ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী
বহুল প্রত্যাশিত ২৮ দফা সম্বলিত জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। পাঠ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মাদ ইউনুস। দুঃখজনক বিষয় এটা যে, ২৮ দফা সম্বলিত ঘোষণাপত্রের শুরুতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনা ও ইতিহাসের কথাটি পাশ কেটে যাওয়া হয়েছে। প্রায় ২০০ বছর ইং-রে/জ বে-নি/য়ারা উপমহাদেশ শাসন করেছে। ইংরেজদের এই শাসনামলে এদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপরে যে নির্যাতন নিপীড়ন হয়েছে, বংশ-পরম্পরায় মুসলিম জাতি গোষ্ঠী যে আন্দোলন সংগ্রাম করে এসেছে, সে বিষয়টি একেবারেই উল্লেখ করা হয়নি। অত্যাবশ্যকীয় যে বিষয়টি উল্লেখ করা উচিত ছিল, তা হলো Two nation theory, দ্বি-জাতি তত্ত্বের কথা।
যেহেতু বাংলাদেশে মুসলিম জনসংখ্যা বেশি ছিল, তাই দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধাপে ধাপে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্ব লাভ করতে পেরেছে। যদি এই ভূখণ্ডে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি হত তাহলে কোন কালেও এদেশটি স্বাধীনতার মুখ দেখতে পেত না। তাহলে একথা সন্দেহাতীত ভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনা হচ্ছে “মুসলিম জাতিসত্তা”। কিন্তু সে বিষয়টি মোটেও উল্লেখ করা হয়নি; যার দ্বারা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসকে অস্বীকার'ই করা হয়নি, বরং চরম পর্যায়ের খেয়ানতও হয়েছে।
আরো দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী ফ্যা-সিবাদি সরকারের সময়ে শাপলা চত্বরে যে নির্মম নির্যাতন হয়েছে আলেমদের উপর; শত শত আলেম উলামা ও মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে শহীদ করা হয়েছে। এই বিষয়টিকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এটাও একটি অনভিপ্রেত দুঃখজনক বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। পতিত ফ্যা-সি/বাদী সরকারের ১৬ বছরের নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে শুধু রাজনৈতিক মঞ্চে রাজনৈতিক লোকগুলাই বক্তব্য দেয় নাই, বরং এদেশের অধিকাংশ আলেম-ওলামা পীর মাশায়েখ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করেছে। তার মধ্যে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের আদর্শিক কোন দ্বন্দ্ব ছিল না, দ্বন্দ্ব ছিল রাজনৈতিক, একান্তই পাওয়ার পলিসিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, শত শত স্কলার, ইসলামিক চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীগণ এক যুগের অধিককাল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করেছেন; এটা ছিল আদর্শিক। আর সেই আদর্শিক লড়াইয়ের কারণেই পতিত ফ্যাসিবাদী সরকার তাদের জনপ্রিয়তা হারিয়েছে এবং গণবিস্ফোরণ ও আন্দোলনে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। সেই উল্লেখযোগ্য বিষয়টিও জুলাই সনদের মধ্যে তুলে আনা হয়নি। যেটা বর্তমান সরকারের দায়িত্বশীল পরিকল্পনাকারীদের মানসিক অসুস্থতা ও হৃদয় সংকীর্ণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
রাজনীতির সাথে মোটেও যুক্ত নয় এ ধরনের লক্ষ লক্ষ মানুষ ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করেছিল তৎসময়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদ রুখে দেওয়ার জন্য। তবে ভা-র/তীয় আধিপত্যবাদ থেকে মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা আগ্রাসন থেকেও দেশ বেঁচে থাকুক, এটাও তাদের প্রত্যাশা ও কামনা। ভারতীয় আধিপত্যবাদ মুক্ত ও পশ্চিমা আগ্রাসন মুক্ত একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, টেকসই অর্থনীতি ও আদর্শ শিক্ষানীতির উপর বাংলাদেশ গড়ে উঠবে; এরকম কোন নিশ্চয়তা জুলাই সনদের মধ্যে উল্লেখ করা হয়নি। ইসলামী রাজনীতির ব্যানারে যারা রাজনীতি করেন তারা অনেকেই উপস্থিত ছিলেন, এ বিষয়ে তাদের কি প্রতিক্রিয়া? অবশ্যই সেটা দেশবাসীর জানার অধিকার আছে। ইসলামপ্রিয় দেশপ্রেমিক প্রতিটি বাংলাদেশীর প্রত্যাশা ছিল, বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিতর্কিত জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হবে। ঐতিহাসিকভাবে এই জাতীয় সংগীত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ঐতিহ্যের সাথে বেমানান। এই জাতীয় সংগীতটি রবি ঠাকুর লিখেছিল অখন্ড বাংলার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। আর সেটা তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের পরিপন্থি একটি বিষয়। কিন্তু দুঃখজনক জাতীয় সংগীতটি পরিবর্তন করার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ একমত হতে পারেননি। জাতি হিসেবেও এটি একটি চরম ব্যর্থতা। সেই ব্যর্থতার কলঙ্ক থেকেও জাতিকে নবগঠিত জুলাই সনদ মুক্তি দিতে পারেনি। বড় নির্লজ্জ ও দুঃখের বিষয় এই বিতর্কিত জাতীয় সংগীত পাঠ করার সময় অনেক রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের সাথে তাল মিলিয়ে কিছু আলেম-ওলামাও দাঁড়িয়ে ছিলেন যা খুবই দুঃখজনক ও লজ্জাজনক বিষয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সামাজিক ও রাজনৈতিক ফেতনা থেকে মুক্ত রাখুন। আমিন।
লেখক: চিন্তক ও পীর সাহেব জৈনপুর
এমএইচ/