে।

তাছাড়া সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু ঘটনা অপ্রত্যাশিতভাবেই সরকারের বিপক্ষে গেছে। ভার্সিটি ছাত্রদের কোটা বিরোধী আন্দোলন এবং তার কিছুদিন পর স্কুল ছাত্রদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সরকারের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছে। এবং আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ছাত্রলীগের পেটোয়া বাহিনী যে নির্মম অত্যাচার করেছে তার ক্ষত এখনো শুকায়নি।

এই দুটি আন্দোলনের ফলে ছাত্র জনতার মাঝে সরকারের জনপ্রিয়তা এখন শূন্যের কোঠায়। এর কিছুদিন পর সরকারের এক সময়ের বিশ্বস্ত সহচর সাবেক প্রধান বিচারপতি বিদেশে বসে বোমা ফাটিয়েছেন।

আত্মজীবনিমূলক গ্রন্থ ‘দ্যা ব্রোকেন ড্রিম’ এ সরকারের অন্দর মহলের গোপন অনেক কথা ফাঁস করে হইচই ফেলে দিয়েছেন। আর বিদেশীদের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের চাপ তো অনেক আগে থেকেই আছে।

সর্বশেষ যোগ হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। ডান-বাম সকলের সমন্বয়ে গড়ে উঠা এই ঐক্যফ্রন্ট রাজনীতিতে যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে, সেই উত্তাপকে শীতল করতেই দেয়া হয়েছে সংলাপ। সংলাপে রাজি হয়ে সরকার বল ঠেলে দিয়েছে বিএনপির কোর্টে।

বেগম জিয়ার দশ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে এবার যাও গণভবনে। আতিথিয়তা গ্রহণ কর। এতদিন বিএনপি সংলাপ চেয়েছে। আর এখন সংলাপই যেন গলার কাটা। এটাই হচ্ছে পলিটিক্যাল গেম। মনে রাখতে হবে সংলাপের মত এমন ভদ্রচিত কর্মসূচিতে আজ পযর্ন্ত কোন সংকটের সমাধান আসেনি।

সামনের দিনগুলোতে আরও কী হবে- বলা যায় না। কত ধরনের নাটকীয়তা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আল্লাহই ভালো জানেন। আরও যা হতে পারে- বিশ দলীয় জোটে ফাঁটল ধরানোর চেষ্টা হয়তো আগের মতই অব্যাহত থাকবে।

সরকারের প্রধান মিত্র জাতীয় পার্টি তো আছেই। আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা সঙ্গ ছাড়বেন বলে মনে হয় না। যেসব দলকে সরাসরি মহাজোটে নেয়া সম্ভব না, তাদের ঠিকানা হবে জাতীয় পার্টি। বিকল্পধারাকেও সামনে নিয়ে আসতে পারে সরকার।

বিকল্পধারা ঐক্যফ্রন্টে থাকতে না পারলেও দেড়শ আসন দাবি ও স্বাধীনতার ইস্যুকে সামনে এনে সরকারের সুদৃষ্টি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে হয়। তাছাড়া বিএনপির ওপর তাদের পুরোনো ক্ষোভ আছে। পুরোনো ঘা এখন আরও তাজা হয়েছে।

হঠাৎ করে বিশ দল থেকে বের হওয়া দলগুলো ও শমশের মুবিন চৌধুরীর বিকল্পধারায় যোগদানের মাধ্যমে সেই সম্ভবনাই আরও দৃঢ় হয়েছে।

আলো-আধারীর এই খেলায় কে জিতবে তাতো নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এখন পযর্ন্ত দেশের যে পরিস্থিতি তাতে মনে হয়, ঐক্যফ্রন্টসহ বিএনপি যদি এখন নির্বাচনে আসে, তাহলে তারা সর্বোচ্চ বিরোধীদল হতে পারবে।

আর যদি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার মত পরিবেশ সৃষ্টি করে তারপর নির্বাচনে আসতে চায়, তাহলে আরও অনেক পথ পারি দিতে হবে। অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ নিজেদের বিজয় নিশ্চিত না করে সরকার কখনোই নির্বাচনই দিবে না। দেয়ার কথাও না।

অন্য কোন দল ক্ষমতায় থাকলে তারাও এটাই করতো। প্রয়োজনে নির্বাচনই পিছিয়ে দেয়া হবো। সরকারের প্রধান মিত্র এরশাদ ইতোমধ্যে নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের কথা বলেছেন। সেটা অবশ্যই তার নিজের কথা ছিল না। এই কথার অনেক গুরুত্ব আছে। নির্বাচন পেছানোর কোনো অজুহাত এখনও দৃশ্যমান না হলেও সরকার চাইলে সেটা সৃষ্টি হতে সময় লাগবে না।

‘বিজেপি মুসলিম নাম পরিবর্তনের নোংরা রাজনীতি করছে’

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ