আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে ফের শুরু হয়েছে ভয়াবহ সংঘাত। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি শেষ হতেই পাকিস্তানের বিমান বাহিনী আফগানিস্তানের কান্দাহার প্রদেশের স্পিন বোলদাক শহরে বোমা বর্ষণ করেছে। এই হামলায় অন্তত ৪০ জন নিহত হয়েছেন এবং আরও অন্তত ১৭৯ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই নারী, শিশু ও সাধারণ বেসামরিক মানুষ। সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা এই হামলাকে ‘অমানবিক ও বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এই হামলাটি ঘটে শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুরের পরপরই। এর আগে ১৫ অক্টোবর থেকে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ৪৮ ঘণ্টার অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল, যা শেষ হয় ওই দিন দুপুর ১টার দিকে। যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানি বিমান বাহিনী স্পিন বোলদাকে ভয়াবহ বিমান হামলা চালায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে বাড়তে থাকা সংঘাতের মূলে রয়েছে পাকিস্তানের তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) নামের জঙ্গি গোষ্ঠী। পাকিস্তানের দাবি—আফগান তালেবান সরকার টিটিপিকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিচ্ছে, যদিও কাবুল সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
আফগান সংবাদমাধ্যম তোলো নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্পিন বোলদাকের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা করিমুল্লাহ জুবাইর আগা জানিয়েছেন, নিহত ও আহতদের সবাই বেসামরিক মানুষ। বেশিরভাগ নিহত নারী ও শিশু। হামলার পর হাসপাতালগুলোতে হাহাকার পড়ে যায়; অনেক আহতকে রক্তক্ষরণ থামানোর আগেই চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়নি। হাজি বাহরাম নামে এক আহত ব্যক্তি বলেন, “আমি আমার জীবনে কখনও এমন অবিচার দেখিনি। যারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করে, তারা আজ আমাদের শিশু ও নারীদের ওপর বোমা ফেলছে।”
বিমান হামলার পাশাপাশি পাকিস্তানি স্থলবাহিনীও সীমান্ত শহরজুড়ে একের পর এক আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপ করেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, নোকলি, হাজি হাসান কেলাই, ওয়ার্দাক, কুচিয়ান, শহীদ ও শোরবাক এলাকার ঘরবাড়ি ও দোকানপাট মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। অনেক পরিবার ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়েছে, অনেকে এখনও নিখোঁজ। উদ্ধারকাজে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ও চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। আফগান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সীমান্তবর্তী এলাকার পরিস্থিতি এখনো “অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ”।
পাকিস্তানের অভিযোগ, আফগানিস্তান টিটিপিকে নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে এবং তাদের সীমান্ত অতিক্রম করে হামলা চালাতে উৎসাহিত করছে। টিটিপি হলো এক সময় পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হওয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে বিবেচিত। ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই গোষ্ঠীটি আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে আফগান সরকার বলছে, পাকিস্তান নিজেই সীমান্ত উত্তেজনা বাড়াচ্ছে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য।
এটি প্রথম সংঘাত নয়। এর আগেও ১১ থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত দুই দেশের সীমান্তে ভয়াবহ হামলা-পাল্টা হামলা চলে। তখনও বহু মানুষ হতাহত হন। সেই সংঘাতের পর ১৫ অক্টোবর অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়, কিন্তু ১৭ অক্টোবরের মধ্যেই তা ভঙ্গ হয়ে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হলো। উল্লেখযোগ্যভাবে, একই সময়ে পাকিস্তানের মির আলী সেনা ক্যাম্পেও হামলা হয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
৯ অক্টোবর পাকিস্তানের বিমান বাহিনী আফগান রাজধানী কাবুলে হামলা চালিয়ে টিটিপির শীর্ষ নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদকে হত্যা করে। এর পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে ওঠে। পাকিস্তানের দাবি, এই হত্যাকাণ্ড টিটিপির কার্যক্রম দমন করার অংশ, কিন্তু আফগান তালেবান সরকার এটিকে “আন্তর্জাতিক সীমা লঙ্ঘন” বলে অভিহিত করে। এরপর থেকেই সীমান্তে একের পর এক সংঘর্ষ, বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ শুরু হয়।
এই ধারাবাহিক সংঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সীমান্তবর্তী এলাকার হাজারো পরিবার বাড়িঘর হারিয়েছে, অনেকেই আশ্রয় নিচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলে। খাদ্য, পানি ও চিকিৎসার তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। শিশু ও বৃদ্ধদের অবস্থাও নাজুক। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সীমিত ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো হলেও তা যথেষ্ট নয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে এবং বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তথ্যসূত্র : তোলো নিউজ
এনএইচ/