সোমবার (৭ ডিসেম্বর) বাদ মাগরিব ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ অ্যান্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার’ এর উদ্যোগে সেন্টারের মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশে বিদ্যমান কওমি শিক্ষাব্যবস্থা ও বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক মাওলানা শহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি হিসেবে আলোচনা করেন নিউইয়র্ক- আমেরিকার ‘বাইতুল হামদ একাডেমি’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও প্রবীণ কওমী শিক্ষাবিদ মুফতি জামাল উদ্দিন। আলোচনা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ তারেক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুফতি জামাল উদ্দিন বলেন, ইসলামে শিক্ষার দুটি প্রধান ধারা রয়েছে: ইলমুল আদিয়ান—অর্থাৎ দীনি শিক্ষা এবং ইলমুল আবদান—অর্থাৎ মানবিক ও জাগতিক শিক্ষা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা. উভয় শিক্ষার প্রতিই সমান গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সাহাবায়ে কিরাম থেকে শুরু করে হাজার বছর ধরে মুসলিম উম্মাহ এই সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বকে আলোকিত করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের ফলে মুসলমানরা এ শিক্ষাগত ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যার গভীর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে।
তিনি বলেন, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থা আমাদেরকে যেন পরনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত করেছে। একজন ছাত্র যেনো দীনি ইলমে পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি জাগতিক জ্ঞানেও সমৃদ্ধ হতে পারে—এমন যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া এখন সময়ের দাবি।
মুফতি জামাল উদ্দিন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দীনি শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত মানের ঘাটতি উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। শরিয়তের মূল বক্তব্য অনুধাবনে আমরা অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছি। দেশে প্রকৃত শরিয়া বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে হলে কওমী ও জাগতিক শিক্ষায় উন্নয়নে বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা-ফিকিরের মাধ্যমে একটি উপযোগী মডেল তৈরি করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কেবল আলেমের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না; আমাদের প্রয়োজন জ্ঞান, আমল, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও আদর্শিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলেম—যাদের মতামত জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এবং যাদের জ্ঞানের গভীরতা সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হবে।
ভাষা শিক্ষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকেই আরবি ও মাতৃভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষার প্রতি অনীহা নিয়ে বড় হয়েছি, যা একটি ভ্রান্ত ধারণা। সমগ্র মানবজাতির কাছে ইসলামের সঠিক বার্তা পৌঁছে দিতে হলে আলেমদের বহু ভাষায় দক্ষ হওয়া জরুরি। ভাষার ভিত্তিতে কোনো জাতিকে অবজ্ঞা করা শরীয়তের স্বভাবসুলভ মেজাজের পরিপন্থী। সাহাবায়ে কিরাম ও তৎপরর্তী যুগের মুসলিমরা যদি অন্যান্য জাতির ভাষা শেখার ব্যাপারে অনাগ্রহী হতেন, তবে ইসলামের আলো বহু জাতির কাছে পৌঁছাত না।
তিনি আরও বলেন, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বহু ভাষা ও বহু জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যকে তাঁর সৃষ্টিশৈলীর নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাই একজন আলেমের পক্ষে ভাষা শেখার প্রতি অনীহা দেখানোর প্রশ্নই আসে না।
প্রফেসর হাফেজ মাওলানা ড. মুহাম্মদ তারেক তাঁর আলোচনায় বাংলাদেশের বিদ্যমান কওমী শিক্ষাব্যবস্থা ও সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার তুলনা তুলে ধরেন। তিনি দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা এবং বেফাকুল মাদারিসের শিক্ষা-সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোকপাত করেন।
তিনি বলেন, “কওমী শিক্ষা সংস্কার সময়ের দাবি। তরুণ প্রজন্ম এ বিষয়ে আগ্রহী হলেও প্রবীণদের মধ্যে এখনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। তারপরও বিভিন্ন মহলে চিন্তা-ভাবনা চলছে, এবং সরকারী কিছু উদ্যোগ আছে; তবে এগুলো আরও শক্তিশালী ও কার্যকরী হওয়া প্রয়োজন।”
সভাপতির বক্তব্যে সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক মাওলানা শহীদুল ইসলাম বলেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ১ কোটি মানুষ কওমী শিক্ষাব্যবস্থার সাথে যুক্ত। এতো বিপুল সংখ্যক মানুষকে রাষ্ট্রের মূলধারা থেকে বেইরে রাখা চরম নাগরিক বৈষম্য । এ বিষয়গুলো নিরসনে সরকারী ও রাজনৈতিক কার্যকরী উদ্যোগও থাকা দরকার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার থাকা অত্যন্ত জরুরী।
আলোচনা সভায় ঢাকা ও আশপাশের জেলার বহু মাদরাসার মুহতামিম, সিনিয়র মুহাদ্দিস, মুফতি, শিক্ষক, ইফতা বিভাগের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উপস্থিত ছিলেন। বিশিষ্ঠ সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী জনাব ইফতেখার রসূল অনুষ্ঠান আয়োজনে সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করেন।
আলোচনা শেষে উপস্থিত সূধীজনদের বিভিন্ন প্রশ্নের সাবলীল ও তথ্যপূর্ণ জবাব দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন মুফতী মাওলানা জামাল উদ্দীন। তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করে।
আরএইচ/