||মুনীরুল ইসলাম||
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৭১ সালে। কিন্তু তারও প্রায় তিন দশক আগে কুমিল্লা থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল একটি পত্রিকা, যার নামই ছিল 'বাংলাদেশ'। এই নামটি পরবর্তীকালে যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম হয়ে উঠবে, সে সময় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
১৯৩৮ সালের প্রেক্ষাপট :
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে কুমিল্লা ছিল পূর্ববঙ্গের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। নজরুল ইসলাম, আবুল হোসেন, চৌধুরী মোফিজউল্লাহসহ এই অঞ্চলের অনেক মনীষী সংবাদপত্র ও সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৮ সালে কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত হয় 'বাংলাদেশ' নামের একটি মাসিক পত্রিকা।
এটি ছিল এমন এক সময়, যখন ভারতবর্ষে স্বাধীনতার আন্দোলন তুঙ্গে, পূর্ববঙ্গে জেগে উঠছিল জাতীয় চেতনা। মুসলমান ও বাঙালির স্বকীয় পরিচয়ের দাবি তখন ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই 'বাংলাদেশ' নামটি ছিল এক গভীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, যা পরবর্তী সময়ে যেন স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম হিসেবেই বাস্তব রূপ নেয়।
সম্পাদক ও প্রকাশনা :
স্থানীয় ঐতিহাসিক সূত্র ও আঞ্চলিক নথিপত্রে জানা যায়, এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শৈলেন চক্রবর্তী, যিনি কুমিল্লার এক তরুণ সাহিত্যিক ও সমাজচিন্তক ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে কয়েকজন অগ্রগামী শিক্ষক, সাংবাদিক ও সাহিত্যপ্রেমী মিলে এই পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশ করতে শুরু করেন।
পত্রিকাটি মূলত মাসিক হিসেবে বের হতো, তবে কিছু বিশেষ সংখ্যা অর্ধ-বার্ষিক আকারেও প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশনা অফিস ছিল তৎকালীন কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় এলাকায়, একটি ছোট্ট ছাপাখানায়।
বিষয়বস্তু ও লক্ষ্য :
'বাংলাদেশ' শুধু সংবাদপত্র ছিল না, এটি ছিল এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কণ্ঠস্বর।
এর মূল লক্ষ্য ছিল, দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত করা,
বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটানো,
ব্রিটিশ শাসনের নিপীড়ন ও সামাজিক বৈষম্যের প্রতিবাদ করা।
পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতো সমসাময়িক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, সমাজ-সমালোচনা ও কৃষিজীবনের বাস্তবচিত্র।
সেই সময় 'বাংলাদেশ' পত্রিকায় লিখতেন স্থানীয় তরুণ কবি ও শিক্ষকরা, যাদের মধ্যে অনেকে পরবর্তী সময়ে খ্যাতনামা সাহিত্যিক হয়ে ওঠেন।
পাঠক ও প্রভাব :
কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নোয়াখালী— এই অঞ্চলের পাঠকদের কাছে 'বাংলাদেশ' পত্রিকা দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির তরুণদের মধ্যে এটি জাতিসত্তা ও স্বাধিকারের ধারণা ছড়িয়ে দেয়।
যে সময় মানুষ ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি শুধু ভূগোল হিসেবে জানত, সেই সময়েই এই পত্রিকা সেই নামকে এক আত্মিক পরিচয়ে রূপ দিয়েছিল।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও নিষেধাজ্ঞা :
ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতাপন্থী বক্তব্য ও প্রবন্ধ প্রকাশের কারণে 'বাংলাদেশ' পত্রিকা একাধিকবার সেন্সর ও জব্দের মুখে পড়ে। স্থানীয় প্রশাসন সম্পাদক ও প্রকাশকদের তলব করে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল। তবুও সাহসী সম্পাদকরা পিছু হটেননি। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, বাঙালির আত্মপরিচয়, ভাষা ও অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করা।
বন্ধ হয়ে যাওয়া :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাগজের সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পত্রিকাটি ধীরে ধীরে নিয়মিততা হারায়। ১৯৪৩ সালের পর এর কোনো সংখ্যার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পরবর্তীকালে কুমিল্লার ঐতিহাসিক নথিতে উল্লেখ আছে, 'বাংলাদেশ' পত্রিকার শেষ কয়েকটি সংখ্যা পাওয়া যায়নি, তবে নামটি স্থানীয় সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে রয়ে গেছে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব :
১৯৩৮ সালে কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত এই 'বাংলাদেশ' পত্রিকার নামই যেন পরবর্তীকালের এক ঐতিহাসিক ইশারা হয়ে দাঁড়ায়। ৩৩ বছর পর, ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীন রাষ্ট্র 'বাংলাদেশ' জন্ম নেয়, তখন অনেক প্রবীণ মানুষ বিস্ময়ভরে বলেছিলেন, “আমাদের কুমিল্লা থেকেই তো ‘বাংলাদেশ’ নামের পত্রিকা বের হতো!”
এটি ছিল এক সাংস্কৃতিক স্বপ্নের বীজ, যা জাতির চেতনায় আগেই বপন করা হয়েছিল।
আজকের অনুসন্ধান :
আজও কুমিল্লা জেলা গ্রন্থাগার, বাংলা একাডেমি এবং জাতীয় আর্কাইভে 'বাংলাদেশ' পত্রিকার কপি বা তথ্য অনুসন্ধান চলছে। বাংলাপিডিয়ার কুমিল্লা জেলা নিবন্ধেও 'বাংলাদেশ' নামটি স্থানীয় পত্রিকার তালিকায় উল্লেখ রয়েছে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এই পত্রিকাই ছিল স্বাধীনতার আগে 'বাংলাদেশ' নাম ব্যবহারের অন্যতম প্রাচীন দলিল।
শেষ কথা :
'বাংলাদেশ' পত্রিকার ইতিহাস শুধু একটি স্থানীয় পত্রিকার কাহিনি নয়, এটি বাঙালির আত্মচেতনা, প্রতিবাদ ও স্বাধীনতার স্বপ্নের ইতিহাস। কুমিল্লার সেই ছোট্ট ছাপাখানায় যে পত্রিকার জন্ম হয়েছিল, সেটিই পরবর্তীকালে একটি জাতির নাম হয়ে দাঁড়ায়, যার নাম 'বাংলাদেশ'।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম
পরিচালক, সম্পাদনা কেন্দ্র
এলএইস/