|| মুহাম্মদ খালেদুজ্জামান ||
সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের সম্পাদক, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর জৌষ্ঠ পুত্র মুহতারাম মোস্তফা মুঈনুদ্দীন খান সাহেবের সঙ্গে সেগুনবাগিচা চিটাগাং হোটেলে বেশ জম্পেশ আড্ডা হয়। সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের হারানো জৌলুস আবারও আমরা দেখতে চাই বলে আবেদন করলে তিনি আমাদের মাস দুই বা তিনেকের মধ্যে ইনশাআল্লাহ পুনর্মুদ্রণ আরম্ভ করবেন বলে আশস্ত করলেন।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর মিশুক স্বভাব তিনি ঔরসসূত্রে লাভ করেছেন। দারুণ খোশালাপি মানুষ। ভরা যৌবনে সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের অফিস, সহকর্মী ও অসংখ্য পাঠক ও গুণগ্রাহীদের মাতিয়ে রাখতেন। ইতিহাসের বহু চিপায় ভ্রমণ করেছেন। দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অর্ধশতাধিক দেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দেহলিজে। পৈতৃক সূত্রেই সহজাত ঔদার্যবোধের অধিকারী।
দৈনিক ইনকিলাবের সহকারী সম্পাদক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী সাহেব মোস্তফা মুঈনুদ্দীন খান সাহেবের অধীনে এক যুগ সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এক সাক্ষাতে মাওলানা নদভী বলেছিলেন, সাংবাদিকতার জগতে মোস্তফা ভাই আমার প্রথম শিক্ষক। তিনিই আমার লেখায় প্রথম লাল কালি দিয়ে সংশোধন করেছেন।
খানিক সময় বাদে আমরা চিটাগং হোটেল থেকে অনেকদিন পর বায়তুল মোকাররমের দিকে অগ্রসর হই। ওখানে আসর পরে বায়তুল মোকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম মুফতী মিজানুর রহমান কাসেমীর বিশ্রামগারে ঘরোয়া মজমা শুরু করি। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর অনেক স্মৃতিচারণমূলক আলোচনার ডালা খুলে বসি। মুফতী মিজানুর রহমান কাসেমী মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর আপন ভাগিনা।
২০০৬ সালে থেকে অদ্যাবধি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এর আগে ছয় মাস চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদে ইমামতি করেছেন। মাওলানা আব্দুল মালেক দা. বা. স্থায়ী খতিব নিযুক্ত হওয়ার পূর্বে মুফতী মিজান সাহেব জুমার খুতবা পরিচালনা করেছেন অত্যন্ত সুনামের সাথে।
মুফতী মিজানুর রহমান কাসেমী সাহেব মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, মামার মতো এমন দিল দরিয়া উদার মানুষ কি আর আসবে? নিজের সুখ ভোগ বিলাসিতার কথা কোনো দিন চিন্তা করেননি। উনার মতো প্রশস্ত দস্তরখানা ওয়ালা আলেম এদেশে আর কেউ ছিল না। সারাদিন আগন্তুকদের জন্য দস্তরখানা বিছানো থাকতো।
মুফতী সাহেব বললেন, আমার আব্বা আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন। প্রতি মাসে মাদরাসার কাজে ঢাকা আলিয়ায় আসতে হতো। উনার সঙ্গে আশপাশের অনেক আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপালরাও আসতো। সকলের থাকা খাওয়ার স্থান ছিল মামার গেন্ডারিয়ার বাসা। কোনো দিন বিরক্তি প্রকাশ তো দূরের কথা আগেরবার তুলনায় পরের বারে খাবারের মানেও কমবেশ হতো না।
মানুষকে সাহায্য করতেন কোনো বিনিময়ের প্রত্যাশা ছাড়া। মুফতী সাহেব বলেন, আমি যখন ৯৬ সনে দেওবন্দ পড়তে যাই তখন টাকা পয়সা পাঠানোর সহজ উপায় ছিল না। টাকা ফুরিয়ে গেলে আব্বার কাছে চিঠি লেখলাম। আব্বা টাকা নিয়ে মামার কাছে এসে বললো- মিজান টাকা চেয়েছে, আমার তো পাঠানোর সোর্স নেই, আপনি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন।
মামা বললেন, বাড়ি যাবেন কবে? আব্বা বললেন আগামীকাল। মামা বললেন, টাকাটা নিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় বড় মাছ কিনে নিয়ে যাবেন। আর টাকা পাঠানোর জন্য চিন্তা করতে হবে না। এরপর মামা কলিকাতা মাসিক মদীনার এজেন্টকে টেলিফোন করে বলে দিলেন। এরপর দেখা যেত প্রতি মাসে নির্ধারিত দিনে কলিকাতা থেকে ডাকযোগে চার পাচ হাজার টাকা চলে আসতো।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. শুধু সাহিত্যিক লেখক আর সাংবাদিকই ছিলেন না। মুফতী সাহেব বলেন, আজ পর্যন্ত যতবড় বুজুর্গদের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর ভাগ্নে জানার মামার প্রতি এতো বেশি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতো যে, আমি অবাক হয়ে যেতাম। একবার এক অনুষ্ঠানে মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ.-এর সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। আমি বায়তুল মোকাররমের ইমাম শুনে একটু তাকিয়ে স্বাভাবিক হলেন।
কিন্তু পরক্ষণেই যখন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর ভাগ্নে শুনলেন তৎক্ষণাত দাঁড়িয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন প্রায় তিন চার মিনিটের মতো। এরপর মামা সম্পর্কে বললেন- হুজুর অনেক বড় আল্লাহর ওলী মানুষ। আপনি কতবড় সৌভাগ্যবান। আরেকবার কুমিল্লার মাওলানা আশরাফ আলী রহ.-এর সঙ্গে একটি মাহফিলে ছিলাম। উনি আমি মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর ভাগ্নে শুনেই বুকে জড়িয়ে নিলেন। বললেন অনেক বড় মানুষ। খতিব উবায়দুল হক সাহেবের মতো মানুষ মামা যাকে উস্তাদতুল্য শ্রদ্ধা করতেন তিনিও কোনো মিটিংয়ে বসলে মামা যে খেয়াল পেশ করতেন অধিকাংশ সময় মামার খেয়ালের ওপরই ফয়সালা দেওয়ার আগে বলতেন- ‘আমাদের আদিব সাহেব যেমন বলেছেন সেটাই সঠিক।’
আমি উনাদের মামার প্রতি শ্রদ্ধা দেখে বিস্মিত হয়ে যেতাম। মজমায় উপস্থিত আমরা সাত আটজন সবাই স্মৃতি কাতর হয়ে পড়ি। মুফতী সাহেব বলেন, যেখানেই গিয়েছি খান সাহেবের প্রতি মানুষের যে ভক্তি শ্রদ্ধা দেখেছি তা মামার মাকবুলিয়াতের নিদর্শন। কোনো অসহায় মানুষ তার কাছে এসে আশাহত হতো না। মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. এর পরে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. ছাড়া এমন প্রশস্ত দস্তরখানাওয়ালা আলেম খুব কদাচিৎ দেখা যায়। এতো বড় এবং ব্যস্ত মানুষ হয়েও সাধারণ মানুষকে যে সময় দিতেন তা একপ্রকার কারামত বলা যায়। প্রত্যেক পাঠকের চিঠির জবাব সঙ্গে সঙ্গে লিখে পোস্টে পাঠিয়ে দিতেন। কাউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন না। রাহিমাহুল্লাহু তাআলা।
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া, মুহাম্মাদপুর, ঢাকা
এসএকে/