মুনীরুল ইসলাম
ভাষা কোনো জাতির আত্মার প্রতিচ্ছবি। ভাষার মধ্যেই জাতির চেতনা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন তাই কেবল একটি রাজনৈতিক দাবির আন্দোলন ছিল না; এটি ছিল বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের আন্দোলন। এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের সূচনাবিন্দুতে যিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ‘বাংলা’কে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন, তিনি হলেন কুমিল্লার (তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার) ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর সেই উচ্চারণই পরবর্তীকালে জন্ম দিয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় ও প্রেক্ষাপট
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন কুমিল্লা অঞ্চলে (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়)। তিনি ছিলেন পেশায় আইনজীবী, কিন্তু হৃদয়ে ছিলেন সমাজসেবক ও দেশপ্রেমিক। ব্রিটিশ আমল থেকেই তিনি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভারত বিভক্তির পর, তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হন, কিন্তু কখনোই বাঙালির স্বকীয়তা ও সংস্কৃতির প্রতি তার ভালোবাসা ম্লান হয়নি।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের ফলে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠিত হয়। এই রাষ্ট্রের জনসংখ্যার প্রায় ৫৬ শতাংশই ছিল পূর্ববাংলার মানুষ, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। তবুও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা নেয়। এর মধ্য দিয়েই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ভাষাগত বঞ্চনা শুরু হয়। এমন এক প্রেক্ষাপটে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সাহস করে কেন্দ্রীয় আইনসভায় বাংলা ভাষার স্বীকৃতি দাবি তোলেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, এটাই ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম দাবি।
১৯৪৮ সালের ঐতিহাসিক প্রস্তাব
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদ (Constituent Assembly)-এর অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ঐতিহাসিক প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন-
“Sir, in my humble opinion, Bengali should be one of the languages of the Assembly, because out of the 69 million people of Pakistan, 44 million speak Bengali.”
এই বক্তব্যে তিনি পরিষ্কার করে জানান, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী যেহেতু বাংলাভাষী, তাই রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে বাংলাকেও স্বীকৃতি দেওয়াই ন্যায্য। তিনি যুক্তি দেন, গণপরিষদের কাজ যদি জনগণের জন্য হয়, তবে জনগণের ভাষায় সেই কাজ করা উচিত।
কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা তীব্র আপত্তি জানান। তারা বলেন, উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ বাতিল করা হয়। কিন্তু তাঁর উচ্চারিত সেই ভাষণ বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে থাকে।
বিরোধের মুখে দাঁড়িয়ে একা এক সাহসী কণ্ঠ
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সেই সভায় এককভাবে দাঁড়িয়ে গোটা জাতির দাবি উত্থাপন করেছিলেন। তিনি জানতেন, তার প্রস্তাব পাস হবে না, তবুও তিনি চুপ থাকেননি। তার সেই একক প্রতিবাদ ছিল ভবিষ্যৎ আন্দোলনের বীজরোপণ। ১৯৪৮ সালের এই উচ্চারণ পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা জুগিয়েছিল ছাত্রসমাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের মনে।
ভাষা আন্দোলনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাব
১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটি ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠিত রাজনৈতিক প্রকাশ। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা এই দাবিকে সামনে নিয়ে আসে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’- স্লোগান বাংলার রাজপথে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই আন্দোলন রক্তাক্ত রূপ নেয়- যখন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউররা শহীদ হন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সেই বীজ রোপিত হয়েছিল কুমিল্লার এক মানুষের সাহসে, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কণ্ঠে।
দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ
পাকিস্তান সরকার পরবর্তীকালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তীব্র হলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর এই বাঙালি জাতীয়তাবোধের জন্যই তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনারা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর পুত্র দিলীপ দত্তকে হত্যা করে। এভাবে এই মহান ভাষাসৈনিক নিজের জীবনের বিনিময়ে ইতিহাসে অমর হয়ে যান।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্তরাধিকার
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম বাংলা ভাষার ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা উপেক্ষিত থাকতে পারে না। তিনি ছিলেন এমন বাঙালি রাজনীতিক, যিনি পাকিস্তানি রাষ্ট্রনীতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালির অধিকার দাবি করেন। তার সাহসিকতার ফলেই বাঙালিরা তাদের ভাষার জন্য রক্ত দিতে শিখেছে, আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের প্রেরণা পেয়েছে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে পথে বাঙালি জাতিসত্তা গড়ে উঠেছিল, সেই পথের প্রথম পাথরটি বসিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। পরবর্তীতে সেই পথ দিয়েই গড়ে উঠেছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মহাসড়ক।
বাংলা ভাষার মর্যাদা ও আজকের প্রেক্ষাপট
আজ বাংলা জাতিসংঘের ৬ষ্ঠ সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। কিন্তু এই অর্জনের শেকড় খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় ১৯৪৮ সালের সেই অধিবেশনের দিকে, যেখানে এক বৃদ্ধ বাঙালি আইনজীবী তাঁর দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন- “বাংলা শুধু একটি ভাষা নয়, এটি আমার জাতির পরিচয়।
বাংলার মানুষ, ইতিহাস ও সংস্কৃতি আজ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি চিরঋণী। তাঁর প্রস্তাব হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু তা বাঙালির চেতনায় স্থায়ী বিজয় এনে দিয়েছিল।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম; পরিচালক, সম্পাদনা কেন্দ্র
আরএইচ/