বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫ ।। ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ ।। ২ জিলহজ ১৪৪৬


হজরত গাঙ্গুহী রহ.: উপমহাদেশের আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের বাতিঘর


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: সংগৃহীত

তাওহীদ আদনান ইয়াকুব

উনবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষ ছিল রাজনৈতিক দাসত্ব, সাংস্কৃতিক ধ্বংস আর ধর্মীয় জড়তার এক বিবর্ণ যুগ। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের ভারে চূর্ণ, মুসলিম সমাজ তখন দিকহারা, বিভ্রান্ত ও বর্ণহীন। এমন সময় কিছু আলোকিত আত্মা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে দাওয়াত ও দীনের পুনর্জাগরণে উঠে দাঁড়ান। তাঁদের মধ্যে হজরত মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ. ছিলেন অন্যতম। তিনি কেবল একজন বুযুর্গ, মুফতী বা সুফিই ছিলেন না; বরং একটি চিন্তা, একটি আন্দোলন এবং একটি ঐতিহাসিক ধারার প্রাণপুরুষ। তাঁর জীবন একদিকে যেমন ছিল ইবাদত, ইখলাস ও ইলমে দীনের পাথেয় সংগ্রহের দীপ্ত অভিযান, তেমনি ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে আল্লাহর দ্বীনের প্রতিনিধিত্ব করার এক বলিষ্ঠ প্রয়াস। 

জন্ম ও শৈশবকাল
হজরত গাঙ্গুহী রহ. জন্মগ্রহণ করেন ১২৪৪ হিজরি/১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে, ভারতের উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলার গাঙ্গুহ নামক এলাকায়। তাঁর বংশ ছিল উচ্চ বংশোদ্ভূত ও সম্মানিত। পিতা হাফেয আবদুল আহাদ সাহেব এবং মাতা সাহেবা ছিলেন দ্বীনদার ও সৎ নারী। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সৌম্য, নিরহংকারী ও নম্রস্বভাবের অধিকারী। তাঁর শৈশবের ধারাবাহিকতা থেকেই পরবর্তীতে গড়ে ওঠে একটি স্বচ্ছ ও আত্মসচেতন চরিত্রের ভিত্তি।

শিক্ষাজীবন ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ
তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা গাঙ্গুহেই অর্জন করেন। এরপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য দিল্লিতে গমন করেন। দিল্লি তখন ইসলামী জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি উস্তাযুল কুল মাওলানা মমলূকুল আলী নানুতুভী রহ.-এর কাছে বিভিন্ন ইসলামি শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। সহীহ বুখারী তিনি পড়েন উপমহাদেশের অন্যতম মশহুর মুহাদ্দিস শায়খ আবদুল গনী মুজাদ্দিদী রহ. এর নিকট। ১২৬৭ হিজরীতে তিনি দারসে নিজামি পূর্ণ করেন। তাঁর পাঠ ও পর্যবেক্ষণ ছিল গভীর, প্রজ্ঞাপূর্ণ এবং মূলনীতিনির্ভর। কেবল মুখস্থ নয়, বরং চিন্তার গভীরতা, পাঠের ধৈর্য ও মননে তাঁর সুস্পষ্ট পারদর্শিতা প্রতিফলিত হতো।

তাসাওউফ ও আত্মশুদ্ধির যাত্রা
ইলমের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধির পথও তিনি সমান গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেন। হজরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কী রহ. এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন এবং তাঁর হাতেই খেলাফত লাভ করেন। তাসাওউফ তাঁর কাছে ছিল বাস্তবিক আত্মশুদ্ধি, ইখলাস, তাকওয়া ও খেদমতে খালকের সমন্বয়। কোনো রূপ অতিরঞ্জিত ভাবাবেগ কিংবা শরীয়তবিরোধী গোঁড়ামি তিনি বরদাশত করতেন না।

তাঁর তাসাওউফি দর্শন ছিল আলোকিত, পরিশুদ্ধ এবং সুন্নাতভিত্তিক। তিনি আত্মার রোগসমূহ যেমন—রিয়া, অহংকার, হসদ, গিবত প্রভৃতি থেকে মুক্তির উপর গুরুত্বারোপ করতেন। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সমাজ গঠন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির মূল ছিল। তাঁর মজলিস ছিল আধ্যাত্মিক প্রশান্তি ও চিন্তাশীল আলোচনার এক অনন্য ভুবন।

রাজনৈতিক অবদান ও ১৮৫৭ সালের বিপ্লবে অংশগ্রহণ
হজরত গাঙ্গুহী রহ. কেবল মসজিদ-খানকাহে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি প্রতিরোধ ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। তিনি তাঁর শাইখ হাজী ইমদাদুল্লাহ রহ.-এর সঙ্গে থানাভবনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যদিও এই যুদ্ধ ব্যর্থ হয়, কিন্তু এটি মুসলমানদের মধ্যে এক স্বাধীনচেতা আত্মার উন্মেষ ঘটায়। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তিনি রেখে যান সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবার এক অবিনাশী চেতনা।

১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি খানকাহে কুদুসিয়া থেকে সাহসিকতার সাথে বেরিয়ে এসে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সারিবদ্ধ হয়ে যান এবং তাঁর মুর্শিদ হজরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কী (রহ.) এবং অন্যান্য সাথিদের সঙ্গে শামলীর জিহাদের ময়দানে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের চূড়ান্ত নিদর্শন রাখেন। যখন হাফেজ যামিন (রহ.) যুদ্ধক্ষেত্রে শাহাদত বরণ করেন, তখন তিনি তাঁর মৃতদেহ কাঁধে করে একটি নিকটবর্তী মসজিদে নিয়ে যান এবং পাশে বসে কুরআন তেলাওয়াত শুরু করেন। শামেলীর যুদ্ধের পর তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় এবং তাঁকে গ্রেফতার করে সাহারানপুর কারাগারে পাঠানো হয়। পরে তাঁকে সেখান থেকে মুজফফরনগরে স্থানান্তর করা হয়। তিনি ছয় মাস জেলে ছিলেন। এ সময় জেলের অনেক কয়েদি তাঁর মুরিদ হয়ে যান। ফলে তখন জেলখানাতেই তাদের নিয়ে জামাআতের সঙ্গে নামাজ আদায় করতেন তিনি।

হাদীস শিক্ষাদান
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আবার দ্বীনি শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু করেন। ১২৯৯ হিজরিতে তৃতীয় হজ্ব শেষে তিনি একটি নিয়ম চালু করেন—এক বছরের মধ্যে ছহিহ সিত্তাহ (ছয়টি প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ) সম্পূর্ণ পড়ানো হবে। তার মাধ্যমেই সর্বপ্রথম এই নিয়ম চালু হয়। তাঁর নিয়ম ছিল, সকাল থেকে ১২টা পর্যন্ত ছাত্রদের পড়াতেন। তাঁর পাঠদানের খ্যাতি এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে দূর-দূরান্ত থেকে হাদীস শিক্ষার্থীরা আসতে শুরু করেন। কখনো কখনো ছাত্রসংখ্যা ৭০-৮০ জনে পৌঁছে যেত, যাঁদের মধ্যে হিন্দুস্তানের বাইরের শিক্ষার্থীরাও থাকতেন। তিনি ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন। তাঁর পাঠদান এত সহজ-সরল ও হৃদয়গ্রাহী ছিল যে সাধারণ মানুষও তা বুঝে ফেলত। তাঁর পাঠে এমন আকর্ষণ ছিল যে, হাদীস শুনেই তাতে আমল করার আগ্রহ সৃষ্টি হতো।

তিনি তিরমিযী শরীফে পাঠদানকৃত আলোচনাগুলো "আল-কাওকাব আদ-দুররী" নামে সংকলন করেন, যা সংক্ষিপ্ত হলেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ। ১৩১৪ হিজরি পর্যন্ত তাঁর পাঠদান অব্যাহত ছিল। তাঁর থেকে তিন শতাধিক ছাত্র দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। তাঁর শেষ ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হজরত মাওলানা মুহাম্মদ যাকারিয়ার পিতা—মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া কান্ধলভী (রহ.)।

জীবনের শেষ দিকে ডায়বেটিস যাতীয় রোগে আক্রান্ত হলে পাঠদান বন্ধ হয়ে গেলেও, নসিহত, তালিম ও ফতোয়ার কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। আল্লাহর জিকিরের প্রতি তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। যারা তাঁর খেদমতে আসতেন, তারা কিছু না কিছু আখিরাতমুখী প্রেরণা নিয়েই ফিরতেন। তিনি সুন্নাতের অনুসরণে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন।

দারুল উলূম দেওবন্দ ও তাঁর রূহানী নেতৃত্ব
১৮৬৬ সালে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা হয়। হজরত গাঙ্গুহী রহ. ছিলেন এর অন্যতম রূহানী রাহবার। যদিও তিনি সরাসরি শিক্ষকতা করেননি, তবে এই প্রতিষ্ঠানকে আদর্শগত ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে পরিপুষ্ট করেন। তাঁর মাকাসিদ, চিন্তাধারা ও নেতৃত্বের দিকনির্দেশনা দেওবন্দের শিক্ষা-নীতি ও আধ্যাত্মিক ধারা নির্মাণে মৌলিক ভূমিকা রাখে। ছাত্র যমানা থেকে মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহ.-এর সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। আমৃত্যু তাদের সম্পর্ক ছিল অটুট। তারই ধারাবাহিকতায় ১২৯৭ হিজরিতে কাসিম নানুতুবী (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। কঠিন পরিস্থিতিতে দারুল উলূমের জটিল সমস্যাগুলো মসৃণভাবে সমাধান করে নেওয়া ছিলো তাঁর এক বড় বৈশিষ্ট্য। তিনি নিয়মিত দেওবন্দে আসতেন, তদারকি করতেন এবং শিক্ষকদেরকে উৎসাহিত করতেন। তাঁর উপস্থিতি ছিল এক ধরনের আত্মিক প্রশান্তির উৎস। দেওবন্দের উস্তাদ, ছাত্র ও তালীমী পরিমণ্ডলে তাঁর প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী। ১৩১৪ হিজরি থেকে তিনি মাযাহিরে উলূম সাহারানপুর মাদ্রাসারও সারপুরুস্তি গ্রহণ করেন।

ফিকহি ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান
হজরত গাঙ্গুহী রহ.-এর অন্যতম প্রধান অবদান তাঁর ফিকহি দৃষ্টিভঙ্গি ও ফতোয়ার সংকলন। তাঁর ফতোয়ার সংকলন "ফাতাওয়া রশীদিয়া" উপমহাদেশের ফিকহি ঐতিহ্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। এই গ্রন্থে তিনি কেবল কিতাবি তথ্য নয়, বরং মানুষের বাস্তব সমস্যা, সময়ের প্রেক্ষাপট এবং শরঈ দলিলের উপর নির্ভর করে গভীর বিশ্লেষণমূলক উত্তর প্রদান করেছেন। তাঁর ফিকহি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পরিপূর্ণ ইখলাসপূর্ণ, মূলনীতিনির্ভর ও মধ্যপন্থী। তিনি দলীল ও হানাফি মাযহাবের ব্যাখ্যাকে সুন্দরভাবে সমন্বয় করতেন। ফতোয়ার ক্ষেত্রে কঠোরতা নয়, বরং সহানুভূতি, মানবিকতা ও শরীয়তের সৌন্দর্য তিনি তুলে ধরতেন।

ইন্তিকাল 
১৩২৩ হিজরী/১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইন্তিকাল করেন। গাঙ্গোহেই তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর ইন্তিকালের পর কেবল একটি যুগ নয়, বরং এক আদর্শিক ধারার প্রত্যক্ষ সাহচর্য হারিয়ে যায়। তবে তাঁর রেখে যাওয়া চিন্তা, শিক্ষা, খেদমত ও আধ্যাত্মিক ধারা আজও কোটি মানুষের অন্তরে বেঁচে আছে।
হজরত রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ. ছিলেন এমন এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, যিনি একই সাথে আলেম, মুফতী, মুর্শিদ, দাঈ, মুজাহিদ ও ফিকহি বিশ্লেষক ছিলেন। তাঁর জীবন ছিল কর্মে পূর্ণ, চিন্তায় দীপ্ত এবং আখলাকে শুদ্ধ। উপমহাদেশের মুসলমানদের আত্মিক জাগরণ, দীনের সংরক্ষণ ও উম্মাহর ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার পেছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

তাঁর জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা—আত্মশুদ্ধি ছাড়া দাওয়াহ পূর্ণ হয় না, ইলম ছাড়া নেতৃত্ব ফলপ্রসূ হয় না, এবং ইখলাস ছাড়া কোনো খেদমত টিকে না। তাই হযরতের জীবন কেবল স্মরণীয় নয়, বরং অনুকরণীয়।

গ্রন্থপঞ্জি:
1.    তাযকিরাতুর রাশীদ
2.    ফাতাওয়া রশীদিয়া 
3.    উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাজী 
4.    আসারে রশীদ 
5.    তারিখে দেওবন্দ 
6.    তাবাকাতে আকাবির 
লেখক, ফাজেলে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ, 
সিনিয়র মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর।

এসএকে/


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ