|| মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী ||
ভারত উপমহাদেশে ইসলামের আগমন হয় দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারূক রাদি.-এর যুগে। অপর বর্ণনায় পাওয়া যায়, রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হিজরতের পূর্বেই ভারত উপমহাদেশে ইসলামের আগমন ঘটে। সাহাবায়ে কিরাম রাদি.-এর ছোট্ট একটি জামা'আতের প্রচেষ্টায় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রিতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হয় এ অঞ্চলে। ইসলামী শিক্ষা, সভ্যতা ও ইসলামী কৃষ্টি কালচার এ অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব সভ্যতা ও কৃষ্টি কালচারে পরিণত হয়।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যায়–দিল্লি শহরেই ছিল এক হাজারেরও বেশি এবং ভারত উপমহাদেশে ছিল–বারো লক্ষ আর শুধু বঙ্গ প্রদেশেই ছিল আশি হাজার মাদরাসা। ভারত উপমহাদেশে ইসলাম ও মুসলমানদের এমন উত্থান উপলব্ধি করে ইংরেজ বেনিয়াগোষ্ঠী এ অঞ্চলে যে কোনো মূল্যে তাদের প্রভাব ও সম্রাজ্য বিস্তারে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছিল এবং তৎকালীন বিশ্বের সবচে' সমৃদ্ধ নগরী বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশে একটি রাস্তা আবিস্কারের পর তাদের সামনে এক নয়াদিগন্ত খোলে গিয়েছিল। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে একদিন ছলেবলেকৌশলে এ উপমহাদেশকে গ্রাস করে নিয়েছিল তারা। ফলশ্রুতিতে এ উপমহাদেশে সর্বাঙ্গে সৃষ্টি হয় এক ধরনের অস্থিরত। সাথে সাথে ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ও ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতিতে মারাত্মক ধ্বস নেমে আসে। সেই ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা থাকার কথা। এক পর্যায়ে দখলদার ক্ষমতাসীন সম্রাটের পক্ষ থেকে ফরমান জারী হয়– "এখন থেকে বাদশাহর এ রাজত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুকুম চলবে"। সঙ্গে সঙ্গে শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলাভী রাহ. দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ফাতাওয়া জারী করলেন–
❝আজ থেকে ভারত 'দারুল হারব' (শত্রুকবলিত এলাকা)। প্রত্যেক মুসলমানের ওপর দেশকে স্বাধীন ও শত্রুমুক্ত করা ফরয হয়ে গেছে❞।
দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ল এই ফাতাওয়ার ঘোষণা। আঠারোশ' সাতান্ন সালে স্বাধীনতা আন্দোলন তথা সিপাহী বিদ্রোহের নামে সর্বত্রে ছড়িয়ে পড়ে এই ফাতাওয়ার মর্মবাণী। এক পর্যায়ে আন্দোলন ব্যর্থ হয়। থানাভবন সরকারের পতনও ঘটে। নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকেই শাহাদাত বরণ করেন। অপরাপর নেতৃবৃন্দ আত্মগোপনে চলে যান। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচে' লোমহর্ষক নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানো হয় মুসলমানদের উপর। লাখো-লাখো আলিমদের গলা কে*টে শহীদ করা হয়। কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রাহ. , হুজ্জাতুল ইসলাম কাসিম নানুতূবী রাহ. , ইমামে
রাব্বানী রাশীদ আহমদ গাংগুহী রাহ. নতুন করে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। তাঁরা ভাবতে থাকেন—চাপিয়ে দেয়া বিজাতীয় শিক্ষার প্রভাবে যুবসমাজ যদি ধ্বংস হয়ে যায় ভবিষ্যত বংশধর বিভ্রান্ত হয়ে হারাতে পারে হিদায়াতের পথ ও পাথেয়। বিজাতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি দখল করে নিতে পারে নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতির স্থান। তাহলে, আমাদের ভবিষ্যৎ আরো সাংগীন হয়ে পড়বে — এসব চিন্তা করে স্বাধীনতা আন্দোলনের বলিষ্ঠ চেতনায় উজ্জীবিত ও দ্বীনী চেতনায় উদ্দীপ্ত একদল আত্মত্যাগী সিপাহসালার তৈরির মহান লক্ষ্য সামনে রেখে দ্বীনী ইলম ও ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুনের সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসারের সুমহান উদ্দেশ্যে নতুন এক আন্দোলন সূচনা করেন এবং দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। ভারত উত্তর প্রদেশে দেওবন্দ নামক বস্তির 'সাত্তা মসজিদ'এ একটি ডালিম গাছের নিচে একজন ছাত্র ও একজন শিক্ষক দ্বারা ৩০ মে ১৮৬৬ ঈ. ; ১৫ মুহাররাম ১২৮৩ হিজরী সনে প্রতিষ্ঠিত হয় কওমী মাদরাসার সূতিকাগার ঐতিহ্যবাহী 'দারুল উলূম দেওবন্দ'।
সরকারী অনুদান ছাড়াই এমন অভিনব কায়দায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার এবং ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি নিজেদের হারানো ঐতিহ্য পূণরুদ্ধারের যে অভিনব ধারার সূচনা করলেন এই সকল মনীষীরা—তা জাতির ইসলামী ইতিহাসকে এক নতুন ধারায় পরিচালিত করে। অল্প দিনেই এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম-সুখ্যাতি ও অবদান ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে, বাড়তে লাগে দিন দিন প্রতিষ্ঠানের পরিধি, মাদরাসার পরম শ্রদ্ধেয় আসাতিযায়ে কিরামের সততা, নিষ্ঠা, খোদাভীতি, পরহেজগারি ও সমূহ ইসলামী জ্ঞানগভীরতার কথা মুখে মুখে চর্চা হতে শুরু হয়। ভারত উপমহাদেশসহ ইউরোপ, আফ্রিকা, আরব-আজম সর্বত্রে ছড়িয়ে পড়ে এর সৌরভ। ফলে সারা বিশ্ব থেকে ইলমে-দ্বীন পিপাসু ছাত্ররা দারুল উলূমে ভীড় জমাতে থাকে। সেখানে থেকে ইলমের "শারাবান ত্বাহুরা " আহরণ করে দেশ দেশান্তরে ছড়িয়ে দিতে থাকে এর অবদানকে। দারুল উলূম দেওবন্দের আদলে যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় মূলত সেসব প্রতিষ্ঠানই কওমী মাদরাসা নামে পরিচিত। দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয় ৩০ মে ১৮৬৬ ঈ.তে। দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার তিরিশ বছর পর বাংলার উম্মুল মাদারিস দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়—২০শে ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬ ঈসায়ী সনে। উভয় মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় মসজিদকেন্দ্রীক। দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একজন শিক্ষক ও একজন ছাত্র দিয়ে। শিক্ষকের নাম—মোল্লা মাহমুদ, ছাত্রের নাম—শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী। হাটহাজারী মাদারাসাও প্রতিষ্ঠিত হয় একজন শিক্ষক, একজন ছাত্র দিয়ে, হাটহাজারী চারিয়া কাজি পাড়া মসজিদে, শিক্ষকের নাম—হাবীবুল্লাহ কুরাইশী। ছাত্রের নাম—মাওলানা আবদুল আজীজ জনাবওয়ালা (প্রকাশ বড়তলীর হুজুর)। রাহিমাহুমুল্লাহ!
যেহেতু দারুল উলূম দেওবন্দকে কেন্দ্র করে, দারুল উলূম দেওবন্দের আদলেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় এজন্যই হাটহাজারী মাদরাসাকেই বাংলাদেশের উম্মুল মাদারিস বলা হয়।
হাআমা/
 
                              
                           
                              
                           
                         
                              
                          _original_1732102076.jpg) 
                        
                                                 
                      
                                                  
                                               
                                                  
                                               
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                         
                                      
                                        _medium_1754365057.jpg) 
                               
                               
                              