মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর ২০২৫ ।। ৫ কার্তিক ১৪৩২ ।। ২৯ রবিউস সানি ১৪৪৭

শিরোনাম :
ময়মনসিংহে ইসলামি বইমেলা শুরু ১৩ নভেম্বর ভারতের পুনে দুর্গে নামাজ আদায় করা নিয়ে দেশভর তোলপাড় ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের আরও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে: শায়খে চরমোনাই কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত 'বাংলাদেশ' নামের পত্রিকা : স্বাধীনতার ৩৩ বছর আগের এক ঐতিহাসিক দলিল ভারতের সঙ্গে ১০ চুক্তি বাতিল হওয়ার খবরটি ভুল : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা নাতির কাছে কায়দা শিখছেন অভিনেতা মিশা সওদাগর জামায়াত সেক্রেটারি পরওয়ারের বক্তব্য ঔদ্ধত্যপূর্ণ: এনসিপি ইউএস-বাংলার বহরে যুক্ত হলো তৃতীয় এয়ারবাস এ৩৩০ সম্পন্ন হলো আবু ত্বহা ও সাবিকুন নাহারের তালাক বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নওগাঁ জেলা শাখা পুনর্গঠন

মুরাবাহা কী?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা আব্দুল্লাহ মাসুম :

মুরাবাহা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আদর্শিক কোনো বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়। এর ব্যবহার সীমিত করতে হবে। বিকল্প হিসেবে ভিন্ন কোনো কর্মকৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে যতটুকু মুরাবাহার চর্চা হবে, সেটা
সঠিকভাবে করতে হবে

মুরাবাহা ইসলামী ফিকাহর একটি বিশেষ ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির নাম। এর দুইটি রূপ আছে। যথাÑ প্রাচীন মুরাবাহা ও আধুনিক ইসলামী ব্যাংকিং মুরাবাহা। এখানে সংক্ষেপে দুইটির পরিচিতি ও তাৎপর্য পেশ করা হলোÑ
প্রাচীন মুরাবাহার পরিচিতি : ‘মুরাবাহা’ শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ পরস্পরে লাভবান হওয়া। মুরাবাহার মূল কথা হলো, চুক্তিমূলে পণ্য ক্রয় বা সংগ্রহ বাবদ মূল খরচ ও মুনাফা আলাদা করে উল্লেখ করতে হবে।
উদাহরণ ২০০ টকা দিয়ে ‘ক’ এক জোড়া জুতা ক্রয় করল। এরপর সে তা মুরাবাহা ভিত্তিতে ‘খ’ এর কাছে ১০ টাকা লাভে বিক্রি করতে আগ্রহী। তাহলে সে ওই পণ্য বাবদ তার খরচ ২০০ টাকা উল্লেখ করে এর ওপর ১০ টাকা মুনাফা নেয়ার কথা চুক্তিতেই ঘোষণা করতে হবে। এতে ‘খ’ রাজি হয়ে বিক্রির প্রস্তাব গ্রহণ করলে তা মুরাবাহা ক্রয়-বিক্রয় হিসেবে বিবেচিত হবে।

মুরাবাহার বৈশিষ্ট্য : অন্যান্য বিক্রয় চুক্তির চেয়ে মুরাবাহার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তা হলো মুরাবাহায় পণ্য ক্রয় বাবদ মূল্য ও খরচ (যদি থাকে) চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ করতে হয়, মুরাবাহা চুক্তিতে মুনাফার হার বা সুনির্দিষ্ট অঙ্ক আলাদা করে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করত হবে, মুরাবাহা চুক্তি আমানত ও বিশ্বস্ততানির্ভর বিক্রয় চুক্তি।
প্রাচীন মুরাবাহার সঙ্গে অন্যান্য ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির পার্থক্য : অন্যান্য সাধারণ বিক্রয় চুক্তির চেয়ে মুরাবাহার একমাত্র মৌলিক স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হলো, মুরাবাহায় বিক্রেতা স্পষ্টভাবে ক্রেতাকে বলবে, ‘পণ্যটির ক্রয়মূল্য এত বা পণ্য বাবদ আমার খরচ হয়েছে এত। এরপর এর ওপর এত মুনাফা ধার্য করে তা বিক্রি করতে আগ্রহী।’ সুতরাং চুক্তিতে পণ্য বাবদ খরচ ও মুনাফা পৃথকভাবে উল্লেখ না করা হলে সেটা মুরাবাহা হবে না। যদিও বাস্তবে মূল খরচের ওপর মুনাফা ধার্য করা হয়।

ইসলামী ব্যাংকিং মুরাবাহা : বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যাংকিং মুরাবাহা প্র্যাক্টিস হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর অধিকাংশ বিনিয়োগ পদ্ধতি মুরাবাহার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত হবে বা মুরাবাহাভিত্তিক ফাইন্যান্স গ্রহণ করবে, তাদের জন্য ব্যাংকিং মুরাবাহার সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত হওয়া একান্ত জরুরি।

ব্যাংকিং মুরাবাহার প্রাথমিক ধারণা : ব্যাংকিং মুরাবাহা মূলত সুদি বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মূল কথা হলো, কারও কোনো পণ্য ক্রয়ের প্রয়োজন। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ নেই। এখন লোকটি যদি সুদি ব্যাংকে অর্থের জন্য গমন করে, তাহলে ব্যাংক তাকে সুদভিত্তিক লোন প্রদান করবে। এরপর লোকটি সেই লোন দিয়ে ওই পণ্য ক্রয় করে তার প্রয়োজন নির্বাহ করবে। অপরদিকে সুদমুক্ত ইসলামী কোনো ব্যাংকে যদি লোকটি যায় এবং নিজের প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করে, তাহলে ইসলামী ব্যাংক তাকে সরাসরি ফান্ড সরবরাহের পরিবর্তে গ্রাহক যে পণ্য ক্রয়ের জন্য ফান্ড চেয়েছে, সেটা প্রথমে ব্যাংক নিজে ক্রয় করবে। এরপর তা মুরাবাহা ভিত্তিতে বাকিতে অধিক মূল্যে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে দেবে। যেহেতু এখানে গ্রাহক ব্যাংকে এসে পণ্য খরিদের জন্য ব্যাংককে প্রস্তাব করেছে, এরপর তার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ব্যাংক পণ্য খরিদ করে মুরাবাহা বিনিয়োগ করেছে, তাই তাকে আধুনিক আরবি ভাষায় ‘মুরাবাহা লিল-আমির বিশ-শিরা’ (ক্রয়ের আদেশদাতা ক্রেতার স্বার্থে মুরাবাহা চুক্তি করা) বলে।

ব্যাংকিং মুরাবাহা বাস্তবায়নের স্তরবিন্যাস : মোট তিনটি স্তরে ব্যাংকিং মুরাবাহা সম্পন্ন হয়ে থাকে। যথাÑ ১. গ্রাহক, যে ব্যাংককে পণ্য ক্রয়ের আদেশ করেছে এবং ব্যাংক থেকে ক্রয়কৃত পণ্যটি কিনে নেবে বলে ওয়াদাও প্রদান করেছে। ২. ইসলামী ব্যাংক, যে গ্রাহকের আবেদন মঞ্জুর করে পণ্যটি নিজে বা গ্রাহককে প্রতিনিধি করে সরবরাহকারী থেকে ক্রয় করবে। ৩. সবশেষে গ্রাহক ইসলামী ব্যাংক থেকে ক্রেতা হিসেবে পূর্ব ওয়াদা অনুযায়ী পণ্য ক্রয় করে নেবে।

ওই তিনটি স্তর মূলত তিনটি আকদ বা চুক্তিকে অনিবার্য করে। প্রথম স্তরে গ্রাহক, ব্যাংকের সঙ্গে একটি ওয়াদা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। ওই ওয়াদা রক্ষা করা আবশ্যক। দ্বিতীয় স্তরে ইসলামী ব্যাংক, যে পণ্যটি হয় নিজে বা গ্রাহককে প্রতিনিধি করে সরবরাহকারী থেকে ক্রয় করবে। গ্রাহককে প্রতিনিধি করা হলে গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের আকদুল ওয়াকালা বা ওয়াকালা চুক্তি কার্যকর হবে। তৃতীয় ও চূড়ান্ত স্তরে গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংকের মুরাবাহা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি কার্যকর হয়।  শরিয়া দৃষ্টিকোণ থেকে ওই তিনটি স্তরে সংগঠিত আকদ বা চুক্তিগুলো সম্পূর্ণ পৃথক পৃথক হওয়া জরুরি। বিশেষ করে ওয়াকালাহ চুক্তি ও মুরাবাহা চুক্তি একই বৈঠকে হওয়া নিষিদ্ধ।

ইসলামী ব্যাংকিং মুরাবাহার তাৎপর্য : ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিতে মুরাবাহা মৌলিক কোনো ফাইন্যান্স পদ্ধতি নয়। সুদ থেকে বেঁচে থাকার স্রেফ একটি কৌশলী বিনিয়োগ পদ্ধতি। সুদি লোনের বিকল্প হিসেবে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের শুরু অবস্থায় সাময়িকভাবে এর অনুমোদন দেয়া হয়েছিল।

বিশ্বের অন্যতম ইসলামিক ব্যাংকিং স্কলার শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী লিখেছেনÑ ‘এ কথাটি কখনোই ভুলা যাবে না যে, মৌলিকভাবে মুরাবাহা কোনো ধরনের বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়। এটি শুধু সুদ থেকে বাঁচার একটি কৌশল। এটি আদর্শিক কোনো বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়, যা দ্বারা ইসলামের অর্থনীতির মূল রূপ বাস্তবায়ন হবে। তাই ইসলামী অর্থনীতির প্রতিষ্ঠার সূচনাকালে সাময়িকভাবে এর ব্যবহার সীমিত করা উচিত এবং যেখানে মুশারাকা ও মুদারাবা সম্ভব হবে না, শুধু সেক্ষেত্রেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ করা উচিত।’ (এন ইন্ট্রুডাকশন টু ইসলামিক ফাইন্যান্স, পৃ. ৭২)।

মোট কথা, মুরাবাহা ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আদর্শিক কোনো বিনিয়োগ পদ্ধতি নয়। এর ব্যবহার সীমিত করতে হবে। বিকল্প হিসেবে ভিন্ন কোনো কর্মকৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে যতটুকু মুরাবাহার চর্চা হবে, সেটা সঠিকভাবে করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, শুধু কাগজে-কলমে মুরাবাহা হওয়াই মুনাফা বৈধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই ইসলামী ব্যাংকগুলো থেকে যারা মুরাবাহা বিনিয়োগ গ্রহণ করবেন, তাদের উচিত এর আগে ফিকহুল মুয়ামালা বিষয়ে পারদর্শী কোনো মুফতির কাছ থেকে মুরাবাহার সঠিক পদ্ধতি জেনে নেয়া। এরপর বিনিয়োগ গ্রহণ করা।

-এজেড


সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ