মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ২১ শাওয়াল ১৪৪৫


‘বিশ্বের মুসলমানদের অসহায় চাহনির দিকে তাকালে ঈদে সত্যিকার আনন্দ লাগে না’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা লিয়াকত আলী। আলেম সাংবাদিক ও লেখক। বহুগ্রন্থপ্রণেতা ও গবেষক। কওমি মাদরাসায় পড়ালেখার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় অনার্স-মাস্টার্স করা অনন্য আলেম। ছেলেবেলার ঈদ, বর্তমানের ঈদ নিয়ে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের চীফ রিপোর্টার হাসান আল মাহমুদ- এর সঙ্গে।

ছেলেবেলায় ঈদের চাঁদ দেখার জন্য হৈ-হুল্লোড়ে মেতেছিলেন কি?

পুরো এক মাস সিয়াম সাধনা বা রোজা পালন করার পরে যখন ঈদ আসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ঈদটা অনেক আনন্দের হয়। রমজানের শেষে সবাই ঈদের জন্য অপেক্ষা করে এবং ঈদের চাঁদ দেখার জন্য মানুষ যে আগ্রহ করে, তা সবসময় ছোট-বড় সবাই উপলব্ধি করে। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমিও ঈদের চাঁদ দেখতে পাড়ার ছেলেদের সাথে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠতাম।

ঈদের চাঁদ দেখার কোন্ স্মৃতি মনে পড়ে বেশি?

বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রামের মত আমাদের গ্রামেও মসজিদের সামনে মানুষ ঈদের চাঁদ দেখার জন্য ভীড় জমাতো। চাঁদ দেখার সময় মানুষ আল্লাহু আকবর! বলে জোরে তাকবির দিত। পুরো এলাকায় শোরগোল পড়ে যেত। বয়ে বেড়াতো ঈদের নির্মল আনন্দ।

সে সময়ের আপনার জন্ম এলাকা সম্পর্কে কিছু বলুন

সাতক্ষীরা জেলার অঁজপাড়া গ্রামে আমাদের বাড়ি। অঁজপাড়া হলেও অবশ্য আমাদের শ্যামনগর  থানার মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষার দিক দিয়ে খ্বু উন্নত ছিল আমাদের গুমন্তরি গ্রাম। থানা থেকে আমাদের গ্রামটি ছিল প্রায় আড়াই কিলো দূরে। আমাদের এই গ্রামটাই মূলত পুরো থানাকে কন্ট্রোল করত। নেতৃত্ব দিত। কারণ পুরো থানার মাতবর হাজী কুরবান সরদার হলেন আমাদেরই গ্রামের। তিনি সেই বৃটিশ আমল থেকে পুরো শ্যামনগর থানার নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। পাকিস্তান হওয়ার পর যখন আওয়ামী লীগ গঠিত হয়, তখনও তিনি থানার নেতা ছিলেন। তখন থানা প্রধানকে প্রেসিডেন্ট বলা হত। তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্ট। তিনি সম্পর্কে আমার নানাও হন। নেতৃত্বের ধারাবহিকতা এখনো ওই পরিবারে অব্যাহত আছে। তো যাই হোক, আমাদের গ্রাম সম্পর্কে একটা ধারণা দিলাম।

ঈদে নতুন জামা না হলে নাকি ঈদ হয় না! ছেলেবেলায় কেমন ছিল ঈদ?

বর্তমান যুগের মত সে সময়ে এতো প্রাচুর্য্য ছিল না। এই যে আজকাল নতুন জামা না হলে ঈদ হয় না, অথচ তখনকার সময়ে নতুন কাপড় থাকতো খুব কম মানুষের। পুরাতন কাপড়কে ধুয়ে পরিপাটি করে তখনকার সময়ে  ঈদ উদযাপন করত অনেকে। তখনকার সময়ে মানুষের কাছে নগত টাকা বলতে ছিল না তেমন। সে কালে স্বচ্ছল পরিবার বলা হত তাদের, যাদের জমিতে ধান হয়, পুকুরে মাছ আছে, গোয়ালে গাভী দুধ দেয়, বাজার থেকে নিত্য নৈমিত্তিক পণ্য যাদের কিনতে হত না তারাই সে কালে স্বচ্ছল বলে বিবেচিত হত। সামজিকভাবে মানুষের প্রাচুর্য্য না থাকলেও সে কালে মানুষ এমনভাবে ঈদ উদযাপন করতো যেন পুরো এলাকা এক অন্তরের হয়ে যেত। ছেলেবেলায় দেখতাম মানুষ যেন ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে একে অপরের খুব কাছাকাছি হয়ে যেত।

বর্তমানের ঈদ কেমন কাটে?

ছেলেবেলা পেরিয়ে ক্লাস এইট শেষ করে ১৯৭৭ সালের দিকে মাদরাসায় পড়ার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়ার পর ঈদের আনন্দটা ভিন্ন রকম হয়ে গেল। সেই থেকে আজ পর্যন্ত হয়তো চার-পাঁচটা ঈদ বাড়িতে করা হয়েছে। কিন্তু অঁজপাড়া গাঁ, আর পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপনের চেয়ে আনন্দ আর কখনো পাইনি। এখন যে ঈদ করি, তা আসলে কাজের মধ্য দিয়ে ঈদ করি। এ ঈদের আনন্দ এক রকম। এখন আনন্দটা যেন একটা বৈষয়িক হয়ে গেছে। এখনকার সমাজের ঈদে আন্তরিকতাটা বলা যায় কম। ছোটবেলায় যে উচ্ছ্বাস ছিল তা যেন এখন আর নেই। ঈদের আনন্দ তো আসলে পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহ যে রোজ দিয়েছেন তা পালন করার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ  ঈদ উদযাপন। আমার কাছে মনে হয়, যে বছর রমজানের রোজা ভালোভাবে আদায় মানে ইবাদাত,তিলাওয়াত, তাসববিহ, জিকির আযকার হয় বেশি, সে বছরের রমজানের ঈদটা বেশি আনন্দায়ক হয়। ইসলামে ঈদের আনন্দ তো ইবাদাতের মধ্যে। আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করা যে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে রমজানের রোজা রাখার তৈফিক দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা রোজা রাখার জন্য যে ক্ষমা,পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন সে খুশিতে আনন্দ লাভ করা।

ছেলেবেলার ঈদকে কেমন মিস করেন?

আজকাল ছেলেবেলার ঈদ আসলে বড় বেশি মিস করি যেভাবে, তখনকার সময়ে যে বয়স ছিল তার জন্য তো আল্লাহর কাছে কোনো জবাবদিহিতা করা লাগত না। কিন্তু প্রাপ্ত বয়স হওয়ার পর প্রতিটি কাজ-কর্ম খুব হিসাব করে করতে হয়, কারণ তার জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতিা রয়েছে। এখন যখন দেখি মানুষের মধ্যে পারপারিক মিল মহবব্বত, অভাবীদের জন্য মানুষ সহানুভূতি দেখায় তখন মনে আনন্দ লাগে। পথে যারা থাকে,গরীব,অসসহায় সবাই যদি একই সাথে ঈদের আনন্দ সমহারে ভাগাভাগি করে নিতে পারত, তাহলে এখনকার দিনের ঈদ সত্যিই আনন্দায়ক হত। অথচ আজ সারা বিশ্বের অনেক মুসলমান ঈদ করেত পারছে না। যুদ্ধাহত দেশগুলোর মুসলমানরা আগের মত ইফতার করতে পারে না। তাদের কাছে রোজার ইফতারি, সেহরী এবং এক মাস রোজা রাখার আনন্দে ঈদ উদযাপন যেন স্মৃতি হয়ে গেছে।

এখনকার ঈদে কী অনুভব করেন বেশি?

এখনকার ঈদে সবচে বেশি অনুভব করি যা, তা হলো- সারা বিশ্বের মুসমলমানদের অসহায় চাহনির  দিকে তাকালে আসলে এখনকার ঈদে সত্যিকার আনন্দ লাগে না। ঈদের আনন্দটা হয়ে যায় ম্লান। যেদিন সারা বিশ্বের মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করতে পারবে সেদিন সত্যিকার ভাবেই হবে ঈদের আনন্দ। ঈদের আনন্দ তো সবার। সবার জন্যই যেন ঈদ হয় সত্যিকারের ঈদ।

হাআমা/


সম্পর্কিত খবর