সোমবার, ২০ মে ২০২৪ ।। ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১২ জিলকদ ১৪৪৫


দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম মুহতামিম হাজি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আবেদ হুসাইন রহ.


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ফাইল ছবি

।।তাওহীদ আদনান ইয়াকুব।।


হযরত হাজি সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আবেদ হুসাইন। ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর জেলার দেওবন্দ নামক গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ছিলেন আল্লাহভীরু, তাক্ওয়াবান ও পরহেজগার এবং নম্র-ভদ্র ।

তিনি ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাকালীন মুহতামিম। চিশতিয়া সাবেরিয়া তরিকার সুপ্রসিদ্ধ ও সর্বজন বিদিত একজন সাধক ও শায়েখ। তার জীবন ছিল তাক্বওয়া পরহেজগারিতায় পরিপূর্ণ। হজরত হাজি সাহেবের সবচেয়ে বেশি সম্মান-মর্যাদা ও প্রভাব ছিল দেওবন্দ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহে। দেওবন্দ এলাকার সুবিশাল গ্র্যান্ড জামে মসজিদ নির্মাণও তাঁর কঠোর পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফসল।

সাইনবোর্ড

শিক্ষা-দীক্ষা-
হজরত হাজি সাহেবের নাম আবেদ হুসাইন ও মুহাম্মদ আবেদ উভয়ভাবেই পাওয়া যায়। নিজ এলাকায় কুরআন শরীফ ও ফারসি অধ্যায়ন সমাপ্ত করে দিল্লিতে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিক্ষা জীবনেই তাসাউফের প্রতি এতটা অনুরাগী ছিলেন যে, (আল্লাহ পাকের ইচ্ছা) তিনি আর পড়া-লেখা সমাপ্ত করতে পারেননি। কিন্তু অধিক ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাতের দরুন একাধিক বুযুর্গের খেলাফত পেয়েছেন। বিশেষ করে মাওলানা মুহাম্মদ হাসান রামপুরী (মৃত্যু ১২৭৯ হিজরি)-এর খলিফা হযরত মিয়াজি করিম বখশ সাবেরী রহ. (রামপুর মনিহারান) এবং হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ. থেকে খেলাফত লাভ করেন।

তাসাউফ ও সুলুকে তার অবস্থান-
হাজি সাহেবের পীর ও মুর্শিদ মিয়াজি করিম বখশ রামপুরী একবার স্বপ্নে দেখেন যে, আকাশে একটি বিশাল তারকা, আর তার চারপাশে আরো অনেক তারকা। বড় তারকাটি তার কোলে এসে গেছে। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, একজন বড় মাপের মানুষ আমার কাছে বাইয়াত হবেন, যিনি আনুগত ও সুন্নাতের পাবন্দ। তার দ্বারা সাধারণ লোকেরা অনেক উপকৃত হবেন এবং তিনি বহুবিধ ধর্মীয় কাজ সম্পাদন করবেন।
(তাজকিরাতুল আবিদীন, নাজির আহমদ দেওবন্দী, পৃ. ৬৭, তারিখে দারুল উলুম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃ. ২২২) 


হযরত হাজি সাহেব রহ. তার জীবনের ৬০ টি বছর অবস্থান করেছিলেন মসজিদেই। তার জীবনীতে পাওয়া যায় ৩০ বছর তার তাকবীরে উলা ছুটেনি। তাহজ্জুদ নামাজের এমন পাবন্দ ছিলেন যে, ৬০ বছর পর্যন্ত কখনো তাহাজ্জুদ আদায় বাদ পড়েনি। প্রজ্ঞা ও হেদায়েত এবং তাযকিরা ও তাযকিয়ায়ে নফসের পাশাপাশি ছিলেন ইলমে রুকইয়ায় পারদর্শী। অসংখ্যা কাজের চাপেও সময়সীমার প্রতি ছিলেন খুবই সচেতন। প্রতিটি কাজ যথাযথ সময়ে সম্পাদন করা ছিল তার সাধারণ একটি বিষয়। তিনি রাতের শেষভাগে ঘুম থেকে উঠে যেতেন। এরপর তাহাজ্জুদ আদায় করে তাসবিহ তাহলিল শেষ করে ফজরের নামায আদায় করতেন দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্তা মসজিদে। নামাজ পড়ার পর তিনি বাইরে বের হতেন। যারা বাইয়াত হতে ইচ্ছুক তাদের বাইয়াত করতেন। মহল্লার লোক ও ছাত্রদের ঝাড়-ফুঁক করতেন। দুপুর পর্যন্ত এভাবেই কাটত। এরপর মুরিদানরা আসতো। আসর পর্যন্ত তাদের নিয়ে যিকির-আযকারে কাটাতেন। মাগরিবের পর খতমে খাজেগান পড়তেন। এশা আদায়ান্তে আগেভাগেই ঘুমিয়ে যেতেন।
ঝাড়-ফুঁক নিতে আসা লোকেরা মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত করতো। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল ও বিনয়ী একজন মানুষ। কখনো তাকে বিচলিত হতে দেখা যায়নি। একবার জানা গেল যে, তার মুরিদের একজন হাজি মুহাম্মাদ আনোয়ার দেওবন্দি দুঃখ-কষ্টে আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি তৎক্ষণাৎ চিঠি লিখলেন যে, এই কাজ সুন্নাতের পরিপন্থী। খানা-পিনা বন্ধ করে দেওয়াটা ঠিক নয়। অল্প করে হলেও খাওয়া-দাওয়া বজায় রাখা উচিত। তারপর তিনি তার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসলেন। আনোয়ার কাসমীর জীবনীমূলক পাণ্ডুলিপিতে একটি লেখা পাওয়া যায় যে, “হাজি সাহেব দেওবন্দে একজন প্রভাবশালী, আস্থাভাজন ও পরহেযগার ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মহত্ত্বের প্রভাব প্রতিটি নারী ও পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধের হৃদয়ে ছিল। দেওবন্দে তাঁর আধ্যাত্মিক অনুগ্রহে দেওবন্দ ও এর আশেপাশের এবং অন্যান্য প্রদেশের মানুষের হৃদয় ছিল মোহিত। 


হযরত হাজি সাহেব রহ. ও দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা-
দারুল উলূম দেওবন্দের জন্য সর্বপ্রথম গণ অনুদান সংগ্রহ শুরু করেছিলেন তিনিই। হযরত নানুতুবি রহ.-এর জীবনীতে হাজি ফজল হক রহ. দারুল উলুম দেওবন্দের জন্য অনুদানের পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। “একদিন হযরত হাজি  সাইয়্যেদ আবেদ হুসাইন রহ. একটি সাদা রুমাল দিয়ে থলে বানিয়ে তাতে নিজ পকেট থেকে তিন টাকা রেখে ছাত্তা মসজিদ থেকে একাকী মরহুম মৌলভি মেহতাব আলীর কাছে যান। তিনি ছয় টাকা দান করেন এবং দোয়া করেন। মৌলভি ফজলুর রহমান সাহেব বারো টাকা দেন এবং হাজি  ফজল হক সাহেব ছয় টাকা দান করেন। সেখান থেকে উঠে মৌলভি জুলফিকার আলী রহ.-এর কাছে আসেন, তিনি বারো টাকা দেন এবং ঘটনাক্রমে সাইয়েদ জুলফিকার আলী সানী দেওবন্দি তখন সেখানে ছিলেন, তিনিও বারো টাকা দেন। সেখান থেকে তিনি মহল্লায়ে আবুল বারকাত নাম গ্রামে পৌঁছলে অল্প সময়ের মাঝেই দুইশত টাকা জমা হয়ে যায় এবং পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পেতে তা সন্ধ্যার মধ্যে তিনশত টাকায় পরিণত হয়। তারপর ধীরে ধীরে আলোচনা চলতে থাকে দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার। সবশেষে এর ফলাফল আজ আমাদের সম্মুখে দৃশ্যমান।”
(সাওয়ানেহে মাখতুতাহ, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৫৮-২৫৯)


আজ থেকে দেড়শত বছর আগে সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে সাধারণ মানুষের অনুদানের ভিত্তিতে ইসলমি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছিল এক অদ্ভুত ও নতুন বিষয়। আগত পাবলিক ও গণতান্ত্রিক যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এটি ছিল বিশ্বাস ও ভবিষ্যদ্বাণীর এক বিরাট সন্নিবেশ। পূর্বেকার সময়ের ওয়াকফ পদ্ধতির পরিবর্তে, জনসাধারণের অনুদানের এই পদ্ধতিটি ছিল অত্যন্ত সফল। ধর্মীয় বিদ্যালয় ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার ও তার প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে এটা ছিল একটি সফল পদক্ষেপ, যার ফলে দ্বীনি শিক্ষার পদ্ধতির নতুন দ্বার উন্মোচন হয়। সর্বশেষ ১৫ই মুহাররম ১২৮৩ হিজরি মোতাবেক ৩১ মে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ রোজ বৃহস্পতিবার মসজিদে ছাত্তায় অত্যন্ত সাদামাটাভাবে মাদরাসায়ে আরাবিয়া (পরবতী কালের দারুল উলুম) দেওবন্দের পথচলা শুরু হয়। যদিও মাদরাসা হিসেবে এর পরিধি তখন ছিল অত্যন্ত সীমিত ও ছোট কিন্তু বাস্তবে তা ছিল হিন্দুস্তানের জমিনে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান প্রচলন ঘটানোর এক মহা আন্দোলনের সূচনা। হাজি সাহেব রহ. দেওবন্দের প্রাথমিক মুহতামিমদের অন্তুর্ভূক্ত হন। তার সম্মান ও মর্যাদা এবং প্রভাবের দরুন দেওবন্দের অনেক সুযোগ-সুবিধা ও উন্নতি-অগ্রগতি অর্জন হয়। আর তিনিও ছিলেন প্রতিটি মুহূর্তে দেওবন্দের উন্নতি-অগ্রগতির প্রতি সজাগ ও সচেতন এক পথযাত্রী।


দারুল উলুম দেওবন্দ পরিচালনা-
দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াও তিনি ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিস শুরার অন্যতম সদস্য এবং প্রথম মুহতামিম। দারুল উলুম দেওবন্দের পরিচালনার দায়িত্ব তার হাতে তিন তিনবার ন্যস্ত হয়। তিনি সর্বমোট দেওবন্দের মুহতামিম ছিলেন একে একে দশ বছর। শেষ পর্যন্ত অতি ব্যস্ততার কারণে তিনি পরিচলনা পদ থেকে চূড়ান্তভাবে ইস্তেফা গ্রহণ করেন।
প্রথমবার প্রতিষ্ঠা দিবস ১৫ই মুহররম ১২৮৩ হিজরি মোতাবেক ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৮৪ হিজরির রজব মোতাবেক ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত মুহতামিম ছিলেন। ১২৮৪ হিজরিতে হজরত হাজি সাহেব হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ফলে তখন একটি বড় ও বৈষয়িক ঘটনা ঘটেছিল যে, দেওবন্দের সমস্ত লোক এবং মাদরাসার উস্তাদ ও ছাত্ররা বলাবলি করা শুরু করে দিয়ছিল যে, এই প্রতিষ্ঠান এখন চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। অর্থাৎ হাজি  সাহেব  হজ্দৃবে যাওয়ার ইচ্ছা করে বসেছেন। আর তার অবস্থাভেদে মনে হচ্ছিল তিনি আর হিন্দুস্তান ফিরে আসবেন না। অপরদিকে আশেপাশের এলাকায় তার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল অত্যাধিক। তার কারণেই ছাত্রদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা সম্ভর হয়েছিল আসানির সাথে এবং অনুদানও দেওয়া হতো খুব উৎসাহের সাথে। এখন যদি মনে হয় যে, তিনি আর এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় থাকবেন না তাহলে তো বিষয়টি সবার জন্য কষ্টকর বটে। কারণ দেওবন্দের বাসিন্দাদের মধ্যে দৃশ্যত এমন কেউ ছিল না যিনি মাদরাসা পরিচালনার জন্য জান-প্রাণ দিয়ে মাঠে নামবেন। তাই সবার মুখে মুখে এই কথা প্রচলিত হয়ে গেলো যে, এখন আর এই প্রতিষ্ঠান চালু রাখা সম্ভব হবে না। দেখতে দেখতে হাজি সাহেব হজে¦র সফরে চলেই যান। ফলে মজলিসে শুরা অপারগ হয়ে তার অনুপস্থিতে মাদরাসা পরিচালনার জন্য বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হন। এক পর্যায়ে রুকনে শুরার মুখলিস ও বুযুর্গ সদস্যদের অন্তর ধাবিত হলো মাওলানা রফীউদ্দীন সাহেব রহ.-এর প্রতি। তারা তাকেই যথাযোগ্য বিবেচনা করে ১২৮৪ হিজরীর শাবান মাসে তাকে পরিচালনার দায়িত্ব অপর্ণ করেন।
দ্বিতীয়বার হযরত হাজি সাহেব রহ. হজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ১২৮৬ হিজরি মোতাবেক ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় পরিচালনা পদে নিযুক্ত হন এবং ১২৮৮ হিজরি মোতাবেক ১৮৭১ সাল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ১২৮৮ হিজরিতে দারুল উলুম দেওবন্দ পরিচালনার পাশাপাশি দেওবন্দ এলাকার জামে মসজিদের নির্মাণও হাজি সাহেব রহ.-এর তত্ত্বাবধানে হচ্ছিল। উভয় কাজের জন্য সময় ও অবসর প্রয়োজন ছিল অনেক। তাই হাজি সাহেব রহ. এর কাজের বোঝা হালকা করণ ও কমানো ছিল অত্যন্ত জরুরি। তাই রুকনে শুরার মশওয়ারাক্রমে হুজুরকে কাজের সুবিধার্থে বিশ্রামের সুযোগ প্রদানে মাওলানা রফিউদ্দীন সাহেব রহ.-কে পুনরায় পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। তবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে হাজি সাহেবকে বহাল রাখা হয়।
তৃতীয়বার ১৩০৬ হিজরি মাওলানা রফিউদ্দীন সাহেব হজের সফরে গিয়ে সেখানেই বাকি জীবন কাটানোর নিয়ত করেন। ফলে আরাকিনে শুরা পুনরায় হাজি সাহেবকে দেওবন্দের মুহতামিম হওয়ার আবেদন করেন। এরপর তিনি ১৩০৬ হিজরি  মোতাবেক ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় দেওবন্দের মুহতামিম নিযুক্ত হন এবং ১৩১০ হিজরির শাবান মোতাবেক ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। 

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ