মাওলানা সলিমুদ্দীন মাহদী কাসেমী
জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার তাখাসসুসাত (উচ্চতর গবেষণা বিভাগ)–এর ছাত্রদের নিয়ে একটি ৬ সপ্তাহব্যাপী দাওয়াতি প্রশিক্ষণ কোর্স ধারাবাহিকভাবে চলছে। আজ (২৬ সেপ্টেম্বর) ছিল এই প্রশিক্ষণের পঞ্চম সপ্তাহের বিশেষ সেশন।
আজকের আলোচ্য বিষয় ছিল: প্রাচ্যবিদ (Orientalism – الاستشراق)।
ঢাকা থেকে আগত বিশিষ্ট গবেষক মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক কাসেমী নদবী (حفظه الله) প্রাচ্যবিদদের ইতিহাস, উদ্দেশ্য, বর্তমান কৌশল এবং মুসলমানদের করণীয় বিষয়ে তথ্যনির্ভর ও দলিলসমৃদ্ধ একটি অনবদ্য আলোচনা পেশ করেন।
প্রাচ্যবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
প্রাচ্যবিদ বা Orientalist বলতে ইউরোপ ও আমেরিকার সেই সব গবেষককে বোঝানো হয়, যারা ইসলাম, কুরআন, হাদীস, আরবী ভাষা ও মুসলিম সভ্যতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। “Orientalism” শব্দটি ল্যাটিন orientalis থেকে এসেছে, যার অর্থ পূর্ব বা প্রাচ্য।
তাদের গবেষণার উদ্দেশ্য অনেক ক্ষেত্রেই ছিল মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দুর্বল করা, কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করা এবং উপনিবেশিক শক্তির স্বার্থসিদ্ধি করা।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
ক্রুসেড-পরবর্তী যুগ (১১–১৩শ শতক): মুসলিম শক্তির রহস্য বোঝা ও তাদের বিরুদ্ধে কৌশল নির্ধারণের জন্য ইউরোপীয় পণ্ডিতরা ইসলাম নিয়ে গভীর গবেষণা শুরু করে।
উপনিবেশিক যুগ (১৬–১৯শ শতক): ব্রিটিশ, ফরাসি ও ডাচ উপনিবেশবাদীরা মুসলিম ভূমি দখলের পাশাপাশি ইসলামকে একাডেমিক আলোচনায় বিকৃত করার চেষ্টা করে।
আধুনিক যুগে এডওয়ার্ড সাঈদের বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ Orientalism (১৯৭৮) প্রমাণ করে যে এই গবেষণা আসলে ঔপনিবেশিক রাজনীতির একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
বর্তমান ষড়যন্ত্র ও কৌশল:
- জ্ঞান বিকৃতি (علمي تحريف): কুরআন ও হাদীসের প্রমাণিকতা নিয়ে তথাকথিত সমালোচনামূলক গবেষণার (Critical Study) নামে সন্দেহ সৃষ্টি।
- মিডিয়া আক্রমণ: চলচ্চিত্র, উপন্যাস ও সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে মুসলমানদের উগ্র বা পশ্চাদপদ হিসেবে উপস্থাপন।
- Islamophobia নেটওয়ার্ক: গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও থিংক ট্যাংকের আড়ালে মুসলিম দেশগুলোর নীতিনির্ধারণে চাপ সৃষ্টি।
- অভ্যন্তরীণ সহযোগী তৈরি: পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষিত কিছু মুসলিম বুদ্ধিজীবীকে ব্যবহার করে শরীয়াহ সংস্কারের প্রচেষ্টা চালানো।
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাচ্যবিদদের প্রভাব:
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে প্রাচ্যবিদদের তৈরি করা জ্ঞান ও তথ্যের সংস্পর্শে আসছে।
পাঠ্যবই, গবেষণা প্রবন্ধ, বিদেশি সাহিত্য ও মিডিয়া কনটেন্টের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতি ও চিন্তার ধারা তরুণ প্রজন্মের মনে প্রভাব ফেলছে।
ফলে কুরআন ও ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলা, ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং পশ্চিমা সংস্কৃতিকে অনুসরণ করাকে অগ্রগতির মানদণ্ড ভাবার প্রবণতা বাড়ছে।
এটি শুধু একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ নয়, বরং সমাজের আধ্যাত্মিক কাঠামো ধ্বংসের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।
আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে সতর্ক করে বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ
(সূরা আন-নিসা: ৭১) “হে মুমিনগণ! তোমরা সতর্ক থাক।”
এবং আরও বলেছেন,
وَلَن تَرْضَىٰ عَنكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ
(সূরা আল-বাকারা: ১২০) “ইহুদী ও খ্রিস্টানরা কখনো তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মের অনুসরণ কর।”
আমাদের করণীয়:
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুসলমানদের প্রথম কাজ হলো শক্তিশালী জ্ঞান অর্জন এবং আত্মপ্রস্তুতি। কুরআনে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন,
وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ
(সূরা আনফাল: ৬০) “তোমরা তাদের মোকাবেলায় যতটুকু শক্তি সঞ্চয় করতে পারো, তা প্রস্তুত কর, যাতে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুর মনে ভয় সঞ্চারিত হয়।”
তাছাড়া, ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধের জন্য কুরআনকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে,
وَجَاهِدْهُم بِهِ جِهَادًا كَبِيرًا
(সূরা আল-ফুরকান: ৫২) “তুমি কুরআনের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে বড় জিহাদ কর।”
রাসূলুল্লাহ ﷺ জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন,
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ
(ইবনে মাজাহ) “প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞান অর্জন ফরজ।”
বস্তুত কুরআন ও সুন্নাহর গভীর জ্ঞান এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধের সক্ষমতা ছাড়া প্রাচ্যবিদদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।
বিশেষত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিডিয়া অঙ্গনে তরুণদের মানসিক ও সাংস্কৃতিক সুরক্ষা এখন সবচেয়ে বড় দাওয়াতী চ্যালেঞ্জ। কারণ, ইসলামী শিক্ষার আলো ছাড়া আমরা শুধু হারাবোই, ফিরে আসতে পারবো না।
লেখক: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম
আরএইচ/