সোমবার, ২০ মে ২০২৪ ।। ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ।। ১২ জিলকদ ১৪৪৫


শবেবরাত বিতর্ক : একটি দলিলভিক্তিক পর্যালোচনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মুফতি মোহাম্মাদ জাকারিয়া ||

শবে বরাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ তাৎপর্যময় রজনী। এ রাতে মহান আল্লাহতায়ালা তার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। পাপী বান্দাদের উদারচিত্তে ক্ষমা করেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন- এ জন্য এ রাতকে শবে বরাত বলা হয়।

দেশের আকাশে আজ রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) হিজরি শাবান মাসের চাঁদ দেখা গেছে। তাই সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) থেকে শাবান মাস গণনা শুরু হবে। সেই হিসাবে ২৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে (শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে) শবে বরাত পালিত হবে।

‘শবে বরাত’ ফারসি ভাষার দুটি যুক্ত শব্দ। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ নাজাত বা মুক্তি। আরবি ভাষায়ও বরাত শব্দের ব্যবহার রয়েছে। এই দুই শব্দ মিলে অর্থ হয় মুক্তির রজনী।

হাদিসের ভাষায় এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা ১৫ শাবানের রাত (১৪ তারিখ দিবাগত রাত) বলা হয়। এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে কোরআন মাজিদে সরাসরি নির্দেশনা না থাকলেও হাদিস শরিফে নির্ভরযোগ্য সনদ বা বর্ণনাসূত্রে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

■১নং হাদিসঃ—

عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: يَطْلُعُ اللَّهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ.

‘মুআজ বিন জাবাল রা. সূত্রে রাসুলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা শাবান মাসের পনেরো তারিখ রাতে তাঁর সৃষ্টিকূলের দিকে (বিশেষ রহমতের) দৃষ্টি দেন। অতঃপর মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (সহিহু ইবনি হিব্বান : ১২/৪৮১, হা. নং ৫৬৬৫, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)

#তাহকিকঃ এ হাদিসটির সনদ যঈফ বা দুর্বল হলেও একাধিক সাহাবি সূত্রে এর আরও অনেক সনদ থাকায় হাদিসটি ‘সহিহ’ এর মানে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, যা আহকাম বা ফাজায়িল সব ক্ষেত্রেই প্রমাণযোগ্য।

■শাইখ আলবানি রহ. এ হাদিসটির ব্যাপারে মন্তব্য করেন :

حديث صحيح، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا وهم معاذابن جبل وأبو ثعلبة الخشني وعبد الله بن عمرو وأبي موسى الأشعري وأبي هريرة وأبي بكر الصديق وعوف ابن مالك وعائشة.

‘হাদিসটি সহিহ। এক দল সাহাবি থেকে বিভিন্ন সূত্রে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে, যার একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে। সে সকল সাহাবিগণ হলেন, মুআজ বিন জাবাল রা., আবু সালাবা রা., আব্দুল্লাহ বিন উমর রা., আবু মুসা আশআরি রা., আবু হুরাইরা রা., আবু বকর সিদ্দিক রা., আওফ বিন মালিক রা., আয়িশা সিদ্দিকা রা.। (সিলসিলাতুস আহাদিসিস সহিহা : ৩/১৩৫, হা. নং ১১৪৪, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল মাআরিফ, রিয়াদ)

■ শায়খ আলবানী রহ. আরো বলেন :

وجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب والصحة تثبت بأقل منها عددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث، فما نقله الشيخ القاسمي رحمه الله تعالى في “إصلاح المساجد” (ص 107) عن أهل التعديل والتجريح أنه ليس في فضل ليلة النصف من شعبان حديث صحيح، فليس مما ينبغي الاعتماد عليه، ولئن كان أحد منهم أطلق مثل هذا القول فإنما أوتي من قبل التسرع وعدم وسع الجهد لتتبع الطرق على هذا النحو الذي بين يديك. والله تعالى هو الموفق.

‘সারকথা হলো, এত সব সনদের সমষ্টিতে হাদিসটি নিঃসন্দেহে সহিহ বলে বিবেচিত। মারাত্মক দুর্বলতা না থাকলে তো এর চেয়ে কম সনদেও হাদিস সহিহ সাব্যস্ত হয়ে যায়, যেমনটি এ হাদিসের ক্ষেত্রে ঘটেছে। সুতরাং শাইখ কাসিমি রহ. তাঁর “ইসলাহুল মাসাজিদ” গ্রন্থে (পৃ. ১০৭) প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসদের থেকে শবে বরাতের ফজিলতের ব্যাপারে কোনো সহিহ হাদিস না থাকার যে দাবি করেছেন তা সঠিক নয়। আর যদি কেউ এমন কথা বলেও থাকেন তাহলে তা তাড়াহুড়াবশত ও আমাদের এই পদ্ধতিতে পূর্ণভাবে সকল সূত্র তালাশ না করেই বলে থাকবেন হয়তো।’ (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহিহা : ৩/১৩৯, হা. নং ১১৪৪, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল মাআরিফ, রিয়াদ)

■ শায়খ শুআইব আরনাউত রহ. বলেন :

حديث صحيح بشواهده، وهذا إسناد ضعيف.

‘এর সনদ দুর্বল হলেও অন্যান্য সমার্থক হাদিসগুলোর কারণে হাদিসটি সহিহ বলে বিবেচিত।’ (আত-তালিক আলা মুসনাদি আহমাদ : ১১/২১৭, হা. নং ৬৬৪২, মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)

এ হাদিসটি আরও অনেক হাদিসগ্রন্থে সামান্য কয়েকটি শব্দের ভিন্নতায় বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে। আমরা এখানে কয়েকটি হাদিসগ্রন্থের উদ্ধৃতি দিচ্ছি

(১) মুসনাদু ইসহাক বিন রাহুইয়াহ : ৩/৯৮১, হা. নং ১৭০২

(২) সুনানু ইবনি মাজাহ : /৪৪৫, হা. নং ১৩৯০

(৩) আস-সুন্নাহ, ইবনু আবি আসিম : ১/২২৩, হা. নং ৫১০

(৪) মুসনাদুল বাজ্জার : ৭/১৮৬, হা. নং ২৭৫৪

(৫) মুসতাখরাজুত তুসি আলা জামিইত তিরমিজি : ৩/৩৮৭, হা. নং ৬১/৬৮৪

(৬) আল-মুজামুল আওসাত, তাবারানি : ৭/৩৬, হা. নং ৬৭৭৬

(৮) শুআবুল ইমান, বাইহাকি : ৯/২৪, হা. নং ৬২০৪

(৯) মুসান্নাফু ইবনি আবি শাইবা : ৬/১০৮, হা. নং ২৯৮৫৯

 

■ ২নং হাদিসঃ—

ﻋﻦ ﺍﺑﻲ ﺑﻜﺮ ﺍﻟﺼﺪﻳﻖ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻋﻦ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻗﺎﻝ : ﻳﻨﺰﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻲ } ﻟﻴﻠﺔ ﺍﻟﻨﺼﻒ ﻣﻦ ﺷﻌﺒﺎﻥ { ﺍﻟﻲ ﺍﻟﺴﻤﺎﺀ ﺍﻟﺪﻧﻴﺎ، ﻓﻴﻐﻔﺮ ﻟﻜﻞ ﻧﻔﺲ ﺇﻻ ﺍﻧﺴﺎﻥ ﻓﻲ ﻗﻠﺒﻪ ﺷﺤﻨﺎﺀ ﺃﻭ ﻣﺸﺮﻙ ﺑﺎﻟﻠﻪ ﻋﺰ ﻭﺟﻞ

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. থেকে বর্ণিত, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : শা’বানের মধ্য রাতে আল্লাহ তা’আলা প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং প্রতিটি (মুমিন) বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। তবে পরশ্রীকাতর এবং মুশরিককে ক্ষমা করেন না।

( সিলসিলাতুসসাহীহা, ৩/১৩৭, হাদীস নং ১১৪৪.

■ ৩নং হাদিস—

ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﺃَﺣْﻤَﺪُ ﺑﻦ ﺍﻟﻨَّﻀْﺮِ ﺍﻟْﻌَﺴْﻜَﺮِﻱُّ، ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﻫِﺸَﺎﻡُ ﺑﻦ ﺧَﺎﻟِﺪٍ، ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﻋُﺘْﺒَﺔُ ﺑﻦ ﺣَﻤَّﺎﺩٍ، ﻋَﻦِ ﺍﻷَﻭْﺯَﺍﻋِﻲِّ، ﻭَﺍﺑْﻦِ ﺛَﻮْﺑَﺎﻥَ، ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻴﻪِ، ﻋَﻦْ ﻣَﻜْﺤُﻮﻝٍ، ﻋَﻦْ ﻣَﺎﻟِﻚِ ﺑﻦ ﻳُﺨَﺎﻣِﺮَ، ﻋَﻦْ ﻣُﻌَﺎﺫِ ﺑﻦ ﺟَﺒَﻞٍ، ﻋَﻦ ِﺍﻟﻨَّﺒِﻲِّ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ، ﻗَﺎﻝَ “: ﻳَﻄَّﻠِﻊُ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﺰَّ ﻭَﺟَﻞَّ ﻋَﻠَﻰ ﺧَﻠْﻘِﻪِ ﻟَﻴْﻠَﺔَ ﺍﻟﻨِّﺼْﻒِ ﻣِﻦْ ﺷَﻌْﺒَﺎﻥَ ﻓَﻴَﻐْﻔِﺮُ ﻟِﺠَﻤِﻴﻊِ ﺧَﻠْﻘِﻪِ ﺇِﻻ ﻟِﻤُﺸْﺮِﻙٍ ﺃَﻭْ ﻣُﺸَﺎﺣِﻦٍ

হযরত মুআজ বিন জাবাল রা. রসূলুল্লাহ স. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: আল্লাহ তাআলা অর্ধ শা’বানের (লাইলাতুল বারাআত) রাতে আপন সব মাখলুকের দিকে বিশেষ দয়ার দৃষ্টিতে দেখেন। আর মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

তবারানী কাবীর: ১৬৬৩৯

■ আল্লামা হাইসামী বলেন: হাদীসটি তবারানী তাঁর কাবীর ও আওসাতের মধ্যে বর্ণনা করেছেন এবং এ হাদীসের রাবীগণ সবাই-ই ﺛﻘﺔٌ “নির্ভরযোগ্য”। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ: ১২৯৬০)

■ শায়খ আলবানী বলেন: ﺣﺪﻳﺚ ﺻﺤﻴﺢ ﺭﻭﻱ ﻋﻦ ﺟﻤﺎﻋﺔ ﻣﻦ ﺍﻟﺼﺤﺎﺑﺔ ﻣﻦ ﻃﺮﻕ ﻣﺨﺘﻠﻔﺔ ﻳﺸﺪ ﺑﻌﻀﻬﺎ ﺑﻌﻀﺎ “এ হাদীসটি সহীহ। এ হাদীসটি একদল সাহাবায়ে কিরাম থেকে এমন বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে, যার একটি অপরটিকে শক্তিশালী করে”।

[ সিলসিলাতু আহাদীসিস সহীহা: ১১৪৪ ]

 

■ ৪ নং হাদিস

‎ حَدَّثَنَا  أَحْمَدُ  بْنُ  مَنِيعٍ،  حَدَّثَنَا  يَزِيدُ  بْنُ  هَارُونَ،  أَخْبَرَنَا  الْحَجَّاجُ  بْنُ  أَرْطَاةَ،  عَنْ  يَحْيَى  بْنِ  أَبِي  كَثِيرٍ،  عَنْ  عُرْوَةَ،  عَنْ  عَائِشَةَ،  قَالَتْ  فَقَدْتُ  رَسُولَ  اللَّهِ  صلى  الله  عليه  وسلم  لَيْلَةً   فَخَرَجْتُ  فَإِذَا  هُوَ  بِالْبَقِيعِ  فَقَالَ  ‏"‏  أَكُنْتِ  تَخَافِينَ  أَنْ  يَحِيفَ  اللَّهُ  عَلَيْكِ  وَرَسُولُهُ  ‏"‏  ‏.‏  قُلْتُ  يَا  رَسُولَ  اللَّهِ  إِنِّي  ظَنَنْتُ  أَنَّكَ  أَتَيْتَ  بَعْضَ  نِسَائِكَ  ‏.‏  فَقَالَ  ‏"‏  إِنَّ  اللَّهَ  عَزَّ  وَجَلَّ  يَنْزِلُ  لَيْلَةَ   النِّصْفِ   مِنْ   شَعْبَانَ   إِلَى  السَّمَاءِ  الدُّنْيَا  فَيَغْفِرُ  لأَكْثَرَ  مِنْ   عَدَدِ  شَعْرِ  غَنَمِ  كَلْبٍ  ‏"‏  ‏.‏

আইশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে হারিয়ে ফেললাম (বিছানায় পেলাম না)। আমি (তাঁর সন্ধানে) বের হলাম। এসে দেখলাম তিনি বাকী কবরস্তানে আছেন। তিনি বলেনঃ তুমি কি ভয় করছ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি কোন অবিচার করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি অনুমান করলাম আপনি আপনার অন্য কোন বিবির নিকটে গিয়েছেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা মধ্য শা'বানে (১৫ তারিখের রাতে) দুনিয়ার কাছের আকাশে অবতীর্ণ হন। তারপর কালব গোত্রের বকরী পালের লোমের চেয়েও বেশী সংখ্যক লোককে তিনি মাফ করে দেন।

জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং ৭৩৯

ইবনু মাজাহ, হাদিস নং ১৩৮৯

মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ২৬০১৮

উল্লেখিত হাদিসগুলো ছড়াও অনেকগুলো হাদিস রয়েছে যার দ্বারা শবেবরাতের প্রমাণ্যতা পাওয়া যায়।

 

শবেবরাত সম্পর্কে সালাফদের অভিমত:

■ ইবনে উমর রা. বলেন :

خَمْسُ لَيَالٍ لَا تُرَدُّ فِيهِنَّ الدُّعَاءَ: لَيْلَةُ الْجُمُعَةِ، وَأَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ رَجَبٍ، وَلَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، وَلَيْلَتَيِ الْعِيدَيْنِ

‘পাঁচ রাতের দুআ প্রত্যাখ্যাত হয় না। এক. জুমআর রাতে। দুই. রজবের প্রথম রাতে। তিন. মধ্য শাবানের রাতে। চার. ইদুল ফিতরের রাতে। পাঁচ. ইদুল আজহার রাতে।’ (মুসান্নাফু আব্দির রাজ্জাক : ৪/৩১৭, হা. নং ৭৯২৭, প্রকাশনী : আল-মাজলিসুল ইলমি, ভারত)

■ ইমাম শাফিয়ি রহ. বলেন :

وَبَلَغَنَا أَنَّهُ كَانَ يُقَالُ: إنَّ الدُّعَاءَ يُسْتَجَابُ فِي خَمْسِ لَيَالٍ فِي لَيْلَةِ الْجُمُعَةِ، وَلَيْلَةِ الْأَضْحَى، وَلَيْلَةِ الْفِطْرِ، وَأَوَّلِ لَيْلَةٍ مِنْ رَجَبٍ، وَلَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ… (قَالَ الشَّافِعِيُّ) : وَأَنَا أَسْتَحِبُّ كُلَّ مَا حُكِيَتْ فِي هَذِهِ اللَّيَالِيِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَكُونَ فَرْضًا.

‘আমাদের কাছে এ বর্ণনা পৌঁছেছে যে, বলা হয়, পাঁচ রাতে দুআ কবুল হয়। এক. জুমআর রাতে। দুই. ইদুল আজহার রাতে। তিন. ইদুল ফিতরের রাতে। চার. রজবের প্রথম রাতে। পাঁচ. মধ্য শাবানের রাতে। …(ইমাম শাফিয়ি রহ. বলেন,) আর আমি এসব রাতের ব্যাপারে যা বর্ণনা করলাম, তা করা (অর্থাৎ দুআ করা) পছন্দ করি। তবে এটা আবশ্যক কিছু নয়।’ (আল-উম্মু : ১/২৬৪, প্রকাশনী : দারুল মারিফা, বৈরুত)

 

■ ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন :

ليلة النصف من شعبان، فقد روى في فضلها من الأحاديث المرفوعة والآثار ما يقتضي أنها ليلة مفضلة وأن من السلف من كان يخصها بالصلاة فيها.

‘শবে বরাতের ফজিলতের ব্যাপারে অনেক মারফু হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, এটা ফজিলতপূর্ণ একটি রাত। সালাফের অনেকে বিশেষভাবে এ রাতে (নফল) নামাজ পড়তেন।’ (ইকতিজাউস সিরাতিল মুসতাকিম : ২/১৩৬-১৩৭, প্রকাশনী : দারু আলামিল কুতুব, বৈরুত)

■ হাফিয ইবনে হাজার হাইসামি রহ. বলেন :

وَالْحَاصِلُ أَنَّ لِهَذِهِ اللَّيْلَةِ فَضْلًا وَأَنَّهُ يَقَعُ فِيهَا مَغْفِرَةٌ مَخْصُوصَةٌ وَاسْتِجَابَةٌ مَخْصُوصَةٌ وَمِنْ ثَمَّ قَالَ الشَّافِعِيُّ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ – إنَّ الدُّعَاءَ يُسْتَجَابُ فِيهَا.

‘সারকথা হলো, শবে বরাতের ফজিলত সুসাব্যস্ত একটি বিষয়। এ রাতে বিশেষভাবে ক্ষমা করা হয় এবং বিশেষভাবে দুআ কবুল করা হয়। এ ভিত্তিতেই ইমাম শাফিয়ি রহ. বলেছেন, এ রাতে দুআ করা মুসতাহাব।’ (আল-ফাতাওয়াল ফিকহিয়্যাতুল কুবরা : ২/৮০, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যা)

■ আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরি রহ. বলেন :

اعْلَمْ أَنَّهُ قَدْ وَرَدَ فِي فَضِيلَةِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ عِدَّةُ أَحَادِيثَ مَجْمُوعُهَا يَدُلُّ عَلَى أَنَّ لَهَا أَصْلًا.

‘জেনে রেখো যে, শবে বরাতের ফজিলতের ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে, সমষ্টিগতভাবে যা প্রমাণ করে যে, এর ভিত্তি আছে।’ (তুহফাতুল আহওয়াজি : ৩/৩৬৫, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

তিনি আরও বলেন :

فَهَذِهِ الْأَحَادِيثُ بِمَجْمُوعِهَا حُجَّةٌ عَلَى مَنْ زَعَمَ أَنَّهُ لَمْ يَثْبُتْ فِي فَضِيلَةِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ شَيْءٌ.

‘সামগ্রিকভাবে এ হাদিসগুলো ওই সব লোকদের বিপরীতে দলিল হবে, যারা ধারণা করে যে, শবে বরাতের ফজিলতের ব্যাপারে কোনো কিছু প্রমাণিত নয়।’ (তুহফাতুল আহওয়াজি : ৩/৩৬৭, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

এ রাতে অতিরিক্ত কিছু নফল ইবাদত ও দুআ করার ব্যাপারে আরও অনেক সালাফ ও ইমামের মত পাওয়া যায়। এখানে তাদের কয়েকজনের মতামত উল্লেখ করছি।

■ ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন :

وَأَمَّا لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَفِيهَا فَضْلٌ، وَكَانَ فِي السَّلَفِ مَنْ يُصَلِّي فِيهَا، لَكِنَّ الِاجْتِمَاعَ فِيهَا لِإِحْيَائِهَا فِي الْمَسَاجِدِ بِدْعَةٌ وَكَذَلِكَ الصَّلَاةُ الْأَلْفِيَّةُ.

‘শবে বরাতের ব্যাপারে কথা হলো, এ রাতের ফজিলত আছে। সালাফের মধ্যে অনেকেই এ রাতে (নফল) নামাজ পড়তেন। কিন্তু রাত্রি জাগরনের উদ্দেশ্যে এ রাতে মসজিদে একত্রিত হওয়া বিদআত। এভাবে আলফিয়া বা হাজার রাকআত নামের বিশেষ নামাজও বিদআত।’ (আল-ফাতাওয়াল কুবরা : ৫/৩৪৪, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

■ ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. আরও বলেন :

ليلة النصف من شعبان، فقد روى في فضلها من الأحاديث المرفوعة والآثار ما يقتضي أنها ليلة مفضلة وأن من السلف من كان يخصها بالصلاة فيها، وصوم شهر شعبان قد جاءت فيه أحاديث صحيحة. ومن العلماء: من السلف من أهل المدينة، وغيرهم من الخلف، من أنكر فضلها، وطعن في الأحاديث الواردة فيها، كحديث: «إن الله يغفر فيها لأكثر من عدد شعر غنم كلب». وقال: لا فرق بينها وبين غيرها. لكن الذي عليه كثير من أهل العلم، أو أكثرهم، من أصحابنا وغيرهم -على تفضيلها، وعليه يدل نص أحمد، لتعدد الأحاديث الواردة فيها، وما يصدق ذلك من الآثار السلفية، وقد روي بعض فضائلها في المسانيد والسنن. وإن كان قد وضع فيها أشياء أخر.

‘শবে বরাতের ফজিলতের ব্যাপারে অনেক মারফু হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, এটা ফজিলতপূর্ণ একটি রাত। সালাফের অনেকে বিশেষভাবে এ রাতে (নফল) নামাজ পড়তেন। আর শাবান মাসে রোজা রাখার ব্যাপারে অনেক সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সালাফের মধ্য হতে মদিনার উলামায়ে কিরাম ও পরবর্তী কিছু উলামায়ে কিরাম এ রাতের ফজিলত অস্বীকার করেছেন এবং এসংক্রান্ত বর্ণিত হাদিসগুলোর ব্যাপারে বিতর্ক করেছেন। যেমন এ হাদিস যে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা এ রাতে কালব গোত্রের ছাগলের পালের চেয়েও অধিকসংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন।’ তাঁরা বলেন, এ রাত ও অন্যান্য রাতের মাঝে তেমন পার্থক্য নেই। কিন্তু আমাদের ও অন্যান্য মাজহাবের অনেক বা অধিকাংশ উলামায়ে কিরামের মত হলো, এ রাতের আলাদা ফজিলত আছে। ইমাম আহমাদ রহ.-এর ভাষ্য এমনটাই বুঝায়। কেননা, এ রাতের ফজিলতের হাদিসগুলো একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়াও (এ ব্যাপারে) সালাফের আসার ও আমলও তা সত্যায়ন করে। এ রাতে কিছু ফজিলত মুসনাদ ও সুনানের কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে; যদিও এ ব্যাপারে বেশ কিছু মওজু হাদিসও আছে।’ (ইকতিজাউস সিরাতিল মুসতাকিম : ২/১৩৬-১৩৭, প্রকাশনী : দারু আলামিল কুতুব, বৈরুত)

■ ইমাম নববি রহ. বলেন :

وَاسْتَحَبَّ الشَّافِعِيُّ وَالْأَصْحَابُ الْإِحْيَاءَ الْمَذْكُورَ مَعَ أَنَّ الْحَدِيثَ ضَعِيفٌ لِمَا سَبَقَ فِي أَوَّلِ الْكِتَابِ أَنَّ أَحَادِيثَ الْفَضَائِلِ يُتَسَامَحُ فِيهَا وَيُعْمَلُ عَلَى وَفْقِ ضَعِيفِهَا

‘ইমাম শাফিয়ি রহ. ও তার অনুসারীগণ উল্লিখিত (দুই ইদের রাত, জুমআর রাত, রজবের প্রথম রাত ও মধ্য শাবানের রাত ইত্যাদি) রাত্রি জাগরণকে মুসতাহাব বলেছেন; অথচ এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসটি দুর্বল। কারণ হলো, কিতাবের শুরুতে পূর্বেই গত হয়েছে যে, ফজিলত-সংক্রান্ত হাদিসসমূহের ক্ষেত্রে একটু শিথিলতা করা হয়ে থাকে এবং দুর্বল হাদিস অনুসারে আমল করার অবকাশ থাকে।’ (আল-মাজমু শারহুল মুহাজ্জাব : ৫/৪৩, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)

■ হাফিজ ইবনে হাজার হাইসামি রহ. বলেন :

وَالْحَاصِلُ أَنَّ لِهَذِهِ اللَّيْلَةِ فَضْلًا وَأَنَّهُ يَقَعُ فِيهَا مَغْفِرَةٌ مَخْصُوصَةٌ وَاسْتِجَابَةٌ مَخْصُوصَةٌ وَمِنْ ثَمَّ قَالَ الشَّافِعِيُّ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ – إنَّ الدُّعَاءَ يُسْتَجَابُ فِيهَا.

‘সারকথা হলো, শবে বরাতের ফজিলত সুসাব্যস্ত একটি বিষয়। এ রাতে বিশেষভাবে ক্ষমা করা হয় এবং বিশেষভাবে দুআ কবুল করা হয়। এ ভিত্তিতেই ইমাম শাফিয়ি রহ. বলেছেন, এ রাতে দুআ করা মুসতাহাব।’ (আল-ফাতাওয়াল ফিকহিয়্যাতুল কুবরা : ২/৮০, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুল ইসলামিয়্যা)

■ আল্লামা ইবনে নুজাইম মিসরি রহ. মুনইয়াতুল মুসল্লি গ্রন্থের উদ্ধৃতিতে বলেন :

وَمِنْ الْمَنْدُوبَاتِ إحْيَاءُ لَيَالِي الْعَشْرِ مِنْ رَمَضَانَ وَلَيْلَتَيْ الْعِيدَيْنِ وَلَيَالِي عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ وَلَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ كَمَا وَرَدَتْ بِهِ الْأَحَادِيثُ.

‘রমজানের (শেষ) দশ রাত, দুই ইদের রাত, জিলহজের (প্রথম) দশ রাত ও মধ্য শাবানের রাত্রি জাগরণ মুসতাহাব ও উত্তম; যেমনটি হাদিসসমূহে এসেছে।’ (আল-বাহরুর রায়িক : ২/৫৬, প্রকাশনী : দারুল কিতাবিল ইসলামি, বৈরুত)

■ আল্লামা শারামবুলালি রহ. বলেন :

ومعنى القيام أن يكون مشتغلا معظم الليل بطاعة وقيل بساعة منه يقرأ أو يسمع القرآن أو الحديث أو يسبح أو يصلي على النبي صلى الله عليه وسلم

‘রাত্রি জাগরণের তাৎপর্য হলো, রাতের অধিকাংশ সময় ইবাদত বন্দেগিতে কাটিয়ে দেবে। কারও মতে এতে কিছু সময় কুরআন-হাদিস পড়বে ও শুনবে বা তাসবিহ পাঠ করবে বা দরুদ পাঠ করেবে।’ (মারাকিল ফালাহ শারহু নুরিল ইজাহ : পৃ. ১৫১, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুল আসরিয়্যা, বৈরুত)

■ ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন :

وَأَمَّا لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَفِيهَا فَضْلٌ، وَكَانَ فِي السَّلَفِ مَنْ يُصَلِّي فِيهَا، لَكِنَّ الِاجْتِمَاعَ فِيهَا لِإِحْيَائِهَا فِي الْمَسَاجِدِ بِدْعَةٌ

‘অবশ্য শবে বরাতের ব্যাপারে ফজিলতের কথা পাওয়া যায়। সালাফে সালেহিনের কেউ কেউ এ রাতে নামাজ পড়তেন। কিন্তু এ রাতকে জাগ্রত রাখার জন্য মসজিদে একত্রিত হওয়া বিদআত।’ (আল-ফাতাওয়াল কুবরা : ৫/৩৪৪, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

এসব হাদিস, আসার ও ফুকাহায়ে কিরামের উক্তি থেকে আমরা জানতে পারলাম, শবে বরাতে আমাদের জন্য নিম্নোক্ত আমলগুলো করা উচিত :

১. ইশার নামাজ জামাআতের সহিত আদায় করা।

২. সাধ্যমতো একাকি নফল নামাজ পড়া।

৩. গভীর মনোযোগ সহকারে কুরআন তিলাওয়াত করা।

৪. দুআ ও রোনাজারির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা।

৫. সম্ভব হলে একাকি কবর জিয়ারত করা।

৬. ফজরের নামাজ জামাআতের সহিত আদায় করা।

সুতরাং এতগুলো হাদিস ও সালাফদের অভিমত দ্বারা বুঝা গেল যে,  শবে বরাত সুসাব্যস্ত একটি বিষয়। এমনকি আহলে হাদিসগণ যাকে মান্যবর বলে মনে করেন, সেই শাইখ আলবানি রহ.-ও এর স্বীকৃতি দিয়েছেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি ছাড়া রাতে মুস্তাকিমের উপর চলার তৌফিক দান করুন। আমিন

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হোসেনিয়া বরিশাল

কেএল/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ