|| আবদুর রউফ আশরাফ ||
আলেম সমাজের মাঝে কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের জীবন আলোর প্রদীপ হয়ে শত শত হৃদয়ে দীপ্তি ছড়িয়ে যায়—তাঁদের কাজের গভীরতা বুঝতে গেলে কাগজ-কলম নয়, লাগে অন্তরের অনুভব। মাওলানা আব্দুল হক (রহ.) ছিলেন তেমনই একজন নিরলস খেদমতের মানুষ, যিনি জীবনের বড় অংশটিই মসজিদ ও মাদরাসার খেদমতে ব্যয় করে গেছেন। তিনি জীবনের গুরুত্বপূর্ন সময় দিয়ে সবাহী মক্তবের শিক্ষাকে বিস্তার করেছেন। পাশাপাশি এলাকার জামিয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া হলদারপুর মাদরাসায় কয়েক যুগ ধরে শিক্ষাদানরত ছিলেন। শয্যাশায়িত হওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত দরস-তাদরীসের নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন।
তিনি কখনো সময়ের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত হননি। ক্লাস শেষ হওয়ার পরও বহুবার ছাত্রদের পাশে বসে ব্যক্তিগতভাবে সমস্যা সমাধান করেছেন। সবসময় ছাত্র-উস্তাদদের খোঁজখবর নিতেন। তাঁর চোখে ছাত্ররা ছিল আমানত, আর শিক্ষা ছিল তাঁদের প্রতি দায়িত্ব। আর সহকর্মীদের প্রতি ছিল সহনশীল।
মাওলানা আব্দুল হক (রহ.) শিক্ষকতাকে জীবিকার জন্য বেছে নেননি—বরং এটি ছিল তাঁর ইবাদত, তাঁর জীবনের মিশন। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তিনি ছাত্রদের কুরআন-হাদীস, ফিকহ ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়েছেন নিঃস্বার্থভাবে। মাদরাসার প্রতিটি কক্ষে ছিল তাঁর নীরব উপস্থিতি।
তিনি ছিলেন এমন এক ব্যতিক্রম ব্যক্তি, যিনি শিক্ষকতার বাইরেও মাদরাসা-মসজিদের প্রতিটি খুঁটিনাটি কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। কখনো দাঁড়িয়ে থাকতেন মসজিদের রঙ-চুনকামে, কখনো ছাত্রদের জন্য বাজার সদাইয়ে, আবার কখনো রাতের গভীরে ছাত্রদের খোঁজ নিতে। তিনি কেবল মাদরাসার শিক্ষক নন—ছিলেন শিক্ষার্থীদের দায়িত্ববান অভিভাবক, অসুখে-বিসুখে ছাত্ররা তার কাছ থেকে পেতো বড় ধরনের সেবা।
মাওলানা আব্দুল হক (রহ.)-এর জীবনে নামাজ ছিল মূল ভিত্তি। একনিষ্ঠভাবে ইবাদত বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকতেন। তিনি কখনো নামাজ কাযা করতেন না। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল —সেদিনও তিনি যোহরের নামাজ আদায় করেন। এরপর কিছুক্ষণ পরই আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন। এমন মৃত্যু কেবল তাঁদের জন্যই সংরক্ষিত থাকে, যাঁরা জীবনে নামাজকে হৃদয়ের ধ্বনি বানিয়েছেন।
কোনো দিন কঠিন শব্দে, কড়া কথায় তিনি কাহারো সাথে অমানবিক আচরণ করেননি। প্রজ্ঞা ও ধৈর্যের অপূর্ব সমন্বয়ে গড়ে তুলেছিলেন তার ব্যক্তি জীবন। তাঁর সততা এতটাই প্রসিদ্ধ ছিল যে, এলাকার সাধারণ মানুষও তাঁকে "আল্লাহওয়ালা" বলে সম্বোধন করতেন।
আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর হাতে গড়া ছাত্র, তাঁর শিখিয়ে দেওয়া আদর্শ, তাঁর দেখানো খেদমতের পথ—সব কিছু মিলিয়ে তিনি রয়ে গেছেন সময়ের বাইরে। তাঁর জীবন দেখিয়ে দিয়েছে, একজন মানুষ কিভাবে ইখলাস, খেদমত আর তাকওয়ার সমন্বয়ে নিজেকে “মুমিনদের জন্য রোল মডেল” বানাতে পারেন।
আব্দুল হক (রহ.)-এর জীবন আমাদের জন্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—আসল সম্মান লুকিয়ে আছে নিঃস্বার্থ খেদমতের মাঝে। মসজিদ ও মাদরাসার এই খেদমতগাঁথা জীবন যেমন শ্রদ্ধার, তেমনি অনুকরণীয়।
আল্লাহ তা'য়ালা আব্দুল হক রাহিমাহুল্লাহুর সকল ইবাদতকে জান্নাতের বিনিময়ে কবুল করুন।
এমএম/