বিশেষ প্রতিনিধি
বেশ কয়েকটি ইসলামি দলের সমন্বয়ে ইসলামী ঐক্যজোট গঠিত হলেও পরবর্তী সময়ে এটি একটি দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়। সেই দলটির নেতৃত্ব দেন এদেশের ইসলামি আন্দোলনের ‘সিংহপুরুষ’ হিসেবে পরিচিত মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.। জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ইসলামি রাজনীতিতে ইসলামী ঐক্যজোটের যে বিশেষ অবস্থান সেটা মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.-এর কারণেই।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. ইন্তেকাল করেন। দলের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। তবে দীর্ঘদিন দলটি মুফতি আমিনীর আদর্শের ওপর অটল ছিল। কিন্তু একটা সময়ে এসে দলটি নিজের অবস্থান এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়, যা মুফতি আমিনীর নীতি ও আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন অনেকেই। আপসকামিতা ও নানা হিসাব-নিকাশের কারণে দলটির গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। গত বছরের আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর পরিবর্তন এসেছে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতৃত্বেও। নতুন নেতৃত্ব দলটিকে মুফতি আমিনীর নীতি ও আদর্শের ওপর পুনর্বহালের অঙ্গীকার করেছে।
ইসলামী ঐক্যজোটের যাত্রা ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে। তৎকালীন ছয়টি ইসলামি দল নিয়ে গঠন করা হয় এই জোট। দলগুলো হচ্ছে- খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলামী পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (বর্তমান ইসলামী আন্দোলন), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ফরায়েজী আন্দোলন।
নব্বইয়ের দশকের পুরোটাজুড়েই ছিল ইসলামী ঐক্যজোটের একচেটিয়া প্রভাব। একানব্বই ও ছিয়ানব্বইয়ের সংসদে দলটির প্রতিনিধিত্ব ছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে চারদলীয় জোটে অংশ নেওয়াকে কেন্দ্র করে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও এর প্রভাব খুব একটা কমেনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোট থেকে চারজন সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন। তবে তখন জোট সরকারে মন্ত্রিত্বের ভাগ নেওয়াকে কেন্দ্র করে ইসলামী ঐক্যজোট কার্যত ভাগ হয়ে যায়। একটি অংশের নেতৃত্ব দেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ., আরেকটি অংশের নেতৃত্ব দেন মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ.। তবে একটা পর্যায়ে গিয়ে শায়খুল হাদিস ইসলামী ঐক্যজোটের দাবি থেকে সরে আসায় এটি মুফতি আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট হিসেবেই পরিচিত হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তৎকালীন মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকার দল নিবন্ধনের আইন চালু করে। তখন ইসলামী ঐক্যজোট একটি স্বতন্ত্র দল হিসেবে নিবন্ধিত হয়। মুফতি আমিনীর নিজের দল ইসলামী মোর্চা (পরবর্তী সময়ে খেলাফতে ইসলামী) থাকলেও তিনি ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান হিসেবেই সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপি জোট থেকে নির্বাচনও করেন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হিসেবে।
মুফতি আমিনীর ইন্তেকালের পর ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হন মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী রহ.। ২০২০ সালে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন এই দলের চেয়ারম্যান। আর তাঁর সঙ্গে মহাসচিব ছিলেন মুফতি ফয়জুল্লাহ। ইসলামী ঐক্যজোট দীর্ঘদিন বিএনপি জোটের সঙ্গে থাকলেও ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে জোট ত্যাগ করে। এই সিদ্ধান্তের ফলে দলে কিছুটা অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। হেফাজতে ইসলামের বর্তমান আমির মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী এক সময় ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়ে ইসলামী ঐক্যজোট ত্যাগ করেন।
বিএনপি জোট থেকে বের হওয়ার পর ইসলামী ঐক্যজোট আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগের কাছাকাছি হতে থাকে। অনেকে অভিযোগ করেন, মূলত আওয়ামী লীগ সরকার প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে ইসলামী ঐক্যজোটকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে বিচ্ছিন্ন করে। পরবর্তী সময়ে ইসলামী ঐক্যজোটের কোনো কোনো নেতার আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
একটা পর্যায়ে ইসলামী ঐক্যজোট ইস্যুতে মুফতি আমিনীর পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি হয়। তাঁর ছেলে এক দিকে চলে যান এবং জামাতাদের কয়েকজন চলে যান অন্য পক্ষে। তাদের মধ্যে বিরোধ সুস্পষ্ট আকার ধারণ করে। এর প্রভাব দলের পাশাপাশি মুফতি আমিনীর মাদরাসা হিসেবে পরিচিত লালবাগ ও বড়কাটারায়ও পড়ে। এতে ইসলামী ঐক্যজোটে দেশজুড়ে যে প্রভাব রাখত, দলটির যে শক্তি ছিল, তার অনেকটাই খর্ব হয়।
২০২০ সালে মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামীর ইন্তেকালের পর ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হন মুফতি আমিনীর ছোট ছেলে মাওলানা হাসানাত আমিনী। মহাসচিব পদে মুফতি ফয়জুল্লাহ বহাল থাকেন। এই সময়টিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাদের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে। ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচন যখন বেশির ভাগ ইসলামি দল বর্জন করে তখন ইসলামী ঐক্যজোট সেই নির্বাচনে অংশ নেয়। যদিও ভোটের মাঠে কেউই পাত্তা পাননি। মূলত এই নির্বাচনে যাওয়ার পর থেকেই ইসলামি ঐক্যজোট ইসলামপন্থীদের কাছে নেতিবাচক পরিচিতি পায়।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বেকায়দায় পড়ে ইসলামী ঐক্যজোটের নেতৃত্বও। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবুল হাসানাত আমিনী ৩ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন। সেই সঙ্গে তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব পর্যায়ের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। হাসানাত আমিনী পিতা মুফতি আমিনীর রাজনৈতিক আদর্শ লালন করে ইসলামী ঐক্যজোটকে পুনর্গঠনের জন্য কারানির্যাতিত আলেম মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজীকে জাতীয় সম্মেলন করার দায়িত্ব দেন। মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী মুফতি আমিনীর মেয়ের জামাতা।
পরবর্তী সময়ে ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার লালবাগে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে মাওলানা আবদুল কাদিরকে চেয়ারম্যান ও মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজীকে মহাসচিব করে ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। সেই নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট এখন পরিচালিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে মুফতি আমিনীর নীতি ও আদর্শ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার যে বদনাম ইসলামী ঐক্যজোটের গায়ে লেগেছিল তা দূর করার চেষ্টা করছে নতুন নেতৃত্ব। ইসলামী ঐক্যজোট অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক ও যোগাযোগ শুরু করেছে। আগামী নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর সমন্বয়ে যে বৃহত্তর জোটের আলোচনা চলছে সেখানে ইসলামী ঐক্যজোটও থাকার ব্যাপারে তাদের সম্মতি জানিয়েছে।
ইসলামী ঐক্যজোটের বর্তমান মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজী আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘মুফতি আমিনী (রহ.)-এর আদর্শের ওপর অটল আছি এবং সবসময় সেই আদর্শের ওপর অটল থাকার চেষ্টা করে যাব ইনশাআল্লাহ।’
আগামী নির্বাচন নিয়ে দলীয় প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রার্থীর সংখ্যা বলা এই মুহূর্তে কষ্টকর। কাজ চলছে। দেখা যাক, কতজন প্রার্থী দেওয়া যায়। ইসলামী ঐক্যজোটের সমর্থন যেসব এলাকায় বেশি, সেই এলাকাগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছি।’
দলকে সক্রিয় করার জন্য সেক্রেটারি হিসেবে কী কী কাজ করেছেন-এমন প্রশ্নে মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী বলেন, ‘ইসলামী ঐক্যজোট ফ্যাসিবাদের শেষ তিন বছর দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে গেছে। আস্থা ফিরিয়ে আনা আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই লক্ষ্যে আমরা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে ব্যাপক কাজ করছি। সংলাপসহ বিভিন্ন মিটিংয়ে অংশ নিচ্ছি। জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে মাহফিল, আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণ কর্মশালাসহ বিভিন্ন জায়গায় কমিটি নবায়নের মাধ্যমে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’
এসএকে/