মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক:।।
১. শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (আবুল আব্বাস আহমাদ ইবনে আব্দুল হালীম ৭২৮ হি.)
শায়েখ ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, ‘পনেরো শাবানের রাতের ফযীলত সর্ম্পকে একাধিক ‘মারফূ’ হাদীস ও ‘আসারে সাহাবা’ বর্ণিত রয়েছে। এগুলো দ্বারা ওই রাতের ফযীলত ও মর্যাদা প্রমাণিত হয়। সালাফে সালেহীনের কেউ কেউ এ রাতের নফল নামাযের ব্যাপারে যত্নবান হতেন। আর শাবানের রোযার ব্যাপারে তো সহীহ হাদীসসমূহই রয়েছে।
কোনো কোনো আলেম যদিও এই রাতের ফযীলত অস্বীকার করেন; কিন্তু হাম্বলী ও গায়রে হাম্বলী অধিকাংশ আলেমই এই রাতের ফযীলতের কথা স্বীকার করে থাকেন। ইমাম আহমাদ রাহ.-এর মতও তাই। কেননা এর ফযীলত সম্পর্কে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং এগুলোর সমর্থনে সালাফ (সাহাবী ও তাবেয়ী)-এর ‘আসার’ও বিদ্যমান আছে; যেগুলো ‘সুনান’ ও ‘মুসনাদ’ শিরোনামে সংকলিত হাদীসের কিতাবে [বরং কতক ‘সহীহ’ শিরোনামের কিতাবেও যেমন সহীহ ইবনে খুযাইমা (কিতাবুত তাওহীদ) সহীহ ইবনে হিব্বান প্রভৃতিতে] রয়েছে।
অবশ্য শুধু পনেরো তারিখের দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া মাকরূহ। (ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর মত এটিই। তাঁর মতে পনেরো তারিখের সাথে দু-একদিন মিলিয়ে নেওয়া উত্তম।) আর এই দিন বা রাতে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা এবং সাজ-সজ্জার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া ইত্যাদি বিদআত ও ভিত্তিহীন। তেমনি এই রাতে ‘সালাতে আলফিয়া’ নামের মনগড়া নামাযের জন্যে সমবেত হওয়াও বিদআত।’ -ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ২/৬৩১-৬৩২
ইবনে তাইমিয়া রাহ.-এর যুগে ‘সালাতে আলফিয়া’-এর রেওয়াজ ছিল। লোকেরা একটি জাল রেওয়ায়াতের ভিত্তিতে মনে করত যে, শবে বরাতে প্রতি রাকাতে ১০ বার করে সূরা ইখলাস পড়ে ১০০ রাকাত নফল নামায পড়া উচিত।
উক্ত রেওয়ায়াতটি সম্পূর্ণই জাল। (আললাআলিল মাসনূআ, ইমাম সুয়ূতী ২/৫৮-৬০; আলফাওয়াইদুল মাজমূআ, ইমাম শাওকানী ১/৭৬) আমার জানা মতে আজ কোথাও এর রেওয়াজ নেই। তবে এর স্থলে ‘মকসূদুল মুমিনীন’-এর বাতানো পদ্ধতির মনগড়া একটি নামায কতিপয় লোকের মাঝে প্রচলিত রয়েছে।
মনে রাখতে হবে, ‘মকসূদুল মুমিনীন’-এর ওই বিশেষ পদ্ধতির নামায ও এর রেওয়ায়াতসমূহ সবই ভিত্তিহীন। (দেখুন, চলতি সংখ্যার প্রচলিত ভুল বিভাগ) এসব পরিহার করে এই রাতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাধারণ নফল নামাযের মত নফল নামায পড়া উচিত। হাদীস দ্বারা শুধু এতটুকুই প্রমাণিত হয় যে, এই রাতের নফল হবে লম্বা, সেজদা হবে দীর্ঘ দীর্ঘ। দু রাকাত করে যত ইচ্ছা পড়া যাবে; রাকাত সংখ্যাও নির্দিষ্ট নেই; কোনো নির্দিষ্ট সূরার সীমাবদ্ধতাও নেই। -আলআসারুল মারফূআ, আল্লামা আব্দুল হাই লাখনোভী ৮০-৮৫; মারাকিল ফালাহ শরহে নূরুল ইযাহ ২১৯
২. ইমাম যাইনুদ্দীন ইবনে রজব দামেস্কী (৭৯৫ হি.)
ইমাম ইবনে রজব রাহ. তাঁর ‘লাতায়িফুল মাআরিফ ফীমা লিমাওয়াসিমিল ‘আমি মিনাল ওয়াযায়েফ’- এ শবে বরাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর আলোচনার সার-সংক্ষেপ হচ্ছে-
“শাবান মাসের পনেরো তারিখে রোযা নিষেধ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কেননা ওই দিন তো ‘আইয়ামে বীজ’ (চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ)-এর অন্তর্ভুক্ত। আর প্রতি মাসেই আইয়ামে বীজ-এ রোযা রাখা মুস্তাহাব। তাছাড়া ১৫ শাবানের রোযা সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র হাদীসও রয়েছে; যদিও এর ‘সনদ’ দুর্বল। সুনানে ইবনে মাজাহ-এ হযরত আলী রা. এর মাধ্যমে বর্ণিত, “যখন ১৫ শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে নামায পড় এবং সামনের দিনে রোযা রাখ...।”
এরপর শবে বরাতের ফযীলত সর্ম্পকে একাধিক হাদীস উল্লেখ করার পর তিনি লেখেন- “সঠিক কথা হচ্ছে এই রাতের ইবাদত ব্যক্তিগতভাবে করা উচিত। এ রাতে নফল নামাযের জন্য মসজিদে ভিড় করা বা মাহ্ফিল করা মাকরূহ।”
তিনি আরো বলেন, “একজন মুমিন বান্দার উচিত, এ রাতে যিকির ও দুআর জন্য পুরোপুরি অবসর হওয়া। প্রথমে খাঁটি মনে তওবা করবে; এরপর মাগফেরাত ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে; আপদ-বিপদ দূর হওয়ার জন্য দুআ করবে এবং নফল নামায পড়বে। সবসময় সেসব গুনাহ থেকে বিরত থাকবে যেগুলো ওই রাতের বিশেষ ফযীলত (ব্যাপক ক্ষমা) থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে। যেমন শিরক, হত্যা, যিনা, হিংসা ইত্যাদি।”
তিনি আরো বলেন, “(ওই রাতের ফযীলত স্বীকৃত তবে) একথা সঠিক নয় যে, সূরা দুখান-এর আয়াতে যে ‘লায়লাতুম মুবারকা’-এর উল্লেখ এসেছে তার দ্বারা উদ্দেশ্য এই শবে বরাত। কেননা সঠিক এটাই যে, তা দ্বারা শবে কদর উদ্দেশ্য।” -লাতায়িফুল মাআরিফ ১৫১/১৫৭
৩. ইমাম ইবনুল হাজ্জ (আলমাদখাল গ্রন্থকার ৭৩৭হি.)
শায়েখ ইবনুল হাজ্জ রাহ. যাঁর গ্রন্থ ‘আলমাদখাল’ বিভিন্ন রসম-রেওয়াজ ও বিদআত খ-নে এবং সুন্নত জিন্দা ও প্রচার প্রসারে উৎকৃষ্ট গ্রন্থাবলির অন্তর্ভুক্ত, তিনি এই গ্রন্থের ১ম খ-ের শেষাংশে শবে বরাতের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। অন্তরের অত্যন্ত দরদ নিয়ে ওইসব বিদআত ও কুসংস্কার সম্পর্কে সবিস্তারে সতর্ক করেছেন, যেগুলো মানুষ শয়তানের ধোঁকা ও প্ররোচনায় এই রাতের ফযীলত লাভের বৈধ পদ্ধতি ছেড়ে অবলম্বন করেছে এবং এখনো করছে।
তিনি বলেন, “এ রাত যদিও শবে কদরের মত নয়; কিন্তু এর অনেক ফযীলত ও বরকত রয়েছে। আমাদের পূর্বসূরি পুণ্যাত্মারা এই রাতের যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন এবং এর যথাযথ হক আদায় করতেন। কিন্তু আজ সাধারণ লোকেরা বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উল্টো করে ফেলেছে। তারা রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের পেছনে পড়ে (মনের অজান্তেই) এর খায়ের বরকত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
একে তো ওরা এ রাতে আলোকসজ্জার নিকৃষ্টতম রসম যা অগ্নিপূজকদের প্রতীক, তা আবিষ্কার করেছে; অপরদিকে মসজিদসমূহে সমবেত হয়ে শোরগোল করে পবিত্র পরিবেশকে নষ্ট করেছে। তাছাড়া মহিলাদের কবরস্থানে যাওয়া, তা-ও আবার বেপর্দা অবস্থায়, পাশাপাশি পুরুষদেরও কবর যিয়ারতের নামে ওখানে ভিড় সৃষ্টি করা- এ সব কিছুই নব-আবিষ্কৃত বিদআত এবং নববী সুন্নত ও সলফে সালেহীনের পথ ও পদ্ধতির পরিপন্থী। -আলমাদখাল ১/২৯৯-৩১৩
৪. শায়েখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. (১০৫২ হি.)
তিনি তাঁর ‘মা সাবাতা বিস্সুন্নাহ ফী আইয়ামিস সানাহ’ (যার উর্দূ অনুবাদ ‘মুমিন কে মাহ ও সাল’ নামে করাচি থেকে আরবীসহ প্রকাশিত হয়েছে)-এ যেখানে তিনি এই রাতের ফযীলত তুলে ধরেছেন, পাশাপাশি এই রাত সম্পর্কে কিসসা-কাহিনীকারদের বানানো মিথ্যা ও বাতিল বিষয়াবলির খ-ন করেছেন এবং সেসব গর্হিত বিষয়েও সতর্ক করেছেন যেগুলো পরবর্তী লোকেরা আবিষ্কার করেছে।
তিনি বলেন, “এই রাতের নিকৃষ্টতম বিদআতসমূহের মাঝে নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত-
ঘর-বাড়ি, দোকান-পাটে আলোকসজ্জা করা, খেলাধুলা ও আতশবাজির উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়া ইত্যাদি। এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং এগুলোর সপক্ষে কোনো জাল রেওয়ায়েতও কোথাও নেই। প্রবল ধারণা যে, এগুলো হিন্দুদের ‘দেওয়ালী’ প্রথা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।” -মা সাবাতা বিস্সুন্নাহ ৩৫৩/৩৬৩
শবে বরাত সম্পর্কে পূর্বসূরিদের বহু উক্তি রয়েছে। এখানে উদাহরণস্বরূপ কিছু উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়লে একদিকে যেমন এই রাতের ফযীলত, এ রাতে ব্যক্তিগত ইবাদত যথা নফল নামায, যিকির ও দুআ, তওবা ইস্তেগফার, দরূদ শরীফের অযিফা ও কুরআন তিলাওয়াত প্রভৃতির গুরুত্ব জানা যাবে; তেমনি এ রাতের সেসব রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কার সম্পর্কেও জানা যাবে, যেগুলো মূলত লোকদের এই রাতের প্রভূত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে শয়তানের ধোঁকা ও প্ররোচনায় আবিষ্কৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কল্যাণের তাওফীক দান করুন এবং সর্বপ্রকার অকল্যাণ থেকে নিরাপদ রাখুন- আমীন। আল-কাউসার
-এটি
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                           
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        