||আব্দুল্লাহ শহীদ||
এ.জেড.এম শামসুল আলম রহ.-এর লেখা প্রবন্ধ ও বই ছাত্রজীবন থেকেই পড়ে আসছি। তাঁকে একজন লেখক হিসেবে জানতাম। কিন্তু এই জানা যে খুব কম ছিল তা জানলাম যখন ১৯৯৯ সালে বান্দরবানে ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র দেখতে গেলাম। সেখানে একজন সরকারি কর্মকর্তার সাথে কথা হলো। তিনি রাত ২টা পর্যন্ত আমাকে তাঁর গল্প শোনালেন- কীভাবে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি থাকাকালীন বান্দরবানে কাজ করেছেন; সব সরকারি কর্মকর্তাকে কীভাবে রাত-দিন জাগিয়ে রাখতেন; নওমুসলিমদের জন্য কীভাবে প্রকল্প করতেন; উপজাতিদের মাঝে শিক্ষা-সভ্যতা প্রসারের জন্য কীভাবে দৌড়াতেন পাহাড় থেকে জঙ্গলে। আমি তার গল্প শুনতে শুনতে শিহরিত হয়ে উঠেছিলাম। একজন সরকারি কর্মকর্তা এতো বড় দাঈ হতে পারেন, তার কাহিনি না শুনলে বিশ্বাস হতো না।
এরপর ২০০৮ সালে ঢাকার উত্তরায় আবহাস গবেষণা কেন্দ্রে একটি সেমিনারে তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. শামসুল হক সিদ্দীক। তিনি এলেন। এসে তিনি সোফায় না বসে ফ্লোরে বসে পড়লেন। আমরা আশ্চর্য হলাম। আমরা তাঁকে অনুরোধ করলাম সোফায় উঠে বসতে। তিনি বিনয়ের সাথে বললেন, ‘আপনাদের অফিসের মেঝে এতে পরিষ্কার যে, আমি ফ্লোরে বসার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি আপনাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ফ্লোর দেখেই আপনাদের চিনে ফেলেছি। যত জায়গায় ইসলাম দেখার জন্য গিয়েছি, সব জায়গায় নোংড়া, ময়লা-আবর্জনা দেখেছি। ব্যতিক্রম দেখলাম আপনাদেরকে।’
যতক্ষণ ছিলেন তিনি ফ্লোরেই বসে ছিলেন। বক্তব্য রাখলেন দাঁড়িয়ে।
তিনি গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথা বললেন তাঁর বক্তব্যে। শুরু করলেন এভাবে, ‘আমাদের বাপ-দাদারা ছিল মূর্তি-পূজারি। আমরা মূর্তি-পূজা ত্যাগ করেছি বটে, কিন্তু মূর্তির প্রতি মনের টান রয়ে গেছে। এজন্য আমরা নামাজকে মূর্তি বানিয়েছি। রোজাকে মূর্তি বানিয়েছি। হজ-উমরাকে মূর্তি বানিয়েছি . .. পূজা করে যাচ্ছি।’
তাঁর কথা শুনে আমি ভাবলাম, তিনি কী বললেন! ঠিক বলেননি। কিন্তু একটু পর ভেবে দেখি, তিনি এমন সত্য কথা বলেছেন, যা আর কেউ বলেনি- চিন্তা করেনি।
তার কয়েক মাস পর একদিন ড. শামসুল হক সিদ্দীক সাহেব আমাকে বললেন, চলুন, শামসুল আলম স্যারকে দেখে আসি। তার সাথে গেলাম মতিঝিলে তাঁরই অফিসে। দীর্ঘক্ষণ তাঁর কথা শুনলাম। আমাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনলেন। বললাম, স্যার আপনি এতো কাজ কীভাবে করলেন?
কথা বলতে বলতে জোহর হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘এখন নামাজ পড়ে খাবার খেয়ে যেতে হবে। এর আগে যাওয়ার অনুমতি মিলবে না।’ আমরা তার সাথে দুপুরের খাবার খেলাম। বিদায়ের সময় পাশে একটি রুম দেখালেন। বললেন, ‘এখানে বিশ্রাম নিয়ে থাকি। অনেক সময় এখানেই রাত কাটাই।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘স্যার এই একটি ফোল্ডিং চৌকি যেখানে তোষক নাই, চাদর নাই, বালিশ নাই, উপরে শুধু রেকসিনের কভার। আপনি এখানে ঘুমান কীভাবে? প্রথমবার প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন। আমি আবার প্রশ্ন করলাম। তিনি বললেন, ‘আপনার মতো আরামের বিছানায় ঘুমালে আজ আপনি আমাকে দেখতে আসতেন না আর বলতেন না, স্যার এতো কাজ কীভাবে করলেন?’
জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক ইসলামি চিন্তাবিদ দেখেছি, যারা আলেমদেরকে সম্মান-শ্রদ্ধা করেন না। বিরূপ মনোভাব লালন করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন উল্টো। আলেম-উলামাকে খুব সম্মান করতেন। তাদের থেকে শিখতে ও জানতে চাইতেন।
দুজন সচিব ছিলেন, মানুষ তাদেরকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে যুগ যুগ ধরে। একজন তিনি। আরেকজন মরহুম শাহ আব্দুল হান্নান। তবে প্রথম জনের কর্ম-পরিধি ছিল ব্যাপক-বিস্তৃরিত। আজকের সাজানো-গোছানো ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাঁরই কৃতি-স্বাক্ষর।
তাঁর মত আরও দু চার জন নিবেদিত-প্রাণ, প্রজ্ঞাবান, সৎ, অকুতোভয়, জাতি-দরদি, দেশ-প্রেমিক, ত্যাগী, যাহিদ, মুখলিস, মুহসিন কর্মবীর থাকলে এই দেশ পরিবর্তনে সময় লাগবে না। প্রচার-বিমুখ এই মানুষটি অনেক কিছু দিয়ে গেছেন এই জাতিকে।
অবশেষে প্রায় ৮৮ বছর বয়সে তিনি সফর শেষ করলেন গত ২৬ জুলাই -২০২৫ শুক্রবার।
আরশে আজিমের মহান অধিপতি আল্লাহ তাঁর সব নেক আমলকে ছাদাকায়ে জারিয়া হিসাবে গ্রহণ করুন। জান্নাতে উচ্চ সম্মান দান করুন। আমিন।
লেখক: দাঈ, চিন্তক ও কলামিস্ট
এনএইচ/