মুহাম্মাদ শোয়াইব
জম্মু ও কাশ্মীরের অধিকাংশ মুসলিম পরিবার দীর্ঘদিন ধরে তাদের নিজস্ব ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও কৃষিজমি নিয়ে বসবাস করছে। তবে ২০১৯ সালে কাশ্মীরের অবৈধ সংযুক্তির পর থেকে একের পর এক মুসলিমদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ঘটনা বেড়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ভারতীয় বাহিনী ও প্রশাসনিক সংস্থাগুলো বিভিন্ন আইনি অজুহাত ব্যবহার করে এই সম্পত্তি দখল করছে।
সাধারণত ব্যবহৃত অজুহাতগুলো হলো, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বা জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ। মাদকদ্রব্য ও মনঃপ্রভাবিতকারী পদার্থ (NDPS) আইনের ব্যবহার করে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। Unlawful Activities (Prevention) Act (UAPA)-এর আওতায় অভিযান।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, এই আইনগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং অনেক সময় বিনা প্রমাণে সম্পত্তি দখল করা হচ্ছে। এর ফলে কাশ্মীরি মুসলিমরা তাদের প্রাচীন সম্পদ হারাচ্ছে। ঘরবাড়ি, দোকান ও জমি দখলের মাধ্যমে তাদের জীবিকা ও সামাজিক নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ছে।
জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের সম্পত্তি দখলের ভারতের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টার আরেকটি উদাহরণ হিসেবে, অধিকৃত কাশ্মীরের আনন্তনাগ জেলার বিজবেহারা এলাকায় এক পিতা-পুত্রের মালিকানাধীন ৬৬ লাখ রুপিরও বেশি মূল্যের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে একটি দুইতলা আবাসিক ভবন এবং তুলখন গ্রামের একটি একতলা বাণিজ্যিক ভবন, যা মাদকদ্রব্য ও মনঃপ্রভাবিতকারী পদার্থ (NDPS) আইন অনুযায়ী দখল করা হয়েছে।
তবে স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এই ধরনের অভিযান এখন কাশ্মীরে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তারা অভিযোগ করেছেন যে, বিনা প্রমাণে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গি অর্থায়ন বা মাদক পাচারের অভিযোগে ঘরবাড়ি, দোকান ও জমি দখল করা হচ্ছে। এসবের পেছনে কোনো স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়া নেই।
স্থানীয়দের মতে, ভারত এইসব অভিযানের মাধ্যমে কাশ্মীরিদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে তা অ-স্থানীয়দের হাতে তুলে দিচ্ছে। যা তাদের জনসংখ্যাগত কাঠামো পরিবর্তনের বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই বাজেয়াপ্ত অভিযানকে সমষ্টিগত শাস্তি হিসেবে অভিহিত করে বলেছে, এটি জনগণের মধ্যে ভয় সৃষ্টি ও ভিন্নমত দমন করার কৌশল।
যদিও ভারতীয় পুলিশ দাবি করেছে যে সাম্প্রতিক বাজেয়াপ্তি মাদক পাচারের সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয়দের মতে NDPS ও UAPA আইনের ঘনঘন ব্যবহারই এই অভিযানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রকাশ করে।
বিশ্লেষকরা আরও বলেছেন, ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বেআইনি দখলের পর থেকে ওই অঞ্চলে মাদক পাচার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অনেক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জড়িত থাকা ও সামরিক নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মাদক প্রবাহের অনুমোদন রয়েছে — যা এখন কাশ্মীরি সাধারণ নাগরিকদের ওপর দমননীতি চালানোর অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গত এক মাসে জম্মু ও কাশ্মীরে মুসলিমদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এইসব অভিযান সাধারণত Unlawful Activities (Prevention) Act (UAPA) বা Narcotic Drugs and Psychotropic Substances (NDPS) Act-এর আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব আইনের অপব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমরা গত এক মাসে ভারতীয়দের যেসব সম্পত্তি দখল করা হয়েছ তা একটি লিস্ট প্রদান করছি।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ভারতের কুখ্যাত ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (NIA) জম্মু ও কাশ্মীরে (ভারত অধিকৃত) শোপিয়ান জেলার এক কাশ্মীরি বাসিন্দার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে।
অজুহাত পেশা করা হয়েছে যে, UAPA-র আওতায় তদন্তের অংশ হিসেবে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তবে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন যে, কোনো স্বচ্ছ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই সম্পত্তি দখল করা হয়েছে।
৮ অক্টোবর ২০২৫স্টেট ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (SIA) দক্ষিণ ও উত্তর কাশ্মীরে এক UAPA মামলা-এর সংক্রান্ত রেইড পরিচালনা করেছে।
GNS-এর বরাতে জানা গেছে, SIA-এর গোয়েন্দারা পুলিশ ও CRPF-এর সহায়তায় আনন্তনাগ, শোপিয়ান, কুলগাম, সোপুর ও বান্দিপোরা জেলায় একসঙ্গে অভিযান চালিয়েছে। এই রেইডটি FIR নং ১/২০২৫ UAPA-এর সংক্রান্ত মামলার অংশ হিসেবে চলছে।
অজুহাত পেশা করা হয়েছে যে, NDPS আইনের আওতায় মাদক পাচারের অভিযোগে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, স্থানীয়রা দাবি করেছেন যে, মাদক পাচারের অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
১০ অক্টোবর ২০২৫ বিজেপি রামবান অঞ্চলে এক কর্মীর সম্পত্তি দখল করল কঠোর UAPA আইনের আওতায়।
আর্থিক নিপীড়নের আরও একটি ঘটনায়, ভারতীয় পুলিশ অবৈধভাবে দখলকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি সংযুক্ত করেছে।
কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিস-এর সূত্রে জানা যায়, বিজেপি শাসিত পুলিশ বাহিনী ফারুক আহমদ নামের এক কর্মীর ৪.১১ কানাল কৃষি জমি ডুমকি-সুম্বার এলাকায় রামবান জেলার অধীনে দখল করেছে।
পুলিশ দাবি করেছে যে এই পদক্ষেপটি করা হয়েছে অবৈধ কার্যক্রম (প্রতিরোধ) আইন – UAPA এর অধীনে।
বিশ্লেষকরা বলেন, এই ধরনের সম্পত্তি সংযুক্তি ভারতীয় বিজেপি সরকারের দখলকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের ওপর দীর্ঘমেয়াদী সন্ত্রাস ও ভয় সৃষ্টি করার প্রচেষ্টার অংশ। যা তাদের ঘর-বাড়ি, জমি এবং জীবিকাকে বঞ্চিত করে।
বিজেপি সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে সম্পত্তি জব্দকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, স্থানীয়দের স্বাধীনতা কর্মী, মাদক চোর বা ভারত-বিরোধী কর্মী হিসেবে চিহ্নিত করে, যাতে তাদের সম্পদ জব্দের আইনগত জালিয়াতি স্বীকৃতি পাওয়া যায়।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার উল্লেখ করেছে, এই অবৈধ পদক্ষেপগুলোর লক্ষ্য কাশ্মীরিদের অর্থনৈতিক দুর্বলতা সৃষ্টি করা এবং দখলকৃত সম্পত্তিগুলোতে অ-স্থানীয়দের প্রবেশের মাধ্যমে অঞ্চলের জনসংখ্যার কাঠামো পরিবর্তন করা।
জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ ৪ অক্টোবর ২০২৫ শ্রীনগরের HMT এলাকার প্রান্তে দ্য রেসিস্ট্যান্স ফ্রন্ট কমান্ডার সাজাদ গুলের পরিবারের নামে রেকর্ডকৃত ১৫ মারলার জমির উপর নির্মিত তিনতলা একটি আবাসিক বাড়ি দখল করেছে।
পুলিশের দাবি, সম্পত্তিটির মূল্য প্রায় দুই কোটি রুপি, যা সাজাদ গুলের বাবা গুলাম মোহাম্মদ শেখ-এর নামে রেকর্ড করা আছে। এটি সেন্ট্রাল শালটেং-এর তহসিলদারের যাচাই অনুযায়ী নিশ্চিত হয়েছে।
পুলিশের বিবৃতিতে বলা হয়েছে: "সংযুক্তিটি FIR নং 235/2022 এর প্রেক্ষিতে, UAPA-এর 13, 38, 20 ধারাসহ EIMCO আইন 2/3-এর অধীনে এবং পুলিশ স্টেশন পারিমপোরা-তে নিবন্ধিত হয়েছে। অবৈধ কার্যক্রম (প্রতিরোধ) আইন (UAPA)-এর ধারা 25 অনুসারে সম্পত্তি দখল করার অনুমোদন দেওয়া হয়। যা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত বা ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত সম্পত্তির জন্য প্রযোজ্য। এই পদক্ষেপটি সংশ্লিষ্ট কার্যনির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয়েছে।"
জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ ২৪ জুন ২০২৫ উদহাম্পুর জেলায় এক আসামির সম্পত্তি সংযুক্ত করেছে। আসামি মোহাম্মদ শফিক বর্তমানে বসন্তগড় পুলিশ স্টেশনে UAPA-এর বিভিন্ন ধারার অধীনে নিবন্ধিত মামলায় ন্যায়িক হেফাজতে রয়েছে।
পুলিশ মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, শফিকের মালিকানাধীন জমি UAPA-এর ধারা 25 অনুযায়ী সংযুক্ত করা হয়েছে। সংযুক্ত সম্পত্তি—যার মূল্য লাখ লাখ রুপি—এখন থেকে বিক্রয়, লিজ, হস্তান্তর বা তৃতীয় পক্ষের যে কোনও লেনদেনে ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনত বাধ্যতামূলকভাবে সীমাবদ্ধ।
এগুলো কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। বাস্তবতা আরো ভয়ংকর ও গভীর। কাশ্মীরের মুসলমানরা বিনা বিচারে এভাবে তাদের সহায়-সম্বল হারাচ্ছে। আর যা করা হচ্ছে সবই আইনের দোহাই দিয়ে করা হচ্ছে।
এনএইচ/