বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ।। ১০ পৌষ ১৪৩২ ।। ৫ রজব ১৪৪৭


কওমি মাদরাসাভিত্তিক রাজনৈতিক দল: বিভাজন ও ঐক্যের দোলাচল

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবদুস সাত্তার আইনী

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে কওমি মাদরাসা ধারার সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব অশীতিপর মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (১৮৯৫-১৯৮৭) স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং ৩,৮৮,৭৪১ (১.৮%) ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান লাভ করেন। তিনি ১৯৮১ সালের ২৯ নভেম্বর শায়েস্তা খান হলে একটি কর্মী সম্মেলন আহ্বান; এ-সম্মেলনে তিনি ‘বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন’ নামে তাঁর নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃতীয় স্থান লাভ ও দল গঠনের পর তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হন এবং কূটনৈতিক মহলসহ বিদেশেও তাঁর ব্যক্তিত্ব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে কওমি মাদরাসা ঘরানার আলেমগণের পদচারণার ক্ষেত্রে তিনিই পথিকৃৎ। তাঁর মৃত্যুর পর খেলাফত আন্দোলনের আমির হন তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র শাহ আহমাদুল্লাহ আশরাফ।

হাফেজ্জীর হুজুরের জীবদ্দশায় শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক (১৯১৯-২০১২) বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের জ্যৈষ্ঠ নায়েবে আমির ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর অভ্যন্তরীণ কারণে খেলাফত আন্দোলন দুই ভাগে ভাগ হয় (এক ভাগ থাকে আহমাদুল্লাহ আশরাফের নেতৃত্বাধীন, আরেক ভাগ থাকে শাইখুল হাদিসের নেতৃত্বাধীন)। ১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এক সম্মেলনে শাইখুল হাদিসের নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলন ও অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী যুব শিবির ও অধ্যক্ষ মাসউদ খানের নেতৃত্বাধীন মওলানা ভাসানীর ন্যাপের একাংশ একীভূত হয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস গঠিত হয়। ২০০৫ সালে খেলাফত মজলিস দুই ভাগে ভাগ হয় : খেলাফত মজলিস এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।

১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর সাতটি ইসলামি দলের সমন্বয়ে ইসলামী ঐক্যজোট গঠিত হয়। দলগুলো হলো খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও ফারয়েজী জামায়াত। ইসলামী ঐক্যজোট ছিল মূলত ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠেয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামপন্থী দলগুলোর একটি নির্বাচনী জোট। অবশ্য এটি ছিল জামায়াতে ইসলামীর বিপরীতে অন্য ইসলামী দলগুলোর জোট।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে ইসলামী ঐক্যজোটের একমাত্র সংসদ সদস্য খেলাফত মজলিস নেতা মাওলানা ওবায়দুল হককে সংসদ থেকে পদত্যাগ করানোর সিদ্ধান্ত নেয় জোটের শরিক দলগুলো। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে যায় খেলাফত মজলিস। ওইসময় ঐক্যজোটের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন মরহুম চরমোনাই পীর মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করীম। তখন মহাসচিব ছিলেন মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী। পরে আবার জোটের সঙ্গে যোগ দেয় খেলাফত মজলিস ও ঐক্যবদ্ধভাবে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

১৯৯৭ সালে ইসলামী মোর্চা নিয়ে ঐক্যজোটে যোগ দেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী (১৯৪৫-২০১২)। জোটে যোগ দিয়েই তিনি মহাসচিব হন। তখন জোটের চেয়ারম্যান ছিলেন শাইখুল হাদীস আজিজুল হক। তাঁদের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি ও ফাতওয়া নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ কয়েকটি বড় সমাবেশ ও আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ছিল ইসলামী ঐক্যজোট।

১৯৯৮ সালে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত হয় চার দলীয় জোট। চার দলীয় জোটে ইসলামী ঐক্যজোটের যাওয়া ও না-যাওয়া নিয়ে শরিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু থেকেই চারদলীয় জোটে না-যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। শাইখুল হাদীস ও মুফতি আমিনীর নেতৃত্বে সে বছরই ইসলামী ঐক্যজোট আট দফা দাবি নিয়ে চারদলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁদের ‘নারী নেতৃত্ব মেনে নেওয়া’র প্রেক্ষিতে এক্যজোট ছেড়ে যায় অন্যতম শরিক দল শাসনতন্ত্র আন্দোলন।

ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন নারী নেতৃত্ব মেনে নেবে না বলে জাতীয় পার্টির সঙ্গে ঐক্য ঘোষণা করে জোট গঠন করে। পাঁচটি দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। দল পাঁচটি হল জাতীয় পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দল (পিএনপি) ও মুসলিম লীগ। এই জোটের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ ফজলুল করিম (১৯৩৬-২০০৬) ঘোষণা করেন যে ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের উদ্দেশ্য হল একটি ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করা। এই জোটের অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল বাংলাদেশকে আটটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশের ফেডারেশনে রূপান্তর করা এবং নারীদের প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে নিষিদ্ধ করা।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট। তখন মন্ত্রীসভায় থাকা না-থাকা নিয়ে ইসলামী ঐক্যজোটে আধিপত্যের লড়াই বাঁধে। একদিকে অবস্থান নেন জোটের চেয়ারম্যান শায়খুল হাদীস আজিজুল হক, অন্যদিকে মহাসচিব মুফতি আমিনী। শায়খুল হাদীসকে বাদ দিয়ে মুফতি আমিনী নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে নতুন ঐক্যজোট গঠন করে এবং মহাসচিব হিসেবে নেন নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী সভাপতি মুফতি মুহাম্মদ ইজহারকে। অপরদিকে শায়খুল হাদীস মুফতি আমিনীকে বহিষ্কার করে নিজে চেয়ারম্যান পদে বহাল থাকেন এবং এ আর এম আবদুল মতিনকে মহাসচিব বানান। এই বিভাজনে ইসলামী ঐক্যজোটে চারটি দল মুফতি আমিনীর সঙ্গে থাকে এবং শাইখুল হাদীসের নেতৃত্বাধীন থাকে শুধু খেলাফত মজলিস।

২০০৪ সালে মুফতি আমিনীসহ ঐক্যজোট ও সরকারের একটি দল পাকিস্তান সফরে গেলে মহাসচিব মুফতি ইজহার চেয়ারম্যানকে অবহিত না-করেই বিভিন্ন বিষয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠান। দেশে এসে মুফতি আমিনী বৈঠক ডাকলে তাতে উপস্থিত ছিলেন না মুফতি ইজহার, যদিও তাঁর দল নেজামে ইসলাম পার্টির অন্য নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকেই জোটের নেতারা মুফতি ইজহারকে মহাসচিব পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আবদুল লতিফ নেজামীকে (১৯৩৬-২০২০) মহাসচিব মনোনীত করেন। এই ঘটনার পরপরই মুফতি ইজহার নতুন ঐক্যজোট নির্মাণের ঘোষণা দেন এবং নতুন নেজামে ইসলাম পার্টি গঠন করেন। তিনি নিজে দলটির চেয়ারম্যান থাকেন এবং মিসবাহুর রহমান চৌধুরীকে মহাসচিব বানান। ২০০৫ সালে মিসবাহুর রহমান চৌধুরী এই জোট ত্যাগ করে নতুন জোট গড়ার ঘোষণা দেন এবং তাতে প্রথমে মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের জামাতা মাওলানা নুরুল ইসলাম খানকে এবং পরে হাফেজ যাকারিয়াকে মহাসচিব বানান। শেষ দুটি জোট ঢিমেতালে কিছুদিন চলার পর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। মিসবাহুর রহমান চৌধুরী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাওলানা নুরুল ইসলাম খান ইউনাইটেড ইসলামিক পার্টি নামে একটি নতুন দল ঘোষণা করেন।

২০০৮ সালে ইসলামী ঐক্যজোট একটি দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন লাভ করে। এই ঘটনায় নিজেদের বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়। এ-বছরই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় এবং জোট ছেড়ে চলে যায়। ২০১২ সালে মুফতি ফজলুল হক আমিনী মারা গেলে মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামীকে চেয়ারম্যান এবং মুফতি ফয়জুল্লাহকে মহাসচিব মনোনীত করা হয়। ২০১৬ সালের ৭ই জানুয়ারি ইসলামী ঐক্যজোটের কাউন্সিলে বিএনপির সঙ্গত্যাগের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায়ই জোটের ভাইস চেয়ারম্যান ও নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা আবদুর রকিব খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে নিজেকে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান দাবি করেন এবং ঐক্যজোট বিনএনপির নেতৃত্বাধীন বিশ দলীয় জোট ছেড়ে যায়নি বলেও জানান। নিজেকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বিনএনপি ত্যাগ করলেও ইসলামী ঐক্যজোট পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ নেয়। আবদুল লতিফ নেজামীর মৃত্যুর পর জোটটির (বা দলটির) বর্তমান চেয়ারম্যান মুফতি আমিনীর পুত্র আবুল হাসানাত আমিনী এবং মহাসচিব সাখাওয়াত হোসাইন রাজী। তাঁর আগে মহাসচিব ছিলেন মুফতি ফয়জুল্লাহ।

২০০৫ সালে খেলাফত মজলিসও দুই ভাগ হয়ে যায়। একটি ভাগ খেলাফত মজলিস নামে বিএনপির নেতৃত্বাধীন  জোটে থেকে যায়। অপর ভাগটি জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে ‘বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস’ নাম ধারণ করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি চুক্তি হয় নানাবিধ চাপে চুক্তি বাতিল হয়।

২০০৮ সালে খেলাফত মজলিস বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন লাভ করে। দলটির প্রতীক হল দেয়াল ঘড়ি। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও নিবন্ধন লাভ করে, তাদের নির্বাচনী প্রতীক রিকশা।

 বর্তমানে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মামুনুল হক ও মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ। অন্যদিকে খেলাফত মজলিসের বর্তমান আমীর মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব  আহমদ আবদুল কাদের। মাওলানা আবদুল বাছিতের পূর্বে আমীর ছিলেন সাবেক মন্ত্রী অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক।

লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক

আরএইচ/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ